শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

পাকিস্তানি ‘দাস’রা পেল দ্বিতীয় জীবন

এএফপি | প্রকাশের সময় : ২৮ জুন, ২০২০, ১২:০০ এএম

ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত পাকিস্তানিরা ওশান ভাইকিং নামের উদ্ধারকারী যানের ডেক থেকে পেছনের দিকে তাকিয়ে ফেলে আসা লিবিয়ার উপকূল দেখার চেষ্টা করছিল। তারা পেছনে ফেলে এসেছে নির্যাতন, দুর্ব্যবহার এবং অপহরণের দুঃস্বপ্ন।
এসওএস ভূমধ্যসাগরীয় অ্যাম্বুলেন্স নৌকা যোগে বৃহস্পতিবার অভিযানের সময় ইতালীয় দ্বীপ ল্যাম্পেডুসা থেকে কাঠের নৌকোটিকে উদ্ধার করা হয়। এতে থাকা ৫১ অভিবাসীর মধ্যে ৩১ পাকিস্তানির অন্যতম ইমরান বলেছিলেন, ‘তাদের কাছে আমরা মানুষ নই’।

‘লিবিয়ায় যাওয়ার পর থেকে এখানকার সমস্ত পাকিস্তানী বন্দি ছিল’- এক বছর পরে সেখানে আটকা পড়ে উত্তর আফ্রিকার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া ৩০ বছর বয়সী এই রাজমিস্ত্রী বলছিলেন। ‘আমরা সবাই অপহরণের শিকার হয়েছিলাম। আমরা কাজ করতে এসেছি, কিন্তু আমরা যা পেয়েছি তা হ’ল যুদ্ধ, নির্যাতন ও চাঁদাবাজি। ‘কৃষ্ণাঙ্গদের অবস্থাও প্রায় আমাদেরই মতো, তবে বাংলাদেশি, পাকিস্তানিরাই তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়’।

দুবাই হয়ে ত্রিপোলির কাছে নির্মাণ কাজে আসা ইমরানের মতো সবাই মারধর ও অপহরণের গল্প বলেছিলেন। তার ওপর নির্যাতন শুরু হয় ‘বিমানবন্দর থেকেই’।
তিনি বলছিলেন, ‘আমাকে এমন একজনের কাছে বিক্রি করা হয়, যে আমাকে তালাবদ্ধ করে রেখেছিল। আমাদের ৩৫, ৪০ জনকে একেকটি ঘরে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিল এবং আমাদের বাইরে যেতে দেয়া হয়নি’। তারপরে তিনি আমাকে অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেন। সেও আমাকে তালাবদ্ধ করে রেখেছিল। প্রতি মুহূর্তে মনে হত যেন আমি একজন দাস। তারা আপনাকে খাওয়ার জন্য এতটুকু খাবার দিত যাতে আপনি বেঁচে থাকেন, তার বেশি না’ -বলছিলেন নাদিম (৩৫), যিনি ‘পালাতে’ পেরেও পুলিশে যাওয়ার ‘ভুল’ করেছিলেন।
তিনি বলছিলেন, ‘পুলিশ আমাকে অপহরণকারীদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায় যা ছিল আরও খারাপ। লিবিয়ায় আমাদের সাহায্য করতে পারেন এমন কোন ব্যক্তি ছিলেন না। আমি পুরো দেশটিতে একজন ভাল মানুষও পাইনি’।

নীল ঐতিহ্যবাহী শালওয়ার কামিজ পরিহিত মোহাম্মদ আরশাদ কীভাবে বন্দরনগরী খোমসে দু’বছর কাটিয়েছিলেন এবং মুক্তিপণের ব্যবস্থা করেছিলেন তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘তারা দল বেঁধে আসে। ‘তারা আপনাকে যে কোনও জায়গায়, কাজের জায়গায়, রাস্তায় ধরতে পারে, তারা আপনার সাথে প্রতারণা করে। তারা আপনাকে আঘাত করে এবং আপনার বাবা-মাকে ডেকে বলে, ‘তুমি যদি টাকা না দাও তবে সে মারা যাবে’। তার বাবাকে আত্মীয়দের কাছ থেকে ১০ হাজার ডলার ঋণ নিতে হয়েছে।
‘ডুবে যাওয়া ভাল’
মুখোশের নিচ দিয়ে দীর্ঘ দাড়ি বেরিয়ে থাকা আরসালান আহমেদ বলছিলেন, ‘যদি আমরা অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা না করি, তবে তারা একটি রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করবে। এছাড়াও বৈদ্যুতিক শক রয়েছে। অন্যথায় আমরা কয়েক দিন ধরে অনাহারে থাকব এবং যদি আমরা পানি চাই তবে তা দেয় টয়লেট থেকে’। ২৪ বছরের এ যুবক বলেছিলেন, ‘আমি যে নির্যাতন, যে যাতনা সহ্য করেছি, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।
লিবিয়া ছেড়ে যাওয়া পাকিস্তানি নাগরিকদের এ সংখ্যা অস্বাভাবিক। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই-কমিশনারের মতে, পারাপারের চেষ্টা করা পাকিস্তানিরা সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষ দশেও নেই। তালিকার শীর্ষে রয়েছে সুদানিরা, তারপরেই বাংলাদেশিরা।

আরসালান আহমদ লিবিয়ায় ছিলেন মাত্র সাত বা আট মাস। এরপর তিনি জোউরা থেকে নৌকায় করে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দীর্ঘ সময়ের নিরবতা ভেঙে তিনি নিচু স্বরে বলেছিলেন, ‘এখানে ভূমধ্যসাগরে আমরা মাত্র একবার মরে যেতে পারি। লিবিয়ায় আমরা প্রতিদিন মারা যাই’।
তারা বলেন, তারা দেশের বাইরে যাবার টিকিট কিনতে ‘সর্বোচ্চ’ ২ হাজার ডলার দিয়েছেন। নাদিম বলেছিলেন, ‘আমরা জেনে-বুঝেই নৌকায় উঠেছি। তবে মৃত্যু, আমরা ইতোমধ্যে এটি খুব কাছে থেকে দেখেছি’। ‘সমুদ্র বিপজ্জনক, তবে লিবিয়ায় থাকার চেয়ে ডুবে যাওয়া ভাল’।

নাদিমের মতে, ওশান ভাইকিং তাদের উদ্ধার করে ইউরোপে ‘দ্বিতীয় জীবন’ উপহার দিয়েছে। ৪০ বছর বয়সী মুদাসসার গালিব বলছিলেন, ‘এটি আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন’। তারা সকলেই এ নিশ্চয়তা চায় যে, নৌকাটি তাদের আবার লিবিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না। আশ্বাস পেয়ে তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে, এ ‘দ্বিতীয় জীবন’ কোথায় উদযাপন করতে পারে, মাল্টায়, ইতালি বা ফ্রান্সে?
ইমরান বলছিলেন, ‘আসলে এতে কিছু যায় আসে না। আমি নিশ্চিত যে, ইউরোপে কেউ আমাদের নির্যাতন করবে না’।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন