মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল দুর্ঘটনাটা। তখন খটখটে দুপুর। নির্মেঘ আকাশের কোথাও এতটুকুন ছায়া নেই।
সীতাকুন্ডু পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ওপরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো আবার। পঁচিশ বছরের দুখাই-এর দুটো বলিষ্ঠ হাত প্রচন্ড শক্তিতে ঘুষি মারলো লোকটিকে। একটা পাথরের ওপরে মেয়েটিকে জাপটে ধরেছিল লোকটি।
ধ্বস্তাধস্তি করছিল মেয়েটিকে বিবস্ত্র করার জন্যে। পাহাড়ের বাঁকের আড়ালে, ঝোপের কাছে, চোখ পড়লো দুখাই-এর।
সেই একই ঘঁনা...!
একই জায়গা। দুখাই-এর ভেতরটা কেমন যেন ফুঁসতে লাগলো। ছুটে গিয়ে ভীষণ জোরে ঘুষি মারলো ঐ পশু শক্তির লোকটিকে। আর টাল সামলাতে না পেরে লোকটি ছিটকে পড়লো পাহাড়ের খাড়ির ভেতর একেবারে অনেক অনেক নিচে।
ধাক্কা সামলাতে না পেরে পা ফসকে পড়ে যাচ্ছিল মেয়েটি।
কিন্তু একটা গাছের মোটা শেকড় ধরে ফেলে পাহাড়ের গায়ের সাথে নিজেকে। খুব সাবধানে আটকে রেখে হাঁপাচ্ছে সে।
বিন্যস্ত কেশ বাস।
দুখাই-এর সমস্ত শরীর তখন ঘামছে দাঁতে দাঁত চেপে কোমরে হাত দিয়ে, তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। যতোদূর চোখ যায় সবুজে বিস্তৃত পাহাড় আর পাহাড়। কেউ দেখলো না আর জানলো না পর্যন্ত, শুধু দুখাই আর এই মেয়েটি ছাড়া।
এক আশ্চর্য নিরবতা যেন স্তব্ধ হয়ে আছে এই খাদটায়।
এক সময় দুখাই তাকালো মেয়েটির দিকে। দেখলো ভয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে ওর সুন্দর মুখটি। নিচের দিকে তাকালে বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। ওখানে শুধু গভীর ঘন সবুজের রহস্যময় শূন্যতা।
এক সময় অসহায়ের মতো একটি হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটি। কম্পিত কণ্ঠে বলল, আমাকে একটু ধরো প্লীজ।
বাধা পড়ল দুখাই-এর গভীর নিমগ্নতায়। তাকালো মেয়েটির দিকে। তারপর এগিয়ে পাহাড়ের ঢালু খাদের দিকে নামলো অনেক কষ্টে। প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে একটি হাত কোন রকমে ধরলো দুখাই। তারপর অনেক কষ্টে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে এলো ওপরে পাহাড়ের সমান জায়গায়।
কেমন যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে চলে গেল দুখাই-এর সারা শরীর। এর আগে কোন মেয়ের তারুণ্যের স্পর্শ পায়নি সে। কেমন যেন এক রহস্যময় অনুভূতি অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল ওকে বার বার।
মেয়েটি নিঃশব্দ, ভয়ার্ত এবং ক্লান্ত। অপলক তাকিয়ে আছে দুখাই-এর দিকে। এই পাহাড়ী মানুষটা না হলে কি হোত আজ? দলের সাথে এসকারশনে এসে শেষের দিকে হাঁপিয়ে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শান্তা। পাহাড়ের ওপরে এসে মন্দিরে যাওয়ার সিঁড়ির পথটায় আর যেতে চাইলো না সে। বলেছিল, বড্ড মাথা ধরেছে। আমি এখানেই একটু খোলা হাওয়ায় বসি। তোরা যা।
দলের ছেলেমেয়েরা সিঁড়ি ভেঙে মন্দির দেখতে পাহাড়ের চূড়ার দিকে চলে গেল। শান্তা কিছুক্ষণ জিরিয়ে পাহাড়ের পেছনের বাঁকটা ঘুরে দেখছিল। এ ধারটা বেশ নিরিবিলি। লোকজন খুব একটা আসে না এখানে।
নানান ধরনের জংলা লতাগুলো আর ছোট ছোট কাশফুলের গুচ্ছ বোধ হয় শান্তাকে আকর্ষণ করেছিল একটু বেশি। প্রকৃতির প্রেমে একটু বোধ হয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সে।
আর এই ফাঁকে শান্তার একাকিত্বের সুযোগ নিল এক স্থানীয় মাস্তান।
এরই মধ্যে মন্দির দেখে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরে এলো দলের সবাই। ঝুপ ঝাপ করে এদিক সেদিক বসে পড়লো কেউ কেউ। একজন গাড়ি খুলে কোল ড্রিংস বের করলো।
শান্তা ততোক্ষণে গাড়ির কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। ওর চেহারা থেকে আতঙ্কের ছাপ তখনো যায়নি।
রীতা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো-কি রে? কি হয়েছে তোর? চেহারাটা এমন লাগছে কেন? এখানে একা থাকতে কোন রকম অসুবিধে হয়নি তো তোর?
ঢোক গিলে নিজের অপ্রস্তুত ভাবটাকে সামলে নিতে চাইলো শান্তা। মুখে কিছুই বললো না-। কেমন দৃষ্টিতে তাকালো দূরে দাঁড়ানো দুখাই-এর দিকে। রফিক রেগে বলল-
: ঐ লোকটা? বল কি করেছে ঐ লোকটা। দুখাই কেমন যেন এক বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো শান্তার দিকে। তারপর ঘাড় নিচু করে এগিয়ে গেল চালা ঘরটির দিকে। শান্তা ডাকলো, : শোন-
দুখাই থেমে গিয়ে ঘাড় ফেরালো।
শান্তা বলল, : ও না থাকলে, আজ কি যে হোত? ভাবতেই আমার শরীর হিম হয়ে আসছে। বেলাল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, : তার মানে? শান্তা কম্পিত কণ্ঠে বলল,
: আমি হাঁটতে হাঁটতে বাকের ওধারটায় চলে গিয়েছিলাম, এমনি সময় একটা মাস্তান এসে আমাকে।
: বলিস কি! অবাক হল শফি।
: আমি তখনই বলেছিলাম। এখানে একা থাকাটা ঠিক হবে না। বিজ্ঞের মতো বললো হারুন।
রীতা শান্তার হাত দু’টি ধরলো পরম আন্তরিকতায়। বলল-
থ্যাঙ্কস গড। বড় বাঁচা বেঁচে গেছিস। এখন চল খুপরীতে গিয়ে চা খেয়ে একটু চাঙ্গা হয়ে নি।
একে একে সবাই ঢুকলো শনের খুপরী দোচালা ঘরটিতে।
ভেতরে বসার কোন ব্যবস্থা নেই। গোটা চারেক হাই বেঞ্চ রয়েছে শুধু। ওতে চায়ের কাপ রেখে দাঁড়িয়েই গরম চা খায় খদ্দেররা।
শান্তা এক সময় খেয়াল করলো একটা চায়ের কাপ হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দুখাই, বুঝতে পেরে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিল শান্তা। একটু হেসে বলল,
: থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ। সত্যি তুমি আজ অসাধ্য সাধন করেছো।
কেমন যেন একটু হাসার মতো মুখ করলো দুখাই।
শান্তা আবার বলল,
: এতো কিছু হয়ে গেল। তুমি আমার সাথে একটা কথাও বললে না। পাশেই চুলোয় আঁচ দিচ্ছিল ছোট একটি ছেলে। ও একবার তাকালো দুখাই-এর দিকে। বলল,
: দুখাই ভাইজান তো বোবা। কথা কইব কেতে!
বোবা! শান্তার বুকের কোথায় যেন একটা ধাক্কা লাগলো। ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল সে চোখ দুটো কেমন যেন ভিজে আসতে চাইলো। সহজ হবার চেষ্টা করলো যেন বলল,
: চা টা কিন্তু সত্যি খুব ভালো হয়েছে।
দুখাই চোখ তুলে তাকালো শান্তার দিকে। তারপর একটু হাসি হাসি মুখ করে, একটু মাথা ঝুকিয়ে যেন ধন্যবাদ জানাতে চাইলো শান্তাকে। প্রতিউত্তরে, হাসি মুখে একটু মাথাও নাড়ালো শান্তা।
আরিফ পকেট থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে দিতে গেল-বলল, : নাও তোমার বখশিস। শান্তাকে বাঁচাবার জন্য।
দুখাই দু’চোখ তুলে একবার দেখলো শান্তাকে। তারপরেই বের হয়ে গেল ঝুপরী থেকে।
আরিফ ঠোঁট উল্টে বলল,
: লে বাবা, বোবাটার প্রেস্টিজ জ্ঞান দেখি একেবারে টনটনে।
ঘটনার আকস্মিকতায় কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেল শান্তা। চাপা তিরস্কারের মুখে বলল,
: আরিফ প্লীজ ওকে আর অপমান করো না।
মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে শান্তার করলো হাত জোড় করলো-আরিফ বলল, : স্যরি।
ঝুপরী থেকে বেরিয়ে একে একে সবাই গাড়িতে উঠে বসলো।
শান্তার মনটা কেমন যেন বিষাদে ছেয়ে গেল। চোখ দুটো ছটফট করতে লাগলো। পাহাড়ী তারুণ্যে ভরা দুখাই-এর গভীর চোখ দুটো যেন শান্তার বুকের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
আরিফ এক সময় বলল,
: শান্তা ম্যাডাম-আমরা কি এবার স্টার্ট করব?
কোন কথাই শান্তার কানে গেল না। ওর বিষণ্ণ’ দুটি চোখ বিচরণ করতে লাগলো পাহাড়ের আনাচে কানাচে।
হঠাৎ ওর চোখে পড়লো, পাহাড়ে চূড়ায় মন্দিরে ওঠার সিঁড়িতে বসে আছে দুখাই।
দুখাই-এর বুকের ভেতরটায় কেমন যেন করতে থাকে।
সেই তো কবেকার কথা বয়স ওর তখন দশ-এগারো। পাহাড়ের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নিচের থেকে পানি টানতো ঐটুকুন ছেলে মাথায় ঘড়া দিয়ে।
ওপরে পানির তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। দর্শনার্থীরা একেবারে ওপরে অর্থাৎ মন্দিরে ওঠার আগে এই ঝুপরীতে এসে একটু চা-পানি খেতে চায়। দুখাই-এর মা কুন্তি পাহাড়ের আঁকে বাঁকে ঘুরে ঘুরে গাছের শুকনো ডালপালা কুড়াতো। আর চা বানাতো ওর বাবা লখাই। এগুলো ছিল ওদের রুটিন করা কাজ।
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের বন্য সৌন্দর্য কুন্তির কালো মসৃণ যৌবনদীপ্ত দেহটা স্থানীয় অনেকের দৃষ্টি কাড়তো। মাথায় লাকড়ী বোঝা নিয়ে টানটান করে হাঁটতো পঁচিশ বছরের কুন্তি।
কখনো কখনো দর্শনার্থীদের সামনে পড়ে যেতো সে। কেউ কোন মন্তব্য করলে সাপিনীর মতো ফণা তুলে তাকাতো কুন্তি।
একদিন অকস্মাৎ ঘটলো সেই দুর্ঘটনা।
তখন খটখটে দুপুর। চার দিকে ঝাঁঝাঁ করছে রোদ। অসহ্য গরমে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে যেন চারদিক।
একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে একটু ঝিমোচ্ছিল বালক দুখাই। হঠাৎ ওর মনে হলো বাঁকের ওধারটায় কেমন যেন ঝটপটানি শব্দ। কিছু একটা যেন ঘটছে ওধারটায়, জন্ম থেকে এই চন্দ্রনাথ পাহাড়ের আলো-বাতাসে ও বড় হয়েছে।
এখানকার প্রতিটি শব্দ আর ঘ্রাণের সাথে পরিচিত সে।
কান খাড়া করে উঠে দাঁড়ালো দুখাই। তারপর এগিয়ে গেল বাঁকের দিকে। এবং আরেকটু এগুতেই একেবারে চমকে উঠলো। দেখলো, বাঁকের একদম ধারে-ওর মা কুন্তিকে মাটিতে চেপে ধরেছে একটি জোয়ান লোক। বিবস্ত্র কুন্তি নিজেকে ছাড়াবার জন্যে আপ্রাণ ধস্তাধস্তি করছে। লোকটা যেন গ্রাস করবে কুন্তিকে। চোখের সামনে এরকম একটা ঘটনা বালক দুখাই-এর রক্তে যেন আগুন জ্বলে উঠলো। ওর সারা শরীর কাঁপতে লাগলো থর থর করে। নিজেকে আর সামলাতে পারলো না সে। একটা ভারী পাথর দু’হাতে তুলে নিয়ে পেছন থেকে লোকটির মাথায় আঘাত করলো দুখাই। চিৎকার করে উঠলো কুন্তি।পেছন থেকে মাথায় হঠাৎ আক্রমণে কিছু জানবার আর বুঝবার আগেই রক্তাক্ত মাথাটা তুলতে গিয়ে কুন্তিকেসহ গড়িয়ে নিচে অনেক নিচে পড়ে গেল লোকটি। একেবারে পাহাড়ী খাড়ির মধ্যে। ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে হতভম্ভ হয়ে গেল দুখাই। ঐ লোকটির সাথে সাথে পাহাড়ের নিচে পড়ে যেতে দেখে মা মা বলে চিৎকার করে উঠতে গেলো দুখাই।
কেমন একটা গোঙানীর মতো শব্দ বেরিয়ে থেমে গেল হঠাৎ। পাগলের মতো, দু’হাতে মাথার চুলগুলো টেনে ধরে আপ্রাণ চিৎকার করে কাঁদতে চেষ্টা করলো দুখাই। কণ্ঠনালীতে কেমন একটা অসহ্য যন্ত্রণা।
ঝুপড়ীর চুলোয় তখন আঁচ দিতে ব্যস্ত লখাই। দুপুর ঢলে দর্শনার্থীদের আনাগোনা বাড়বে মন্দিরের পথে। এই সময়ের মধ্যে সে রোজই চায়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
এক সময় অস্বাভাবিকভাবে কাঁদতে কাঁদতে ঝুপড়ীর ভেতরে এসে হাত ধরে টেনে বাপকে বাইরে নিয়ে এলো দুখাই।
বাকি অংশ সাহিত্য পাতায়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন