উজবেকিস্তান সফরের সময় একদিন খুব ভোরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় আক্বিদার একজন ব্যাখ্যাতা ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী (রহ.) এর জায়গায়। গাড়ি চলতে চলতে একটি ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় এসে থামে। বলা হয়, আস্তানা পর্যন্ত গাড়ি যাবে না কারণ রাস্তা সংস্কারের কাজ হচ্ছে। আমরা কিছু দূর হেঁটে ইমামের ঠিকানায় পৌঁছি। জায়গাটি সমরকন্দের একটি সাদামাটা ও সম্প্রসারিত আবাসিক এলাকা। গলির মতো রাস্তা। দু’পাশে মানুষের বাড়িঘর। গলির একমাথায় বিশাল গেট। গেটের দুইপাশে পিতলের ফলকে ইমামের সামান্য পরিচিতি খচিত। সরকারি উদ্যোগে তার জায়গাটিকে নতুন সংস্কার করা হয়েছে। বড় ক্যাম্পাসে সবুজ বাগান। এখানে ফুলের চেয়ে নানা অর্কিডের কাজ বেশি। খুব সুন্দর করে বড় অর্কিড ও এক ধরনের ইউকেলিপটাস পাতা ছেটে বড় বড় গম্বুজের মতো বানানো। পুরা বাগানে কয়েকজন কর্মীকে দেখলাম, ঠেলাগাড়ি করে ঝরাপাতা নিয়ে যাচ্ছে। রাতে বৃষ্টি হয়েছিল কি না জানি না। গোটা ক্যাম্পাসটি মনে হলো ভেজা। অবশ্য এটি হালকা তুষারপাতেও হতে পারে। কারণ সকালে যখন আমরা এখানে আসি তখন নিজ নিজ সাধ্যমতো সব গরম কাপড় পরেও সবাই রীতিমতো ঠক ঠক করে কাঁপছিলাম। কান টুপি, রুমাল সব বেঁধেও ঠান্ডা বাতাস থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছিল না।
বেশ উঁচু কবরগাহে আমরা অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে উঠলাম। ভেতরে ইমাম মাতুরীদির কবর। সমরকন্দের ঐতিহ্য অনুযায়ী শান বাধানো সৌধে শ্বেত পাথরের কবর। আরবি সৌকর্যে লেখা তার নাম ও সাল-তারিখ। কবরটির চারপাশে ১৫/২০টি শিলালিপি রাখা। যেগুলোতে খোদাই করে ইলমের কথা লেখা। বিভিন্ন সবক, অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ পাথরে খোদাই করে লিখে রাখা হয়েছে। সে যুগে যেভাবে ইলমের চর্চা করা হতো। নানা জায়গা থেকে আগত জিয়ারতকারীরা ফাতেহা ইত্যাদি পড়ছেন। দুনিয়ার নানা দেশের মাশায়েখ তাদের সুবিধামতো জিয়ারত করে নিলেন। অনেকে চারপাশে গালিচায় বসে অযিফা মোরাকাবা সারছেন।
আমরা জিয়ারত শেষে পুরা ক্যাম্পাসটি একটু ঘুরে দেখলাম। একটিই স্থাপনা। শুধু শানদারভাবে তৈরি ইমামের কবরসৌধ। গেট থেকে বের হয়ে আমরা আবার যখন পায়ে হেঁটে গাড়ি পর্যন্ত আসি তখন আশপাশের বাসা থেকে লোকজন বেরিয়ে আসেন। তারা সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ছোট ছোট শিশুরা শীতের কাপড়-চোপড় পরে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের সালাম দিচ্ছে। কেউ কেউ খুশিতে হাত নাড়ছে। আমি একটি বাসার সামনে দু মিনিট দাঁড়ালাম। শিশু-কিশোরেরা আমাদের ভাষা বোঝে না। আমরাও তাদের ভাষা বুঝি না। আমার ভাবতে ভালো লাগে যে সমরকন্দের এসব শিশুর ভেতরেই হয়তো লুকিয়ে থেকে থাকবে নতুন কোনো ফকীহ আবুল লাইস সমরকন্দী, আবু মনসুর মাতুরীদি, আবুল হাসান আশাআরী, ইমাম আবু হাফস কাবীর, উবাইদুল্লাহ আহরার প্রমুখ। ইতিহাসের কোনো আমির তৈমুরও যে এদের মধ্যে ঘুমিয়ে নেই তা কে বলবে। কয়েকটি শিশু দৌড়ে এসে আমার হাত ধরল। আমি বেশ উৎফুল্ল হলাম। একটু বড় দুটি ছেলে এসে ইশারায় বলল, আমাকে ঘিরে একটি ছবি তুলে রাখতে। আমি একটি বাসার সামনে গাছগাছালি ও ফুলের টবের পাশে বসার লম্বা বেঞ্চিতে বসা অনেকগুলো শিশুকে দেখতে পেলাম। আমি ওদের সবাইকে ডাকলাম। ওরা এসে আমার চারপাশে জড়ো হলো। আর বেশ খুশি প্রকাশ করতে লাগল। বড় ছেলে দুটি আমাকে টেনে নিয়ে ওই বাসার সামনে স্থাপিত বেঞ্চিতে বসাল। আর সব ছেলে-মেয়ে কাতার বেঁধে বসে ছবি তুলল। এরই মধ্যে আমাদের সাথিরা গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। আমিও বাচ্চাদের কাছ থেকে বোবার মতো ইশারা ভাষায় বিদায় নিয়ে গাড়িতে এসে বসলাম। গাড়ি আমাদের নিয়ে চলল নগরকেন্দ্রে আমির উলুগ বেগ প্ল্যানাটোরিয়ামের দিকে।
রাজপথের পাশে একটি কৃত্রিম টিলা। প্রকৌশল ও স্থাপত্যের অপূর্ব কীর্তি। ফুল, পাতা ও সবুজের কারুকাজে এটি যেন এক টুকরা প্রকৃতি। সিঁড়িতে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা আমাদের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নানা দেশের অনেক মাশায়েখ ও দীনদার লোকজন। শীতের সকালে যাদের পরনে অনেক বর্ণিল পোশাক। জুব্বা, আবা, শেরওয়ানি, চেস্ট কোট, চাদর, পাগড়ি, রুমাল, গরম টুপি ইত্যাদি পশ্চিমাদের কাছে ট্রেডিশনাল ইসলামি পোশাক। যা তারা অধিকাংশ সময় পেইন্টিং কিংবা ছবিতে দেখে। বাস্তবে খুব বেশি দেখার সুযোগ তাদের হয় না। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ছবির ফটোসেশন বেশ খানিকক্ষণ চলল। সিঁড়ির উপরের ধাপটি বেশ আকর্ষণীয়। আমির উলুগ বেগের বিশাল ভাস্কর্য। একটি আসনে উপবিষ্ট আমির উলুগ বেগ। হাতে একটি মানচিত্র। তিনি আমির তৈমুরের নাতি ছিলেন। সমরকন্দের শাসক। নিজে অনেক জানাশোনা পন্ডিত। পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি নিজে এই মারকাযুল ফালাকিয়াত বা মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্ল্যানাটোরিয়াম পাশ্চাত্যের আকাশ গবেষণার মূল পথপ্রদর্শক। আমির উলুগ বেগের এই গবেষণাগারে মুসলিম বিজ্ঞানীরা সুনির্দিষ্টভাবে দুই হাজার নক্ষত্র আবিষ্কার করেন। উলুগ বেগ যেন তার প্রজ্ঞা ও শক্তিমত্তা নিয়ে বাস্তবেই উপবিষ্ট আছেন। ভাস্কর্যটি দেখলে তাই মনে হয়। আমি নিশ্চিত নই, এটি পাথর লোহা না কষ্টিপাথরের তৈরি।
সিঁড়ির আরেক ধাপ উঠে আমরা দেখতে পাই মিউজিয়াম। দীর্ঘ সময় নিয়ে ইলমে ফালাকিয়াতের প্রাচীন ও আধুনিক বহু চিত্র, মডেল, প্রকাশনা, পান্ডুলিপি, হস্তশিল্প ইত্যাদি আমরা দেখতে পাই। এর এক ধাপ উপরে বিশাল জায়গাজুড়ে প্ল্যানাটোরিয়াম। এখান থেকে মহাশূন্য গবেষণা করা হতো। ভাগে ভাগে দেয়াল তুলে মনে হয় একটি গ্লােব তৈরি করা হয়েছে। মাঝে একটি বিশাল সুরঙ্গ। এর মুখে বেলকনি পর্যন্ত যাওয়া যায়। এরপর কাঁচ দিয়ে ঘেরা। ভেতরে গভীর খাদের মতো। পাথরে তৈরি কোনো কক্ষপথ হবে। আমাদের গাইড এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। মিউজিয়ামে রাখা কিতাব খুলে দেখতে পারলে হয়তো এর বিবরণ সেখানে পাওয়া যেত। আমি ধারণা করেছি, বড় কোনো গোলক এই খাদে পরিচালিত করে আলো ছায়ার মাধ্যমে পৃথিবী ও গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বোঝার আয়োজন ছিল এটি। দুয়েকজন জার্মান ও ফরাসি পর্যটক এমন পেয়েছি, যারা নিজেরাই জ্যোতির্বিজ্ঞানের লোক। কিন্তু তারা শুধু দেখছেন ও ছবি তুলছেন। আমাদেরকে লেকচার দেওয়ার সময় বা মন-মানসিকতা একটিও তাদের ছিল না। এই স্থাপনার উপরে দাঁড়িয়ে মোটামুটি সমরকন্দ অনেকটাই দেখা যায়। বেশ কিছুক্ষণ এ দর্শনীয় স্থানটিতে কাটিয়ে আমরা রওয়ানা হলাম অন্য জায়গার উদ্দেশ্যে।
জোহরের নামাজ পড়লাম গিয়ে সমরকন্দের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানে। এলাকাটির নাম শাহে জিনদা। এটি মূলত একটি পার্বত্য টিলা। যার সর্বোচ্চ চূড়ায় রয়েছে উত্তর পৃথিবী ও মধ্য এশিয়ায় ইসলাম প্রচারের জন্য আগত হযরত কুসাম ইবনে আব্বাস রাযি. এর কবর। যিনি হযরত আব্বাস রাযি. এর সন্তান। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাচাতো ভাই। যার সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার অবয়ব ও আচরণের সাথে সর্বাধিক সাদৃশ্য রাখে কুসাম। কিতাবে আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালের পর যে কয়জন তার দেহ মোবারককে কবরে রাখার জন্য নেমেছিলেন তাদের মধ্যে কুসাম রাযি. একজন। তখন তার বয়স ১৩। ইতিহাসে আছে, সবার শেষে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর শরীফ থেকে বের হয়ে আসেন এই কিশোর কুসাম ইবনে আব্বাস রাযি.।
সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া এবং এরও আগে খোরাসান ও মাওয়ারাউন নহরে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে মদীনা শরীফের যে কাফেলা প্রথম আসে এর নেতৃত্বে ছিলেন কুসাম ইবনে আব্বাস রাযি.। স্থানীয় মূর্তি পূজারি ও অগ্নিউপাসকদের সাথে তিনি বিতর্কে অবতীর্ণ হন। একপর্যায়ে তারা দাবি করে, আপনি যদি আমাদের প্রধান দেবমূর্তিগুলো ভেঙে ফেলতে পারেন আর আপনার কোনো ক্ষতি না হয় তাহলে আমরা আপনার দ্বীন গ্রহণ করব। আর যদি আপনি মিথ্যা ধর্মের প্রচারক হন তাহলে দেব-দেবিরাই আপনাকে ধ্বংস করে দেবে। তখন সাহাবি কুসাম ইবনে আব্বাস রাযি. তাদের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। নির্দিষ্ট দিনে তিনি একাই দেবালয়ে প্রবেশ করে সব মূর্তি ভেঙে চুরমার করে ফেলেন। অনেক জিন, ভূত ও তান্ত্রিক কলাকৌশলে তাঁকে পূজারিরা ক্ষতি করার চেষ্টা করে। অনেক বাধা-বিপত্তি সত্তে¡ও তিনি তার ঈমান ও আধ্যাত্মিক শক্তি বলে বিজয়ী হন। ওয়াদা মতো অঞ্চলের সকল মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু তাতারী জাতি তুর্কি ও মোঙ্গল সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করলেও তাদের কিছু গোত্রপতি ও নেতা আর কতিপয় ধর্মগুরু ওয়াদা ভঙ্গ করে অমুসলিম থেকে যায়। তারা বিভিন্ন উপদল তৈরি করে হযরত কুসাম রাযি. কে হত্যা ও তার বাহিনীকে পরাজিত করার হাজারো চেষ্টা চালায়।
শেষ পর্যন্ত এক যুদ্ধে তিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও বিশ্বের এই বিস্তৃর্ণ অঞ্চলটি ইসলামের জন্য আল্লাহর নিকট থেকে চেয়ে নেন এবং নওমুসলিমদের সঙ্গে নিয়ে সমরকন্দের এক রণাঙ্গনে সম্মিলিত সকল বাহিনীকে যুদ্ধে আমন্ত্রণ জানান। কয়েক দিন যাবত দুর্ধর্ষ এ যোদ্ধা দলের সাথে লড়াই করতে থাকেন। দিনের বেলা প্রচন্ড লড়াই করতেন আর সারা রাত সাথিদের নিয়ে ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাতেন। শেষ দিন তার দিলে একটি বিষয় উদয় হয়। সেটি হচ্ছে তিনি নিজেকে এই দেশের মানুষের হেদায়েতের বিনিময়ে উৎসর্গ করে দেবেন। পরদিন সারাদিন যুদ্ধ হয়। বিদ্রোহী ও গাদ্দার মোঙ্গল, তুর্কি ও তাতার বাহিনী বহুবার চেষ্টা করেও এমনকি আঘাত করেও তাকে হত্যা করতে পারেনি। তখন তিনি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। তাদের লক্ষ করে বলেন, তোমরা আমার সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছ। কথা ছিল, প্রথম ঘটনার পরই ইসলাম গ্রহণ করবে। এরপরও তোমরা কিছু লোক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছ। আজ কয়েক দিন ধরে আরব ও মুসলিম বাহিনীকে তোমরা পরাজিত করতে পারছ না। আমাকেও বহুবার বাগে পেয়েও তোমরা হত্যা করতে পারনি। আজ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমাদের বিজয়ী হওয়ার সুযোগ করে দেব। তবে একটি শর্ত থাকবে। যারা আজকের ঘটনায় ইসলাম গ্রহণ করবে তারা আমার সৈন্যদের সঙ্গে মিশে যাবে। আর যারা আজও ইসলাম গ্রহণ করবে না, তাদের সবাইকে আমার সৈন্যরা হত্যা করবে। তবে যদি কেউ চায় তাহলে তারা উত্তরের সীমানার পর্বতের পেছনে চলে যাবে। আর কোনো দিন মুসলমানের বিজিত অঞ্চলে পা রাখবে না। এরপর তিনি এক দিনের জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। সন্ধ্যার পর গোপনে শত্রু সেনাপতিদের খবর পাঠান, যুদ্ধ করে তোমরা জয়ী হতে পারবে না। যদি জয়ী হতে চাও তাহলে রণাঙ্গনের পাশে আমার নিজস্ব তাঁবুতে সিজদারত অবস্থায় আমার কল্লা কেটে নিও। আমি আল্লাহর কাছ থেকে এ অঞ্চলে দুশমনের হাতে রণাঙ্গনে নামাজরত অবস্থায় আমার মৃত্যু ও শাহাদাত চেয়ে নিয়েছি। পরদিন তার কথা মতোই সবকিছু হলো। শত্রুরা বহু চেষ্টায়ও তাকে হত্যা করতে পারেনি। তাকে তার কথা মতোই এভাবে শহীদ করে কিছু অবাধ্য লোক দ্রুত পালিয়ে যায়। আর বাকিদের ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানরা অস্ত্র সংবরণ করে নেন। তখন থেকে সোভিয়েত, মধ্য এশিয়া তথা তুরস্ক থেকে আফগানিস্তান আর পারস্যের একাংশ থেকে উত্তর মেরু পর্যন্ত মুসলমানদের কব্জায় চলে আসে। হজরত কুসাম ইবনে আব্বাস রাযি. কে সমরকন্দের এ পার্বত্য টিলার চূড়ায় দাফন করা হয়। জায়গাটিকে নওমুসলিমরা নাম দেন শাহে জিনদা। অর্থাৎ অমর শহীদ বাদশাহ। এর কয়েক বছর পর বিদ্রোহীদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে গোটা অঞ্চলে ইসলামী শাসন ও খেলাফতের বিস্তার ঘটান কুতাইবা ইবনে মুসলিম।
আমরা শাহে জিনদায় যখন পৌঁছি তখন জোহরের নামাজের সময় হয়েছে। ব্যস্ততম সড়কের পাশে অনেক জায়গাজুড়ে ওযুখানা। ঠান্ডা ও গরম পানির ব্যবস্থা। জামা, কাপড়, ব্যাগ রাখার সুব্যবস্থাসহ এলাকার মানুষ জিয়ারতকারীদের নানা রকম খেদমত করছে। প্রচন্ড শীতে ওযুর পর হাত মুখ মোছার জন্য তোয়ালের ব্যবস্থা। পা মোছার জন্য আলাদা তোয়ালে। কয়েকটি দোকান আছে বিভিন্ন স্মারক বস্তু কেনার জন্য। বিশেষ করে জায়নামাজ, আলখাল্লা, লাঠি, তসবিহ, টুপি ও নারী-পুরুষের জন্য পশম ও সিল্কের উজবেক পোশাক। বোখারা, সমরকন্দের ঐতিহ্যবাহী কারু ও হস্তশিল্পও সেখানে বিক্রি হয়। ওযু সেরে মসজিদের দিকে যাওয়ার সময় এক দোকানী ও তার স্ত্রী আমাদের কফি আর বিস্কুট খেয়ে যেতে বাধ্য করলেন। তারা তাদের ভাষায় বোঝাতে চাইছিল, কোনো কিছু কিনতে হবে না। এমনিতেই মেহমানের জন্য এই বিস্কুট ও কফি। চিনি থাকায় আমি কফি ও বিস্কুট কিছুই নিলাম না।
এরপর বেশ কিছু পথ ফুটপাত ধরে এগিয়ে আমরা শাহে জিনদার মূল গেইটে চলে যাই। মধ্য এশীয় স্থাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন এই বিশাল তোরণ। এরপর পাহাড় কেটে তৈরি বিশাল বিশাল ধাপের ৪০টি সিঁড়ি ভেঙে আমরা মূল টিলার উপর উঠলাম। সাধারণ ভবনের হিসাবে ৮/৯ তলা হবে। এরপর সমান পথে হেঁটে গেলাম আরও ৩০০ গজ। দুইপাশে এত উঁচু উঁচু সমাধি সৌধ যে মনে হয় আকাশ দেখা যায় না। বিভিন্ন আমির, সেনাপতি, রানী, রাজকন্যা, যুবরাজ, সুফী, দরবেশ ও এসব স্থাপনার স্থপতিগণের কবর। দুটি কবর এমন পেলাম যেগুলোতে লেখা, বাদশাহ তৈমুরের বিবি। একটি কবর তৈমুর লংয়ের বোনের। নাম সম্ভবত রাকা বোকা বেগম।
একটি ফাঁকা প্রাচীরের মধ্য দিয়ে খোলা একটি ছাদ দেখে আমি সেখানে গেলাম। মনে হলো দূর-দূরান্ত পর্যন্ত প্রাচীন সমরকন্দ দেখা যায়। শত শত বিদেশি পর্যটক নারী-পুরুষ। পশ্চিমারাই বেশি। এক দিকে ফলক লাগানো আছে। তা দেখে এগিয়ে গেলাম। এখানেই মূল মসজিদ। জোহরের নামাজ পড়লাম। ইমাম সাহেব আরবি বংশদ্ভুত। বললেন, আরব থেকে আগত সেই মুজাহিদ দলের কোনো ব্যক্তির উত্তর পুরুষ তিনি। তাঁর তাকবীর, সালাম, দোয়া ইত্যাদি শোনে বেশ ভক্তি জন্মালো। তাঁর কণ্ঠ খুবই গম্ভীর ও সুমধুর। আমার মনে খুব ইচ্ছা জেগে রইল মাগরিব, ইশা বা ফজরের নামাজ যদি তার পেছনে পড়তাম। বয়স্ক এই ইমাম সাহেবের চেহারাটিও অনেক সুন্দর, শ্রদ্ধেয় ও মনে রাখার মতো। আবা ও পাগড়িতে তাকে অসাধারণ মনে হয়।
মসজিদের পর বেশ কিছু পাহাড়ি গলিপথ পার হয়ে মাজার ভবন। কিছুটা সংস্কারের কাজ চলছে বলে মনে হলো। দেয়ালের ফাঁকে কিছু কাঠের কাজ দেখলাম। মনে হয় কম করে হলেও এসব কাঠের বয়স ৭/৮ শ বছর হবে। খোদাই ও কারুকাজ করা একটি এক পাল্লার দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখি, ছোট ছোট দুটি কক্ষ মানুষে ভরা। এরপর আরেকটি খোলা দরজা পেরিয়ে প্রবেশ করলাম মূল কবরের জায়গায়। এখানে কাঁচ, চিনা মাটি ও পুরোনো বিভিন্ন পাথরের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি কবরটিই হযরত কুসাম ইবনে আব্বাস রাযি. এর। ১২/১৩ শ’ বছরের পুরোনো স্থাপনা। যুগে যুগে বহু শাসক ও রাজা-বাদশাহ নিজেদের করে একে নানাভাবে সুসজ্জিত করায় এটি এক প্রাচীন ও ঐতিহ্যমন্ডিত রূপ পরিগ্রহ করেছে। এখানে নানা যুগের নানা শাসকের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও অভিরুচি একসাথে মিলেমিশে অন্য রকম এক আবহের সৃষ্টি করেছে। কোনো রকমের ধুপ, ধুনা, আগরবাতি, মোম কিংবা মন্ডা, মিঠাই, সিরনীর চিহ্নও নেই। কোনো রকম তাগা, সুতা, তাবিজ-তুমারও নেই। বিশেষ কোনো খাদেম, কথিত সুফী, দরবেশ ও পান্ডারও দেখা পেলাম না। দুনিয়ার সব মানুষ ছুটে আসছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মজলিসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম, জিয়ারত, নামাযের সময় হলে মসজিদে নামায পড়ে চলে যাচ্ছে।
আমরা লক্ষ্য করলাম, চারপাশে টিলাটিজুড়েই হাজার হাজার কবর। অন্তত সাড়ে ১৩শ’ বছরের মধ্য এশীয় মুসলমানরা অনেকেই এখানে শেষ বিছানা বেছে নিয়েছেন। জিয়ারত ও পরিদর্শন শেষে আবার দুই পাশের অসংখ্য বড় বড় সমাধি সৌধ, গম্বুজ, খিলান ও পাথরে নির্মিত প্রাচীন কবর পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলাম সমতলে। মূল তোরণের পাশে বিশাল দুয়েকটি সাইনবোর্ড এমন দেখলাম যেখানে শাহে জিনদার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে কিছু তথ্য। একটিতে উজবেকিস্তান সরকারের ধর্ম বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত বিদআত ও কুসংস্কার বিরোধী নির্দেশনামা। অন্য একটি ফলকে উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে শরীয়ত সম্মত জিয়ারতের পদ্ধতি। ভিন দেশী জিয়ারতকারীদের কোনো আচরণ যেন কুসংস্কার ও বিদআতের সীমায় চলে না যায়, এমন সতর্কবাণী। এরপর আমরা দুপুরের খানা একটি ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁয় সেরে হোটেলে ফিরে যাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন