ইফতেখার আহমেদ টিপু
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি কি মুছে যাবে? এ প্রশ্নটি এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব পরিসরেই জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে এখন বাঘের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ১০৬টি। বিশ্বের বৃহত্তম এ বাদাবনের বাংলাদেশ-ভারত দুই অংশ মিলে বাঘের সংখ্যা ১৭০টি।
গত বছর ক্যামেরা পদ্ধতিতে পরিচালিত সুন্দরবনের বাঘ গণনা জরিপ-২০১৫ এর ফলাফলে বাঘের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ার যে ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট হয়েছে তা উদ্বেগজনক। এর আগে ২০০৪ সালে বনবিভাগ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির সহায়তায় বাঘ জরিপ করেছিল এবং পায়ের ছাপ গুনে করা সে জরিপে সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
গত বছর করা জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের জরিপটি যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ও আন্তর্জাতিকমান বজায় রেখে করা হয়নি। জরিপ পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সুন্দরবনে যে আশঙ্কাজনকহারে বাঘের সংখ্যা কমছে তা এক মহাসত্য। ২০০৬ সালে ব্রিটিশ জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির সহায়তায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান ক্যামেরায় ছবি তুলে যে জরিপ করেন তাতে বাঘের সংখ্যা ছিল ২০০টি। সুন্দরবনের বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশের মধ্যে বাংলাদেশ অংশ বাঘের খাদ্য ও বিচরণের জন্য বেশি উপযুক্ত। কারণ ভারতীয় অংশের নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি। বাঘের প্রধান খাবার হরিণের সংখ্যাও কম। কিন্তু ভারতীয় বাঘ বিচরণকারী এলাকায় প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে চারটি বাঘ থাকলেও বাংলাদেশে এ সংখ্যা মাত্র দুটি। বাংলাদেশ অংশে বাঘের যে অস্তিত্ব বেশি বিপন্ন এটি তারই ইঙ্গিত দেয়।
সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে চোরা শিকারিদের তৎপরতা, সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীতে যান্ত্রিক নৌযান চলাচল বাঘের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ। প্রতিবেশী ভারতে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাঘের সংখ্যা ৩০ শতাংশ বেড়েছে। বাঘ রক্ষায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে। বাঘ দেশের জাতীয় প্রাণী, জাতীয় ক্রিকেট দলের লোগোতেও রয়েছে বাঘের ব্যবহার। এ অহঙ্কার ধরে রাখতে হলে বাঘ রক্ষার উদ্যোগ জোরদার করতেই হবে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বলে বিবেচিত সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণœ রাখতে বাঘ রক্ষায় যতœবান হতেই হবে।
যতগুলো কারণে সুন্দরবনে বাঘের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে তার মধ্যে চোরা শিকার অন্যতম। পরিবেশগত প্রতিকূলতায় বাঘের অস্তিত্ব যে হারে বিপন্ন হয়েছে সেটাকে অনেকগুণ বেশি ত্বরান্বিত করেছে চোরা শিকারের ঘটনা। বহু বছর ধরেই বাঘ চোরা শিকার হচ্ছে। গত বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৯টি মৃত বাঘের চামড়া আটক হয়েছে। এই হারে যদি বাঘ শিকার হয় তবে আগামী এক দশকেই সুন্দরবন বাঘশূন্য হয়ে পড়বে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেসব সময় বাঘ শিকারিদের ধরতে বা শিকার হওয়া বাঘের হাড়-চামড়া উদ্ধার করতে পারে তা নয়।
এই বিষয়টি হিসাবে আনলে বলতে হয়, সুন্দরবনে অবশিষ্ট ১০৬টি বাঘ বিলুপ্ত হতে এক দশক সময়ও হয়তো লাগবে না। কোন সন্দেহ নেই যে, সুন্দরবনের বাঘ রক্ষা করতে হলে কঠোরভাবে বাঘ শিকার বন্ধ করতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, বাঘ শিকারিরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালীদের মদত পায়। বাঘ শিকারির মদতদাতাদের বিরুদ্ধে এ কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বাঘ রক্ষার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। বাঘ রক্ষার কাজে স্থানীয় অধিবাসীদের যুক্ত করলে সুফল মিলতে পারে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভারতকে যুক্ত করা যায় কিনা সেটাও বিবেচনা করে দেখতে হবে। কারণ সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য একটি অংশই ভারতের অন্তর্ভুক্ত। এ দুই দেশ একযোগে কাজ করলে চোরা শিকারিদের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা কঠিন হবে না। বাঘের অস্তিত্ব আরও অনেক কারণেই বিপন্ন হচ্ছে। যে শ্যালা নদীর ওপর লঞ্চে ভেসে ভেসে বাঘ রক্ষার সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে সেই শ্যালা নদীকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। শ্যালা নদী দিয়ে এখনও জাহাজ চলাচল করছে। নদীটি রক্ষা করার সব আবেদন উপেক্ষা করা হয়েছে।
এক সময় দেশের সব বনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা যেত। কিন্তু ক্রমাগত বন উজাড়ও বাঘ নিধনের ফলে সুন্দরবন ছাড়া আর কোথাও রয়েল দেখা যায় না। বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় বাঘ বর্তমানে এক নাম্বারে। সুন্দরবনই হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আশ্রয়স্থল। সুন্দরবনে বাঘ বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা যাবে না, প্রাণীকুল রক্ষা পাবে না। সুন্দরবন রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থায় প্রাণী হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন প্রাণী নিয়ন্ত্রণে বাঘ ও পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সুন্দরবনের বাঘ কমে গেলে সুন্দরবন বিপন্ন হয়ে পড়বে। সুন্দবনের ওপর মানুষের চাপ বাড়বে নির্বিচারে লুণ্ঠন ও নিধনযজ্ঞ শুরু হবে। সুন্দরবনকে রক্ষা ও বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বাঘ সংরক্ষণ একান্ত প্রয়োজন।
ষ লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন