মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

আতঙ্ক নিয়ে আর কত দিন বসবাস করতে হবে?

প্রকাশের সময় : ২৯ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ
জঙ্গি হামলার আতঙ্ক থেকে যেন মানুষ বের হতে পারছে না। চলতে-ফিরতে এমনকি বাসাবাড়িতেও স্বস্তি পাচ্ছে না। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার আশ্বস্ত করা সত্ত্বেও মানুষ আতঙ্ক থেকে বের হতে পারছে না। কী করলে যে এ আতঙ্ক থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক পরিবেশে নির্ভয়ে মানুষ চলাফেরা করবে, তার আপাত উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। একটি দৈনিকের পাঠক মতামত বিভাগে একজন পাঠক লিখেছেন, ‘ঢাকায় জীবনযাত্রা কবে আবার স্বাভাবিক হবে, কেউ বলতে পারেন না। কিন্তু সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করার বদলে আরও ভয় ছড়ানোয় মন্ত্রী, সাংসদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা কেউই পিছিয়ে থাকছেন না। মন্ত্রীদের এসএমএস পাঠিয়ে সাবধানে চলাফেরা করার উপদেশ, এমপিদের গানম্যান দাবি কিংবা নেতৃস্থানীয় কোনো কোনো মন্ত্রীর হুমকির কথা সরকারের জানা ছিল ধরনের বিবৃতি তার নমুনা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ জনমনে বর্তমানে কী ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে তা পাঠকের এ মন্তব্য থেকে কিছুটা হলেও ধারণা করা যায়। তার ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া, জায়গায় জায়গায় তল্লাশি চালানো এবং টহল দেয়ার দৃশ্যও জনমনে শঙ্কা জাগাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার আরও সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে বলে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেছেন। তিনি মন্ত্রিসভার সদস্যদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আগস্টে জঙ্গিগোষ্ঠী যে কোনো সময় যে কোনো মন্ত্রী অথবা যে কোনো আদালতে হামলা চালাতে পারে। গত ১৩ জুলাইও তিনি জঙ্গিগাষ্ঠীর আরও হামলার আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। সর্বশেষ গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে জঙ্গিদের সাথে যৌথবাহিনীর আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে ৯ জঙ্গি নিহতের ঘটনায় মানুষের মনে আতঙ্ক আরও ঘনীভূত হয়েছে। যেন যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু অবশ্য বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এই মুহূর্তে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা দেশের বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে সমাজের বিরুদ্ধে ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে।’ বর্তমান পরিস্থিতি যে অনেকটা এমনই তার এ কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। একটি দেশ যখন এমন যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়, তখন জনগণের স্বস্তিতে থাকার কোনো কারণ নেই। এর ফলে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি থমকে যাওয়াই স্বাভাবিক। গত কিছু দিনের পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন দেখলে বোঝা যায়, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আশঙ্কাজনকভাবে ধীর হয়ে পড়েছে। রপ্তানি বাণিজ্য, বিনিয়োগ থেকে শুরু করে শপিং মল হোটেল-রেস্তোরাঁ এমনকি ক্ষুদ্র ব্যবসায়েও চরম মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। অর্থের লেনদেন কমে গেছে। অর্থের স্বাভাবিক এবং উচ্চ প্রবাহ যদি কমে যায়, অর্থনীতি থমকে যেতে বাধ্য। দেশ পিছিয়ে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশ এখন যেন এ অবস্থার মধ্যে পড়েছে। কবে এ থেকে উত্তরণ ঘটবে, তা অনুমান করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
দুই.
জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলা হওয়ার আগে সরকারের তরফ থেকে অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতি নিয়ে নিরন্তর কথা শোনা যেত। যদিও সরকারের দাবি ও অর্থনীতিবিদদের মতামতের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হতো। কিছু দিন আগেও অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের অভাবে বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ক্রমাগত ঋণাত্মক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত। যার একাধিক দোকানপাট ছিল, সে একটিতে এসে থিতু হয়েছে। অনেকে দোকান ছেড়েও দিয়েছে। যারা দোকান খুলে বসে ছিল, তাদের বেচাকেনা অকল্পনীয় হারে কমে গেছে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতেও মানুষের চোখে তা ধরা পড়ছে। এবারের রোজার ঈদে বেশ কয়েকজন পোশাক ব্যবসায়ীর সাথে কথা হয়। প্রশ্ন করা হয়, এখন তো রাজনৈতিক কোনো আন্দোলন নেই, নিশ্চয়ই ব্যবসা ভালো হচ্ছে? প্রশ্নের জবাবে তারা বলেছেন, গত বছরের তুলনায় কম। কেউ বলেছেন, গত বছরের অর্ধেক। এক ব্যবসায়ী কোটি টাকা বিনিয়োগ করে মেয়েদের ড্রেস দোকানে উঠিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আশা করেছিলাম এবার বেশ ভালো বেচাকেনা হবে। এখন দেখছি সব মাল দোকানেই থেকে যাবে। এ অবস্থা হলে তো মাঠে মারা যাব। ব্যবসায়ীদের কথা শুনে বিস্মিত হতে হয়েছে। কারণ স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল, গত বছরের তুলনায় এবারের ঈদে ব্যবসা ভালো হবে। ব্যবসার এ পরিস্থিতি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রত্যেকেরই অভিন্ন উত্তর, মানুষের হাতে টাকা নেই। এই পরিস্থিতির মধ্যেই গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কেট ও শপিং মলগুলোতে যেন বাজ পড়েছে। একেবারে খাঁখাঁ করা অবস্থা। বড় বড় শপিং মলেও ঢুকতে গেলে মেটাল ডিটেক্টর পার হওয়ার পরও গার্ডরা আগতদের যেভাবে দেহ তল্লাশি করে, তাতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। তখন অনেকের মনে হওয়া স্বাভাবিক, এখানে না এলে কী হয়! বলার অপেক্ষা রাখে না, এভাবেই ক্রেতারা আতঙ্কিত ও নিরুৎসাহী হয়ে উঠছে। শপিং মলের ব্যবসাও লাটে উঠছে। এ ধরনের চিত্র গুলশানের বাইরের অভিজাত শপিং মলগুলোতে দেখা যায়। আর গুলশানের শপিং মল ও ব্যবসায়ীদের কী অবস্থা, তার বিবরণ তো প্রায় প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে, গুলশানে শপিং করে দেশের সবচেয়ে বিত্তশালীরা। রাজধানীর মধ্যে বেশি ব্যবসা করার স্থান এই এলাকা। এটি ব্যবসার অন্যতম ‘হাব’ বা ‘হটস্পট’। সন্ত্রাসী হামলা হওয়া এবং পরবর্তী নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার পর এই এলাকার ব্যবসা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে। শপিং মলগুলো ক্রেতাশূন্য। দোকানিরা দোকান খুলে তীর্থের কাকের মতো ক্রেতার অপেক্ষায় থাকে। গুলশানের সবচেয়ে বড় ব্যবসা ফাস্টফুড ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। এই ব্যবসা এখন নাই-এর পর্যায়ে রয়েছে। গত রবিবার একটি দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় গুলশানের জনপ্রিয় একটি রেস্টুরেন্টের ভিতরের আলোকচিত্র ছাপা হয়। তাতে দেখা যায়, ক্রেতার অভাবে রেস্টুরেন্টের সব চেয়ার উল্টে রাখা হয়েছে। গুলশানকে নিরাপদ করতে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তাতে এ ধরনের অনেক রেস্টুরেন্ট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ওই এলাকা থেকে হয় সরে যেতে হবে, না হয় বন্ধ করে দিতে হবে। পাশাপাশি গুলশানে যেসব অভিজাত হোটেল, গেস্ট হাউস ও হসপিটালিটি সেন্টার রয়েছে, যেখানে বিদেশিরা এসে উঠতেন, সেগুলোও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। অতিথিই যদি না আসে, তাহলে বিশাল শান-শওকত নিয়ে গড়ে ওঠা এসব হোটেল-গেস্ট হাউস বন্ধ হবে, এটাই স্বাভাবিক।। এর ফলে এসব ব্যবসা অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখে আসছিল, তা বন্ধ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গুলশান থেকে হোটেল-রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য বিনোদন স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। যদি তাই হয় তবে অর্থনীতির জন্য এটা নিশ্চিতভাবেই একটা বিরাট ধাক্কা হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে ফেডারেশন অব হোটেল, গেস্ট হাউস অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন করে দাবি জানিয়েছে, এসব উচ্ছেদ না করে সংরক্ষণ করার জন্য। উচ্ছেদ করলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্পের বায়ার আসবে না। কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, চীনসহ পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাবে। এতে প্রতি বছর দুই বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি হবে। সংগঠনটি দাবি করে এসব ব্যবসার সাথে এক লাখ লোক জড়িত। উচ্ছেদ করলে এসব লোক বেকার হয়ে যাবে এবং ১০ লাখ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া হোটেল ব্যবসায়ীরা এ খাতে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করেছে। বলাবাহুল্য, গুলশানের মতো অভিজাত এলাকা এবং যা কূটনীতিক পাড়া হিসেবে পরিচিত সেখানের চিত্র যদি এই হয়, তবে তা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ করবে এবং করেছেও। এই বার্তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যে আরও নিরুৎসাহী করে তুলবে, তাতে সন্দেহ নেই। শুধু বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরই নিরুৎসাহী করবে না, দেশি বিনিয়োগকারীরাও হাত গুটিয়ে নেবে। তারা এই বিনিয়োগ অন্য দেশে নিয়ে যাবে। ইতোমধ্যে এ ধরনের একটি ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। প্রায় পাঁচটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। দুলাল ব্রাদার্স লিমিটেড বা ডিবিএল ইথিওপিয়ায় তাদের পোশাক কারখানা স্থাপন করছে। দেশটির রাজধানী আদ্দিস আবাবার পাশের শহর মেকেলে ৭৫ হেক্টর জমির ওপর গড়ে তুলছে এই কারখানা। আগামী বছরের এপ্রিলে কারখানাটি উৎপাদন শুরু করবে। সেখানে ৪ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে এবং বছরে ৩ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করবে। অথচ এই কারখানাটিসহ বাকি চারটি কারখানা বাংলাদেশেই স্থাপিত হতে পারত। এর মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হতো। কোটি কোটি ডলার আয় হতো। হলো না কেন? কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করছে, দেশে বিনিয়োগ করার মতো কোনো পরিবেশ নেই এবং বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কথা বাদই দেয়া যাক, দেশের বিনিয়োগকারীরা যদি বিদেশে চলে যায়, তবে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! দেশের অর্থনীতি কীভাবে এগোবে? সরকার যে ক্রমাগত তার উন্নয়নের কথা বলছে, এসব দৃষ্টান্ত তো তার সাক্ষ্য দিচ্ছে না। আবার বিদেশে বিনিয়োগই শুধু নয়, কেউ কেউ অর্থ দেশে না রেখে বিদেশেও পাচার করে দিচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বৈধ-অবৈধ পথে বিদেশে অর্থ পাচারের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৩ সালেই পাচার হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে অর্থ পাচারের হার আরও বেড়ে যাবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। বাড়ারই কথা। যার অর্থ, সে কোনোভাবেই চাইবে না তার অর্থ অনর্থে পরিণত হোক। স্বাভাবিকভাবেই যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতে চাইবে এবং যেখানেই নিরাপদবোধ করবে, সেখানেই নিয়ে যাবে। এই যে অর্থ ধরে রাখা বা পাচার করে দেয়া, এ প্রবণতায় অর্থনীতি দ্রুত অগ্রসর হওয়ার কোনো কারণ নেই। বলাবাহুল্য, অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি যেমন অর্থ, তেমনি এই অর্থের নিরাপত্তা যদি না থাকে, তবে অর্থনীতি স্থবির হতে বাধ্য। বিনিয়োগকারী চাইবে না তার অর্থ বৃদ্ধির পরিবর্তে হ্রাস পাক। তার চেয়ে বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই, যা আছে তা খোয়ানোর প্রয়োজন নেই।
তিন.
এই কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ ছিল না। বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাত বিশ্বের অন্যতম ‘হটস্পট’ এবং ‘ফাস্টেট গ্রোয়িং ফিল্ড’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বলা হয়েছিল, চীনের পরই বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এবং অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এক নম্বরে চলে আসবে। দুঃখের বিষয়, বছর দুয়েক না যেতেই অফুরন্ত সম্ভাবনার এই খাতটি হুমকির মুখে পড়েছে। রপ্তানি খাতের এক নম্বর ক্ষেত্রটি এখন চরম শঙ্কায় রয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ১২ লাখেরও বেশি শ্রমিক বেকার হয়েছে। গার্মেন্ট খাত ধ্বংসের চক্রান্ত এবং তা পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাওয়া নিয়ে ষড়যন্ত্রের কথা বহুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে শোনা গেছে, বাংলাদেশের পোশাক খাতকে টার্গেট করে বাংলাদেশ লাগোয়া পার্শ্ববর্তী দেশের প্রদেশে বড় ধরনের শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশে আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে যাতে বায়াররা পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যায়, এ লক্ষ্যে একটি চক্র কাজ করছে। গার্মেন্ট শিল্পের অনেকেই মনে করেন, দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ খাত চক্রটি ভারতের হাতে তুলে দিতে চায়। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে গর্ব করার মতো যে দু-চারটি খাত রয়েছে, তার মধ্যে গার্মেন্টই শীর্ষে। বহু শ্রমে-ঘামে গড়ে ওঠা এ শিল্প সাধারণ মানুষের উন্নতিতে যে কত বড় ভূমিকা রেখে চলেছে, তা সবারই জানা। লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান তো বটেই, রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা ৮৩ ভাগই এ শিল্প থেকে আসে। ভোর হলে রাজপথের পাশ ঘেঁষে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে যে অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে লাইন ধরে হেঁটে যেতে দেখা যায়, এই তারাই গার্মেন্ট খাতের প্রাণশক্তি। এর মাধ্যমে তাদের ভাগ্যের যেমন পরিবর্তন হচ্ছে, তেমনি দেশের অর্থনীতিকে অগ্রগামী করতে প্রভূত ভূমিকা রাখছে। অথচ এই শিল্প না থাকলে হয়তো এই তরুণীদের বিরাট অংশ বাসাবাড়িতে অনেকটা দাস হয়েই থাকত। বলাবাহুল্য, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে খুব বেশি ক্ষেত্রের প্রয়োজন পড়ে না। একটি ক্ষেত্র উন্নতির শিখরে আরোহণ করলেই দেশটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়। আরব বিশ্বের দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখব দেশগুলোর মূল সম্পদই হচ্ছে তেল। এই একটি ক্ষেত্র দিয়েই দেশগুলো উন্নতির শিখরে চলে গেছে। জাপান এক গাড়ি শিল্প গড়ে তুলে বিশ্ববাজার দখল করে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের বাজারও জাপানি গাড়ির দখলে। আমাদের মতো উন্নয়নকামী দরিদ্র দেশে অতি পরিশ্রম করে পোশাক শিল্প খাত তৈরি করেছি। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর জনগণ বাংলাদেশে উৎপাদিত ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক পরছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের এবং উন্নয়নের প্রতীক। বাস্তবতা হলো, এই গৌরব আমরা যেন হারাতে বসেছি। গৌরব ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার যত ধরনের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রয়েছে, সবই বিদ্যমান রয়েছে। সরকারের মধ্যেও এ নিয়ে তেমন উদ্বেগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না। সরকার ব্যস্ত তার বড় বড় মেগা প্রজেক্ট নিয়ে। যেগুলো শুধু স্থাপত্য শিল্পেরই মর্যাদা পাবে, অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা থাকবে নগণ্য। কারণ বিনিয়োগের অভাবে শিল্প-কারখানাই যদি গড়ে না ওঠে এবং প্রতিষ্ঠিত একটি শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে এসব ব্রিজ-ফ্লাইওভার দিয়ে কী হবে! এগুলোর মাধ্যমে কেবল এক স্থান থেকে আরেক স্থানে মানুষের দৌড়াদৌড়ির উন্নয়ন হবে, অর্থনীতির উন্নয়ন পেছনেই পড়ে থাকবে। এগুলো তখনই বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে, যখন বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে, পণ্য উৎপাদন হবে এবং উৎপাদিত পণ্য দ্রুত পৌঁছানোর দরকার হবে। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা শুধু গার্মেন্ট খাতকেই আঘাত করেনি, বাংলাদেশের আরেকটি বৃহৎ খাত জনশক্তি রপ্তানিতেও বড় আঘাত করেছে। এমনিতেই বিগত বছরগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। সন্ত্রাসী হামলায় যে তা আরও তলানীতে এসে ঠেকবে, তা ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হয় এবং এখানে জঙ্গি রয়েছে, এ বার্তা বিশ্বে পৌঁছে গেছে। ফলে বাংলাদেশের জনশক্তির প্রধান বাজারসহ উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশিদের যে বক্র দৃষ্টিতে দেখবে এবং তাদের প্রতি এক ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি করবে তাতে সন্দেহ নেই। গুলশানে সন্ত্রাসী হামলায় ইতালীয় নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে ইতালিতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের ওপর গিয়েও পড়েছে। জানা যায়, ইতালিতে যেসব বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট বা অন্য কোনো দোকান রয়েছে, সেসব দোকানে ইতালি নাগরিকরা যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। তারা সরাসরিই বলছে, তোমাদের দেশে জঙ্গি রয়েছে এবং আমাদের নাগরিকদের হত্যা করেছে। কাজেই তোমাদের দোকানে ঢুকব না। এর আগে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ঘটনায় আমরা দেখেছি, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার নাগরিকরা বাংলাদেশের পণ্য বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল। তারা বলেছিল, বাংলাদেশের পোশাকে শ্রমিকের রক্তের দাগ লেগে আছে। কাজেই একের পর এক ঘটনায় ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি বাণিজ্য যে হুমকির মুখে পড়ছে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে, তা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। ব্যবসা-বাণিজ্যই নয়, বিদেশি মেহমান বা পর্যটক আসাও আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এসব ঘটনা কি দেশের অর্থনীতি ও ভাবমর্যাদা বৃদ্ধির পরিচায়ক? অথচ সরকার ক্রমাগত বলে চলেছে, বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল হয়েছে। কীভাবে এবং কিসের ভিত্তিতে হচ্ছে, তার সুনির্দিষ্ট এবং সঠিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। কিছু গৎবাঁধা বুলিই কেবল আউড়িয়ে যেতে দেখা যায়। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে, সামাজিক সূচক উন্নতির দিকে, দ্রুতই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছিÑ ইত্যকার কমন বুলি দেশের মানুষ শুনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ এগুলো বুঝুক বা না বুঝুক তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ তাদের অবস্থা তাদের চেয়ে ভালো তো আর সরকার জানে না। তাছাড়া অর্থনীতিবিদরা তো বলছেনই, এসব কথার মধ্যে বিরাট শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে।
চার.
একজন সাধারণ মানুষও জানে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা দেশের ভাবমর্যাদাকে চরমভাবে বিনষ্ট করেছে। মানুষকে আতঙ্ক আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। এ থেকে কীভাবে এবং কী পদক্ষেপ নিলে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব, তার কোনো কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার এক ধরনের বেড়াজালের মধ্যে আটকে গেছে। অর্থনৈতিক অবনতি সামলাবে না নিরাপত্তা-অবনতি ঠেকাবে। তার ওপর জঙ্গিবাদের অপবাদ তো রয়েছেই। এই ত্রিশঙ্কু অবস্থায় দেশের মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস অপরিহার্য হলেও সরকার অনেকটা একগুঁয়েমি মনোভাব দেখিয়ে নিজের মতো চলছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দিয়ে মানববন্ধন, সভা-সেমিনারসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দিচ্ছে। এসবই সরকারের দলীয় ব্যানারে হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় ইস্যু নিয়ে দলীয় ব্যানারে কর্মসূচি নেয়া যেতেই পারে, তবে দেখার বিষয় হচ্ছে, সেখানে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ রয়েছে কিনা। আমরা দেখছি, সরকার সমর্থিত লোকজন দিয়েই দেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে। সাধারণত জাতীয় ইস্যুতে দলীয় কর্মসূচি দেয়া হলে, সেখানে দলের নেতা-কর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষের উপস্থিতি খুব কম থাকে। আর দলটি যদি হয় সরকারি এবং সরকার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটে নির্বাচিত নয়, এমন বাস্তবতা থাকে তাহলে সেখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকে না বললেই চলে। নোটিশ বা নির্দেশ দিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে আনা যেতে পারে, তবে তা কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়। ফলে জাতীয় ইস্যুতে শুধু সরকার দলীয় এ ধরনের কর্মসূচি দিয়ে সব মানুষকে একই ছাতার নিচে নিয়ে আসা অন্তত আমাদের দেশে সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি, সরকার এ পর্যন্ত অনেক কিছুই ধমক দিয়ে করেছে। সরকারের ধমকে মানুষও ভয় পেয়েছে। তবে সবসময় যে ধমকে কাজ হয় না, তা দেশের বর্তমান আতঙ্কজনক পরিস্থিতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সরকার ধমক দিয়েও আতঙ্কবাদীদের নিবৃত্ত এবং জনমনে সৃষ্ট আতঙ্ক দূর করতে পারছে না। প্রায় সর্বত্রই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি ও রাজনীতি এক চরম সংকটের মধ্য দিয়ে আবর্তিত হচ্ছে। যেন এক ধরনের খেলা চলছে। এ খেলা অনেকটা মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো। এক চেয়ার থেকে আরেক চেয়ারের দিকে ছুটে যাওয়া। আমরা মনে করি, দেশের মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক ভর করেছে, তার দ্রুত অবসানে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কীভাবে নেবে তা সরকারের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। সরকারকে একদিকে দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও আতঙ্ক দূর করতে হবে।

darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Hafiz ২৯ জুলাই, ২০১৬, ১২:৪৬ পিএম says : 0
Allah e valo jane
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন