আবদুল ওয়াজেদ কচি, সাতক্ষীরা থেকে
নাজমা খাতুন। স্বামী ও দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন সাতক্ষীরা পৌরসভার ইটাগাছা পশ্চিমপাড়ার একটি খাস জমিতে। ভ্যানচালক স্বামীর একার আয়ে সংসার চলে না। তার উপর আবার দুই ছেলের পড়াশুনার খরচ চালাতে হয়। ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে পাটজাত পণ্য তৈরির কাজ শেখেন নাজমা। তৈরি করতে থাকেন পাটের ব্যাগ, পাপোষ, ওয়ালম্যাটসহ নানা পণ্য। নাজমার মতো পৌরসভার বাগানবাড়ি এলাকার সাহেলা খাতুন, সাহাপাড়ার জাহানারা খাতুন, সুলতানপুর সরকারপাড়ার ফারজানা ইয়াসমিনরাও তৈরি করেন পাটজাত পণ্য। আর নাজমা খাতুন, জাহানারা খাতুন, সাহেলা খাতুনদের হাতের ছোয়ায় তৈরি এসব পণ্য মানে ও গুণে অনন্য হওয়ায় রপ্তানি হচ্ছে ইতালি-জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। একই সাথে বিভিন্ন পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে সাতক্ষীরার দরিদ্র নারীরা। তবে, সব সময় যে ভাল যায়, তা নয়। উন্নতমানের তোষা পাট অর্থাৎ কাঁচামালের সংকট, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং বায়ারদের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের অভাবে সাতক্ষীরায় উৎপাদিত রপ্তানিযোগ্য পাটজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক অর্ডার দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টদের মতে, এখনই উদ্যোগ নিয়ে এ খাতে বিদ্যমান সমস্যা দূর করা সম্ভব হলে পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে সাতক্ষীরায় বিপ্লব ঘটতে পারে। জানা গেছে, জেলার কলোরোয়া, তালা ও সদর উপজেলার সহস্রাধিক নারী মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করেন পাটের উন্নতমানের ব্যাগ, ওয়ালম্যাট, পাপোষ, শো’পিস, দরজা-জানালার পর্দাসহ আকর্ষণীয় নানা পণ্য। প্রতিপিস পণ্য উৎপাদনে আড়াইশ’ থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত পারিশ্রামিক পান তারা। সাতক্ষীরা পৌরসভার ইটাগাছা পশ্চিমপাড়ার ভ্যানচালক জাকির হোসেনের স্ত্রী নাজমা খাতুন জানান, প্রতিপিস ব্যাগ তৈরি করে তিনি সর্বনি¤œ আড়াইশ টাকা মজুরী পান। ব্যাগের সাইজ ভেদে মজুরী কম-বেশি হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, পণ্য ভেদে পাঁচশ’, এক হাজার, তিন হাজার টাকাও মজুরী রয়েছে। তিনি বলেন, সংসারের কাজের ফাঁকে তিনি পাটের বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন। তবে, ঘর ছোট বলে তিনি বড় কাজের অর্ডার নিতে পারেন না। পাটের সুতা বোনেন বাগানবাড়ির সালেহা খাতুন। প্রতি হাজার সুতায় আড়াইশ টাকা মজুরী পান তিনি। এতে ভালোই চলছে তার। তবে, পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে বিদ্যমান নানা সমস্যা-সম্ভাবনার কথা জানালেন তরুণ উদ্যোক্তা, বুনন উন্নয়ন সংস্থার কর্ণধার মামুন হাসান। তিনি বলেন, সাড়ে তিনশ’ নারীকে দিয়ে তিনি পাটের বিভিন্ন পণ্য তৈরি করিয়ে নেন। এজন্য কাজ অনুযায়ী পারিশ্রামিক প্রদান করা হয়। তিনি জানান, পাটজাত পণ্য উৎপাদনে ভালমানের তোষা বা সাদা পাট প্রয়োজন হয়। কিন্তু তোষা পাটের সংকট লেগেই থাকে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করলে পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে সম্ভাবনার দ্বার খুলে যেতে পারে। পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক বায়ারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা সবচেয়ে বড় সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইতালি, জার্মানি, লন্ডন, ইউএসএসহ বেশ কয়েকটি দেশে পাটজাত পণ্য রপ্তানি করতেন তিনি। কিন্তু ২০১৪ সালে টানা ৯০ দিনের হরতাল-অবরোধে সময় মতো মাল সরবরাহ করতে না পারায় বায়াররা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এতে বেশ ক্ষতি হয় তার। তিনি বলেন, পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক বায়ারদের সাথে যোগযোগ রক্ষা ও বাজার সম্প্রসারণে সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। এতে উৎপাদনকারীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, তেমনি মধস্বত্বভোগীরাও মুনাফা তুলে নেয়ার সুযোগ পাবে না। একই সাথে উৎপাদনকারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আন্তর্জাতিক বায়ারদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিভিন্ন ধরনের মেলার আয়োজন করতে পারলে বাজার সম্প্রসারণ হতে পারে। এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা পাট অধিদপ্তরের পরিদর্শক আশীষ কুমার দাস বলেন, পাট শিল্পের বিকাশে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এতে এ খাতের সমস্যা সমূহ দ্রুত দূর করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন