জামালউদ্দিন বারী
দেশের উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার মানুষ ভয়াবহ বন্যায় বানভাসি মানুষে পরিণত হয়েছে। উজানের ঢলে বাড়িঘর, ক্ষেতের ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর এখন লাখ লাখ মানুষ ঘরের চালে, নৌকা-কলাগাছের ভেলা অথবা বেড়িবাঁধ ও উঁচু রাস্তার ওপর আশ্রয় নিয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহের ক্রমাবনতিশীল বন্যার শুরুতে সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণ তৎপরতা বা ত্রাণ পরিকল্পনা দেখা যায়নি। বন্যার তীব্র ¯্রােত ক্রমে স্ফীত ও ভয়াল রূপ নেয়ার পর সরকারের তরফ থেকে ত্রাণ তৎপরতার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এরই মধ্যে পানিবন্দি ও আশ্রয়হীন লাখ লাখ মানুষ সুপেয় পানি, খাদ্য ও জীবনরক্ষাকারী ওষুধের তীব্র সংকটে পড়েছে বলে জানা যায়। কয়েক দিন ধরে প্রতিদিনই ক্রমাবনতিশীল বন্যা পরিস্থিতির সচিত্র খবর প্রকাশিত হচ্ছে। অসহায় দরিদ্র নারীরা দুগ্ধপোষ্য শিশুদের কাঁধে নিয়ে বুক সমান পানি ডিঙিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করছে। পোল্ট্রি খামার, গৃহপালিত গবাদিপশু-ছাগল, ভেড়াগুলোও বিপন্ন অবস্থায় পতিত হয়েছে। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ জেলার পদ্মা-যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, সুরমা-কুশিয়ারা, বিধৌত অঞ্চল থেকে বন্যার পানি এখন মধ্য-নি¤œাঞ্চলে ধেয়ে আসতে শুরু করেছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে আরেকটি বড় বন্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদনদীর পানি বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা ক্রমে নি¤œমুখী হওয়ায় আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকাগুলো বন্যার শিকার হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, পাকা রাস্তা ও বহুতল বাড়িতে বসবাসকারী রাজধানীর বাসিন্দাদের কেউ কেউ হয়তো বন্যা নিয়ে একটু ফ্যান্টাসি বোধ করতে পারেন। তবে এই মুহূর্তে রাজধানীবাসী বন্যার চেয়ে অনেক বড় নিরাপত্তাহীনতা ও নাগরিক বিড়ম্বনার শিকার। জঙ্গিবিরোধী নানামুখী তৎপরতার আড়ালে বানভাসি লাখো মানুষের দুর্দশার দিকে চোখ ফেরানোর যেন কোনো ফুরসতই নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের। পুলিশ, র্যাব, বিজিবির পুরো শক্তি-সামর্থ্যই জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে নিয়োজিত। এনজিও, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং বিত্তশালী দানশীল ব্যক্তিরাও এখন আর আগের মতো ত্রাণ নিয়ে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসে না। উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় আইলা ও সিডরের কথা বাদ দিলে গত একযুগে বড় ধরনের বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি বাংলাদেশ। এই সময়ে দেশে কোটিপতির সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে, বেড়েছে মাথাপিছু আয় এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। কিন্তু এই মুহূর্তে বন্যার্ত মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে পাশে দাঁড়ানোর লোকের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। ১৯৮৮’র বন্যা, ১৯৯১ সালে উপকূলীয় ঝড়, ১৯৯৮ সালের বন্যায় মানুষের জন্য অনেক বেশি ত্রাণ তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে কোটিপতির সংখ্যা অনেক বেড়েছে, অর্থনৈতিকভাবে আমাদের রাষ্ট্রের সক্ষমতাও বেড়েছে। কিন্তু এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। গত সোমবার পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা গেল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের সক্ষম ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি খাবার ও ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। উত্তরের জেলাগুলোতে অনেক দুর্গম অঞ্চলের আটকেপড়া, বন্যাপীড়িত মানুষের মধ্যে এখন খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য হাহাকার চলছে। বন্যার্তদের মধ্যে ইতিমধ্যে অন্ততঃ ৪০ জনের মৃত্যু এবং ৩ হাজারের বেশি অসুস্থ্য হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রয়োজনের সময় নিজেদের সক্ষমতা অনুসারে আর্তমানুষের পাশে দাঁড়ানো মানুষের একটি স্বাভাবিক মানবিক দায়িত্ব ও দাবি। নিজেদের মানবিক চেতনা যদি আমাদের সেই দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ না করতে পারে আমাদের মানবিক দায়বোধ ও মানবিক সত্তার অস্তিত্বই বিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
১লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা পর সারা দেশে জঙ্গিবাদবিরোধী গণসচেতনতাও তৈরি হয়েছে। এদেশের মানুষ সব সময়ই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে অথবা স্বৈরশাসন থেকে জাতিকে মুক্ত করতে এ দেশের যুব সমাজ বার বার নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র ছিনিয়ে আনার অনন্য নজির স্থাপন করেছে। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে কোনো কোনো বিশেষ গোষ্ঠী সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় নিলেও বাংলাদেশের মুসলমানরা সর্বদা প্রকাশ্য, সাহসী নিয়মতান্ত্রিক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই নিজেদের অধিকার আদায় করে নেয়ার পন্থা গ্রহণ করেছে। সেই জাতির ললাটে এখন জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের দুর্নাম লেপ্টে দিতে চাইছে কারা? এটি এখন সর্বব্যাপী সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আন্তর্জাতিক ভাব-মর্যাদার জন্য বিপর্যয়কর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের তৈরি পোশাক রফতানি খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার অর্ডার বাতিল হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে রয়েছেন রফতানিকারকরা। জঙ্গিবাদ ঠেকাতে গুলশান-বনানীর হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ ব্যবসায়-বাণিজ্যে নানা ধরনের বিধি-নিষেধ ও বাড়তি নজরদারির আওতা বাড়ানো হচ্ছে। অনেক স্থাপনা সরিয়ে ফেলা বা বন্ধ করে দেয়ার কারণে শহরের অভিজাত এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছেÑ বিদেশি কূটনীতিকসহ বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত বিদেশিরা ব্যাপক হারে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এ কথা সবাই স্বীকার করছেন যে, জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির ভ্রান্ত পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে অযাচিত হস্তক্ষেপ, সামরিক আগ্রাসন ও রিজিম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একের পর এক বিশৃঙ্খল ও অরাজক অবস্থার জন্ম দিয়ে সেখানে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে। আল-কায়েদা, আইএস, লিবিয়ায় ও সিরিয়ায় বিদ্রোহী গ্রুপ সৃষ্টি এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য সরাসরি পশ্চিমারা দায়ী। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সীমা ছাড়িয়ে আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার পেছনেও বড় ধরনের ভূরাজনৈতিক খেলা কাজ করছে। গত দুই বছরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিবাদী হামলা ও টার্গেটেড কিলিংয়ের অন্তত ৬টির দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টেরোরিজম ওয়াচডগ সাইট ইন্টেলিজেন্স সেই দাবিকে সামনে রেখেই আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের সাথে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার ভার্চুয়াল তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা যতই জেএমবি, এবিটিসহ অভ্যন্তরীণ জঙ্গি গ্রুপগুলোর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করি না কেন, এখনো উপযুক্ত তদন্তপূর্বক বিশ্বাসযোগ্য প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরতে না পারায় এসব দাবি আস্থা অর্জন করতে পারছে না।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর এক মাসের মধ্যে কোনো জঙ্গিবাদী হামলার ঘটনা সংঘটিত হয়নি। তবে এরই মধ্যে গত ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে কথিত একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ৯ জঙ্গিকে হত্যা করেছে পুলিশের সোয়াত (স্পেশাল ওয়্যাপনস অ্যান্ড টেকটিক্স) টিম। এফবিআই এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক ওয়াটার ট্রেনিং একাডেমির বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সোয়াত টিমের অপরারেশন স্টর্ম-২৬-এ নিহত জঙ্গিরা একটি বড় ধরনের জঙ্গিবাদী হামলার পরিকল্পনা করছিল বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। গত এক মাসে দেশের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ডিপ্লোমেটিক জোন, সচিবালয়, মন্ত্রীদের বাড়ি, বিদেশি কূটনীতিক, বিদেশি নাগরিকসহ সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা ও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। সেই সাথে চলছে প্রতিটি টিভি চ্যানেলসহ সব গণমাধ্যমে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি। গত সোমবার দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যার যার অবস্থানে একযোগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেছে। সরকার তো বটেই বিএনপিসহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছে। তবে সরকার ও সরকারি দল তাদের রাজনৈতিক স্ট্রাটেজি অনুসরণ করে বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াতকেই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের দায়ে অভিযুক্ত করে রাজনৈতিক বক্তব্য অব্যাহত রেখেছে। সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বা জঙ্গিবাদ প্রশ্নে এক টেবিলে বসতে না পারলেও এসব প্রশ্নে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের জাতীয় ঐক্য ও গণসচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের এই ঐক্যই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণশক্তি এবং এগিয়ে চলার মূল পাথেয়। দলমত নিরপেক্ষ জনগণের এই সম্মিলিত শক্তি যে কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা স্বৈরাচারের মসনদ টলিয়ে দিতে পারে। তাদের ভুল পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যে কোনো সময় গর্জে উঠতে পারে। আমাদের ইতিহাসে এটা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। জনগণের ঐক্যবদ্ধ জঙ্গিবাদ বিরোধী অবস্থানের কারণেই এখানে আইএসের মতো কোনো বিদেশি মদদপুষ্ট জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী শেকড় গাড়তে ব্যর্থ হবে। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিরোধ ও দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক সমঝোতা ও আলোচনার মধ্য দিয়ে নিরসন করতে না পারলে এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণু ও নির্মূল করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার চেষ্টা করলে তা দেশে বিচ্ছিন্ন জঙ্গিবাদী নাশকতার চেয়েও বড় ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। একদিকে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের হুমকি, অন্যদিকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যকার অনৈক্য ও যুদ্ধংদেহি মনোভাব অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করে কারা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করে দিতে চায়, জাতি তা জানতে চায়।
হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশের সর্বত্র নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরি হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে জঙ্গিবাদবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়েছে মানুষ। তথাকথিত ধর্মীয় জঙ্গিবাদ, রাজনৈতিক সহিংসতা, চরমপন্থি সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকা-, ডাকাত দলের হামলা অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, যেভাবেই মানুষ হত্যা অথবা লাঞ্ছনার শিকার হোক না কেন, তা আইনের শাসন, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের মধ্যে এক ধরনের অসহায়ত্ব ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ জাগ্রত করে। সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপত্তাহীনতা ও হতাশার কারণে যুব সমাজের একটি অংশের মধ্যে মাদকাসক্তি, অপরাধ প্রবণতাসহ বেপরোয়া মনোভাব এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি করতে পারে। আত্মঘাতী জঙ্গিবাদীদের ইসলামের ভুল ব্যাখ্যায় উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগ আছে। তা ছাড়া আমাদের মতো দেশে দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির যুবক ও তরুণকে জঙ্গিবাদে প্রলুব্ধ করার কথা বলা হলেও সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলায় ঢাকার অভিজাত এলাকার ধনাঢ্য পরিবারের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানরা জড়িত থাকার ঘটনা আমাদের জঙ্গিবাদ আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সেদিন প্রধানমন্ত্রী নাগরিক অভিভাবকদের উদ্দেশে বললেন, সন্তানদেরকে আরো বেশি সময় দিতে হবে, তাদের মনের কথা শুনতে ও বুঝতে হবে। সন্ত্রাস জঙ্গিবাদী তৎপরতা থেকে যুব-তরুণদের বিরত রাখতে প্রধানমন্ত্রীর এই উপলব্ধি ও আহ্বান একেবারে অভিনব। তিনি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলোর প্রতি দিকনির্দেশ করতে চেয়েছেন। তবে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকে অগ্রাহ্য করে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
আবারো বন্যার প্রসঙ্গে আসি। কিছু দিন আগেও শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে হাজার হাজার হেক্টর ধানি জমি অনাবাদি ফেলে রাখতে বাধ্য হয়েছিল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকরা। গঙ্গা ও তিস্তা ব্যারাজের স্লুইস গেটগুলো বন্ধ রেখে পুরোটা পানিই ধরে রেখেছিল ভারত। আর এখন বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই উজানের ঢলে ভেসে যেতে বসেছে পুরো বাংলাদেশ। এভাবেই প্রতিবেশী দেশের প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এক প্রকার বিদ্বেষ তৈরি হয়। সুন্দরবনের কাছে রামপালে দেশের বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে গোটা জাতি। ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নাম দিয়ে তৈরি হচ্ছে এই থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট। প্রতিবেশী দেশের সরকারের সাথে আমাদের সরকারের যতই সদ্ভাব থাকুক, সাধারণ মানুষকে আস্থায় নিতে হলে দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই সুসম্পর্ক তৈরি করতে হয়। দুই দেশের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা এই সত্য বুঝতে না পারলে বা না চাইলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা অসম্ভব।
সারা দেশে যখন সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদবিরোধী মানববন্ধনে এক প্রকার গণজোয়ার তৈরি হচ্ছে, ঠিক তখন দেশের কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে একডজনের বেশি শিক্ষার্থী হতাহত হয়েছে। গত রবিবার চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গুলিবিনিময়ে অন্তত ৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এদের মধ্যে একাধিক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। একই সময়ে সিলেটের জকিগঞ্জ কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সোমবার সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন জঙ্গিবাদবিরোধী মানববন্ধনের কর্মসূচির প্রস্তুতি চলছিল, তখন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির সামনে মোমবাতি প্রজ্বালন অনুষ্ঠানে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহতদের মধ্যে একজন সোমবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করার পর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে হলগুলো খালি করার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স মনোভাব নিয়ে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সোয়াত সারা দেশে যখন কম্বিং অপারেশন চালাচ্ছে, তখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রকাশ্য দিবালোকেই চলছে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি। পুলিশ ও বিশেষায়িত বাহিনীর সদস্যরা দুর্গম চরাঞ্চলে ১০ ঘণ্টাব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়ে দু-একটি ছুরি-চাপাতি ও তথাকথিত জিহাদি বই উদ্ধার করে বাহবা পেতে চাইলেও তথাকথিত ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে থাকা অসংখ্য অস্ত্র উদ্ধারে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। ছাত্রদলের কর্মীরা বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলায় সাজা দেয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশি বাধার সম্মুখীন হলেও কোথাও কোথাও ছাত্রদলের মিছিলের প্রতিবাদ জানিয়ে ছাত্রলীগের রামদা মিছিলের সচিত্র খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা প্রায়শ বলে থাকেন, সন্ত্রাসীর পরিচয় শুধুই সন্ত্রাসী, তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারে না। অবৈধ অস্ত্রধারী খুনিরা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তা কতটা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ছত্রছায়া নিয়ে সন্ত্রাসীরা তা-ই প্রমাণ করছে। দেশের মানুষের নিরাপত্তাহীনতা ও আস্থার সংকট দূর করতে হলে জেএমবি, এবিটি ও আইএস জঙ্গি খোঁজার পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ড এবং দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের নিরস্ত্র করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা শুভ লক্ষণ। পুলিশের পেশাদার ভূমিকার পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই কেবল নাগরিকদের আস্থা, নিরাপত্তাবোধ, জাতীয় অগ্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন