শরীফুর রহমান আদিল
প্রতি বছর আমাদের দেশে বর্ষাকাল এলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বন্যা দেখা দেয়। এমন হয়ে গিয়েছে যে দেশে বৃষ্টিপাত হোক আর না হোক বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে বন্যা অপরিহার্য। কেননা পানির প্রক্রিয়া, জলবায়ুর প্রভাব আর ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে বন্যাপ্রবণ দেশ। আর এ কারণেই পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ আর বন্যা এই দুটি শব্দকে সমার্থক মনে করেন। বাংলাদেশ ভাটির দেশ হওয়ায় তারা এমনটি মনে করেন। তবে এইবার অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা হওযার চেয়ে ভারতের উজানের পানিই এই বন্যার জন্য দায়ী বলে অনেকেই মনে করেন। এই উজানের পানির ফলে উত্তরাঞ্চলসহ অনেক স্থানে এর প্রভাব লক্ষ করা গেছে। এইবারের পাহাড়ি ঢল আর ভারতের উজানের পানির প্রভাব এতই বেশি যে প্রতিদিনই নিত্যনতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে আর পানিবন্দি হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। এসব মানুষেরা তাদের বসতবাড়ি আর সম্পদ হারিয়ে তারা আশ্রয় নিচ্ছে বাঁধের উপর উঁচু স্থানে কিংবা খোলা আকাশের নিচে কোন সড়কের পাশে। সবকিছু হারিয়ে এসব বানভাসি মানুষ এখন অসহায় হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। গত এক সপ্তাহ পানির প্রভাব বাড়ছে আর একেকটি করে বাঁধ ভাঙছে। পানির নিচে ডুবে গেছে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ, পানির প্রভাব এতই যে দেখে বুঝা যায় না যে কোনটি সড়ক কিংবা জলাধর। পানির কারণে মানুষ তাদের ঘরের চালেও আশ্রয় নেওয়ার কোন সুযোগ পাচ্ছে না। এইসব বানভাসি মানুষদের টিউবওয়েল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় তারা বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে আর এর প্রভাবে শিশু বৃদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন জটিল রোগে। একদিকে রোগ আর অন্যদিকে বন্যা এই দুয়ে এইসব অঞ্চলের মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে তবুও আমাদের উপলব্ধি হয় না।
গত কয়েকদিনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে পানির এতই প্রভাব যে এখানে পানিতে ভেসে গেছে ৩ শিশুর লাশ আর নিখোঁজ রয়েছে আরো দুই জন। বিশেষ করে খুলনা, শেরপুর, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, ফেনী, বান্দরবান, বগুড়া, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, নেত্রকোনা, নীলফামারী, গাইবান্ধা হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জসহ দেশের প্রায় ২৫-৩০টি জেলার বন্যা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। এতে করে এসব এলাকার প্রায় ৪০ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে নারী-শিশুদের অবস্থা বেশ যন্ত্রণাদায়ক। এসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে খুলনায় ২২ হাজার ৫০০ দশমিক ২৮৮ হেক্টর ফসলি জমি, মাছের ঘের, পুকুর, বীজতলার শাকসবজি প্রভৃতি নষ্ট হয়েছে যার আনুমানিক অর্থমূল্য ১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সর্বমোট এ বছর বন্যায় ক্ষতি হতে পারে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় তার চাইতে বেশি ক্ষতি হয় প্রতি বছর সৃষ্ট বন্যায়। সুতরাং বন্যা নিয়ন্ত্রণে এবং এ ধরনের ক্ষতি এড়াতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার উপর বিশেষজ্ঞরা জোর তাগিদ দিচ্ছেন। দেশে জঙ্গিবাদ ইস্যুতে সবাইর মাথাব্যথ্যা তাই এইসব অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ বন্যার্ত মানুষের দিকে খবর রাখার কোন সময় নেই নীতিনির্ধারকদের। তা নাহলে প্রতি বছর কেন এইসব অঞ্চলের লোকদের এই দুর্ভোগ পোহাতে হয়? প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে মানুষের কোন হাত নেই কিন্তু কৃত্রিম সৃষ্টি করে এইসব মানুষদের কষ্ট দিলেও সরকার তা সমাধানে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না কেন?
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো এ বন্যা শুধু বাংলাদেশে নয় বরং ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও এ ধরনের বন্যা বিদ্যমান। আমাদের মনে রাখতে হবে উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হলো গবাদি পশু কিন্তু বন্যার কারণে তারা তাদের গবাদি পশুকে খাদ্য খাওয়াতে পারছে না। জানি না এর প্রভাব আগামী কুরবানীর ঈদে কোন প্রভাব ফেলবে কিনা?
বাংলাদেশে যে কোন সমস্যা দেখলেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দেশ আমাদের দেশকে সাহায্য করার জন্য সাথে সাথে ছুটে আসে কিন্তু বন্যার্ত মানুষের উন্নয়নে কেবল মাত্র স্বল্প মেয়াদে ত্রাণ ছাড়া সেরকম কিছু কখনো লক্ষ করা যায়নি। মানবাধাধিকার কর্মীদের করা অভিযোগ কি তাহলে সত্যি? মানবাধিকার কর্মীরা প্রতিবেশী ভারতের বিষোদ্গার করে তাদের নদী ও পানি নীতিতে কঠোর অবস্থানের কারণে। অথচ সমস্ত বিশ্ব যে কোন সন্ত্রাসী হামলার যে কোন বিষয় এলে সবাই সাথে আছে বলে মুখ চালায়, তবে মানবতার এ কাজে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্থায়ী কোন সমাধানে সাহায্য করছে না কেন? তার মানে সাহায্য কেবল সামরিক ক্ষেত্রে? মানবতার ক্ষেত্রে নয়? সাম্রাজ্যবাদীদের এই সাহায্য যে আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার জন্য তা নিশ্চয় সবার নিকট পরিষ্কার। এইসব অঞ্চলের মানুষের জন্য স্থায়ী কোন সমাধান কি আমরা করতে পারি না? আমরা আমাদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো কাজ করতে পারছি কিন্তু এইসব অঞ্চলের লোকদের জন্য আমরা কেন সাময়িক বাঁধ নির্মাণ করে আমাদের দায় এড়াচ্ছি?
সরকার গত ৭ বছরে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত করেছে এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই কিন্তু এইসব অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে নদ-নদীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি যা সত্যিই দুঃখজনক।
অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একই ধরনের বন্যার সৃষ্টি হলে সে দেশের সরকার ব্যাপকভাবে ত্রাণ কার্য পরিচালনা করছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকতারা বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নিজে করে এরপর সরকারি-বেসরকারি সংস্থাদের উপর একধরনের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার এমনকি কোন এমপি-মন্ত্রী এসব বানভাসি মানুষের খবর নিতে অথবা পরিস্থিতি অবলোকন করতে এখন পর্যন্ত বন্যাকবলিত মানুষের কাছে গিয়েছেন এটি দেখা যায়নি। আমাদের মনে রাখতে হবে, এরা বাংলাদেশের নাগরিক সুতরাং একজন নাগরিক হিসেবে তার যে অধিকার রয়েছে তা থেকে সে বঞ্চিত হবে কেন? বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে ও তারা বাংলাদেশের সরকার, এনজিও আর জনগণ থেকে সহায়তা পাবে না এ কেমন কথা! সরকারের উচিত এদের দুঃখ-কষ্ট লাগবে যা যা করণীয় সবই করা। প্রথমত এদের ত্রাণের ব্যবস্থা করতে হবে যদিও ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলে এক এড়িয়ে দেওয়া যাবে না আমরা মনে করি সরকার যে পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করছে তা সত্যিই অপ্রতুল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় একটি গ্রামে বর্ন্যাত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার এবং এরা পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে পাঁচ দিন কিন্তু ত্রাণের সাহায্য এসেছে মাত্র ১০০ কেজি চাল! এ ধরনের ত্রাণ সত্যিই অপ্রতুল। আমাদের মনে আক্ষেপের প্রশ্ন জাগে এই বলে যে এরা কি ন্যূনতম প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-এমপিদের পক্ষ থেকে সান্ত¡নাও পেতে পারে না? আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের এসব বন্যার স্থায়ী কোন সমাধান না হলে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে সর্বোপরি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এরা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। আবার বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পৃর্ণ হতে হলে অবশ্যই এসব এলাকার বীজ, ক্ষেত-খামার ও ফসলি জমি প্রভৃতিকে রক্ষা করতে হবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে প্রতি বছর বাংলাদেশে বন্যায় ফসলি জমি প্রায় ১৯০ কিলোমিটার জমি পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদীতে চলে যায়।
মনে প্রশ্ন জাগে উত্তরবঙ্গসহ এসব অঞ্চলের মানুষগুলো শুধুই কি কষ্ট আর যন্ত্রণা সহ্য করবে? শুধুই কি বারবার এ ধরনের কষ্ট সহ্য করবে আর আমাদের তরফ থেকে সাহায্য আর সহানুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকবে! তাদের জন্য স্থায়ী কোন সমাধান কি কখনো হবে না? এসব মানুষদের জন্য আমাদের কি কোনই দায়বদ্ধতা নেই। নাকি তারা উত্তর বঙ্গে জন্মগ্রহণ করাই কি অপরাধ! বন্যার স্থায়ী নিয়ন্ত্রণে এবং বন্যার্ত মানুষের কল্যাণে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া বেশ জরুরি। যেমন- ১. বন্যা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করার প্রকল্প হাতে নেওয়া। ২. বন্যার্ত মানুষের নিকট পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সরকার নয় চাই বেসরকারি সংস্থা এবং বিত্তশালী লোকদের সহায়তা। ৩. যেহেতু বন্যা প্রতি বছরই আমাদের দেশের কোন না কোন অঞ্চলে আঘাত হানে তবে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা বরাবরই পানিতে তলিয়ে যায়; সুতারং বন্যাকবলিত বানভাসি মানুষের জন্য একটি সার্বজনীন ফান্ড গঠন করতে হবে। ৪. বন্যা দুর্গত এসব এলাকার মানুষের জন্য নষ্ট হওয়া সড়ক-মহাসড়ক বা যোগাযোগ ব্যবস্থা মেরামতের কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হাতে নেওয়া। ৫. ভারতের সাথে পানির ন্যায্য হিস্যার বণ্টন চুক্তি করা অন্যথায় আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হওয়া। ৬. বন্যা পরবর্তী বিভিন্ন ধরনের অসুখ মোকাবেলার জন্য আগাম ব্যবস্থা নেয়া। ৭. বন্যা পরবর্তী সময়ে কৃষকদের জন্য বীজ ও প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করা। ৮. বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব কৃষকদের ব্যাংক লোন মওকুপের ব্যবস্থা করা। কেননা যাদের ঘরবাড়ি, ক্ষেত- খামার, গৃহপালিত পশু, মাছের ঘের আর ফসলি জমি সবই হারিয়ে তারা এখন অসহায় তারা কিভাবে এসব ব্যাংকের বকেয়া পরিশোধের অবস্থান কোথায়? ৯. অত্যাধিক ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের তাদের ফসলি জমির ক্ষতির জন্য কিছু ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। ১০. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের টেকসই পরিকল্পনা হাত নেওয়া। ১১. জলাশয় ও পাহাড় সংরক্ষণ আইন আরো কঠোর করা। ১২. অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। ১৩. বাংলাদেশের প্রতিটি নদী-খাল-বিল প্রভৃতিকে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া। কেননা এমনও দেখা গেছে সড়ক পথের উপর জোর দেওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে বয়ে যাওয়া খাল-বিল, নদী-নালা প্রভৃতিতে বাঁধ দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। ১৪. যতই ব্যয়বহুল হোক প্রতি বছর নদী খনন করার কাজ হাতে নেওয়া। কেননা প্রতি চার বছরে বন্যায় যে পরিমাণ ক্ষতি হয় তার চেয়ে নদী খনন করতে এর চেয়ে কম ব্যয়ই হবে। ১৫. পলি মাটি নিঃসরণের কাজ হাতে নেওয়া। ১৬. উপদ্রুত এলাকাগুলোর মানুষদের দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ১৭. প্রযোজণীয় এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা। ১৮. বন্যার সময় বন্যাকবলিত মানুষ যাতে করে সুপেয় পানির কষ্ট না করতে হয়ে সে দিকে লক্ষ রেখে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা। ১৯. সর্বোপরি এসব বানভাসি মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থার দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।
ষ লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ফেনী সাউথ-ইস্ট ডিগ্রী কলেজ, ফেনী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন