মোহাম্মদ আবদুল গফুর
সন্ত্রাস এখন শুধু বাংলাদেশের একটি সমস্যাই নয়। গোটা বিশ্বেই সন্ত্রাস একটি সমস্যা হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে যেমন আফ্রো-এশীয় দেশগুলোতে, তেমনি দেখা যাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় তথা পশ্চিমা দেশগুলোতে। তবুও একশ্রেণীর ইসলামবিদ্বেষীর বদভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীর কোনো প্রান্তে কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেই অনিবার্যভাবে তার সঙ্গে মুসলমানদের জড়ানোর চেষ্টা করা। এসব অপপ্রচারণার ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, সন্ত্রাসের নাম হয়ে গেছে এখন জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গিবাদের উত্থানের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক প্রমাণের লক্ষ্যে নানা রকম সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার জন্মদান করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক বিশ্বে জন্ম নেয়া এ ধরনের একটি সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার নাম ইসলামিক ষ্ট্রেট (সংক্ষেপে আইএস)। নামটি শুনে প্রথমে মনে হবে এটি মুসলমানদের কোনো সংগঠন, পৃথিবীতে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই যার লক্ষ্য। সে হিসেবে ইসলাম-ভক্ত ত্যাগী তরুণরা এর নেতৃত্বে থাকবে এটা ধরে নেয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু খটকা বাধছিল এর কর্মকা- নিয়ে। ইসলাম শব্দটির অর্থ যেমন শান্তি তেমনি একটি আদর্শ হিসেবে ইসলামের লক্ষ্যও সমগ্র বিশ্বে এক ¯্রষ্টায় বিশ্বাসী এমন এক মানব সমাজ নির্মাণ যাদের মধ্যে বর্ণ, গোত্র, শ্রেণী, ভাষা ও ভূখ- নির্বিশেষে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট থাকবে।
ইসলাম শিক্ষা দেয়, মানব সমাজের আদি পর্যায় থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে ¯্রষ্টার নির্দেশে যত প্রেরিত পুরুষ এসেছেন সবার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ছাড়া কেউ ইসলামে পূর্ণ বিশ্বাসী হতে পারে না। সে নিরিখে আজকের বিশ্বে প্রচলিত সমস্ত প্রধান ধর্মবিশ্বাসই এককালের ¯্রষ্টা প্রেরিত ধর্ম ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তার অনুসারীরা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো এর মধ্যে বিকৃতি ঘটায়। পৃথিবীতে যুগে যুগে ¯্রষ্টা বিভিন্ন প্রেরিত পুরুষ পাঠান ¯্রষ্টার একত্ব ও মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের আদর্শ শিক্ষা দিতে। কিন্তু পরবর্তীকালে ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের খেয়ালখুশি মোতাবেক ধর্মের বিকৃতি সাধন করে সমাজে অনাচার সৃষ্টি করে বসলে তাদের পুনরায় ধর্মের সঠিক আদর্শ শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে ¯্রষ্টা নতুন করে প্রেরিত পুরুষ পাঠান। এভাবে একেক প্রেরিত পুরুষ পাঠানোর পর আবার প্রেরিত পুরুষ পাঠানোর প্রয়োজন দেখা দিত প্রধানত দুটি কারণেঃ এক ইতোমধ্যে ধর্ম অনুসারীদের মাধ্যমে ধর্মের যে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে তা থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা। দুই. পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রয়োজনের আলোকে নতুনতর ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করা। একটা উদাহরণ দিলে শেষোক্ত বিষয়টি স্পষ্ট হবে। একথা সকলেই স্বীকার করেন যে, বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম মানব দম্পতি ছিলেন হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)। এই দম্পতির সব সময় এক সাথে একটি পুত্র ও একটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করত। তাই তখন বিধান ছিল এক সাথে জন্ম নেয়া কন্যার সাথে অন্য সাথে জন্ম নেয়া পুত্রের বিবাহ দেয়া। অর্থাৎ ভাইবোনের বিবাহ তখন সীমাবদ্ধ পর্যায়ে বৈধ ছিল। পরবর্তীকালে তা সম্পূর্ণ অবৈধ হয়।
এভাবে মানবতার পর্যাপ্ত মান অর্জিত হওয়ায় সম্পূর্ণ মানব জাতির ওপর ঐশী নির্দেশনার চূড়ান্ত রূপ অবতীর্ণ হয় সর্বশেষ প্রেরিত পুরুষের ওপর। শুধু তাই নয়, ঐশী নির্দেশনার এ চূড়ান্ত রূপকে বিকৃতির হাত থেকে সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজ হাতে গ্রহণ করেন স্বয়ং ¯্রষ্টা। তাই তো দেখা যায়, অন্যান্য সকল অবতীর্ণ ধর্মগ্রন্থ কম-বেশি বিকৃত ও পরিবর্তিত হলেও সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ অদ্যাবধি অপরিবর্তিত রয়েছে।
সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থকে বিকৃত করতে না পেরে অনেক ইসলামবিদ্বেষী নানা ছদ্মবেশে ইসলামের বিরুদ্ধে চক্রান্তে অবতীর্ণ হয়েছে। তার সর্বশেষ প্রমাণ সাম্প্রতিক বিশ্বের বহুল প্রচলিত ইসলামিক স্টেট তথা আইএস নামের সন্ত্রাসী সংস্থা। এটি বাহ্যত একটি ইসলামী নামধারী সংস্থা হলেও এবং বহু মুসলিম তরুণকে পরকল্পিতভাবে এর মধ্যে এনে সন্ত্রাসী হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হলেও এটি গড়ে উঠেছে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’-এর সদস্যদের দ্বারা। স্বাভাবিকভাবে এর দ্বারা যেমন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মুসলমানরা, তেমনি ইসলামের নামে সন্ত্রাস চালানোর কারণে এই সংস্থার দ্বারা বাইরে দুর্নামও হচ্ছে ইসলামের।
আসলে সমগ্র বিশ্বের ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী বিপুল সংখ্যক গণমানুষ অর্থবিত্ত ও শিক্ষা দীক্ষায় পশ্চাৎবর্তী থাকা সত্ত্বেও তারা পৃথিবীতে শান্তিতে থাকতে চায় এবং যথাসাধ্য শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম পালন করে চলতে চায়। তাদের অর্থবিত্ত ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি না থাকা সত্ত্বেও তাদের শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম পালন করে যাওয়ার মনোভাবের কারণে কোনো পরিকল্পিত মিশনারী প্রচার ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও দিন দিন পৃথিবীতে ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমান ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলাম পালন করে যাওয়ার শান্তিপূর্ণ পথ অবলম্বন করে বলা সত্ত্বেও দিন দিন সারা বিশ্বে ইসলামের প্রসার বেড়ে চলেছে দেখে ইসলামবিদ্বেষী মহলের নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই চরম ইসলামবিদ্বেষী মোসাদ-এর মাধ্যমে ইসলামী স্টেট (আইএস) নামক সন্ত্রাসী সংগঠন জন্ম দিয়ে চরম চতুরতার সাথে সেখানে বেশ কিছু সরলমনা মুসলিম তরুণকে ভিড়িয়ে তার মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে ইসলামের বদনাম ছড়িয়ে চলার সুপরিকল্পিত পথ অবলম্বন করেছে।
কিন্তু তাদের এ ষড়যন্ত্র যে সফল হওয়ার নয়, তা সুস্পষ্ট। কারণ শত্রুর পাতা ফাঁদে কখনো মুসলমানরা পা দেবে না। মুসলমানরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে ইসলাম শান্তির ধর্ম। সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানুষের অশান্তি ও রক্তপাত ঘটানোর নীতিতে ইসলাম কখনো বিশ্বাস করে না। যারা সন্ত্রাস করে তারা কোনো ধর্মের আদর্শেই প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস করে না। সন্ত্রাসের সাথে ইসলামকে জড়িয়ে ফেলে সমালোচনা করার বদভ্যাসের বিরুদ্ধে ক্যাথলিক খ্রিস্টান বিশ্বের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস-এর এ সম্পর্কিত বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার বরাত দিয়ে গত মঙ্গলবারের নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় :
“সহিংসতার সাথে ইসলাম ধর্মকে জড়িত করা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন পোপ ফ্রান্সেস। তিনি মনে করেন সামাজিক অন্যায় ও অর্থের পূজাই সন্ত্রাসের প্রধান কারণ। ফ্রান্সিস একটা গির্জার যাজককে গলা কেটে হত্যা নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পোপ এ মন্তব্য করেন।
পাঁচ দিনের পোল্যান্ড সফর শেষে ইতালির রোমে ফিরতি বিমানে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “আমি মনে করি সহিংসতার সাথে ইসলামকে জড়ানো ঠিক হবে না। এটা ঠিক নয় এবং সত্য নয়। পোপ আরও বলেন, সব ধর্মেই মৌলবাদীদের ক্ষুদ্র অংশ রয়েছে। ক্যাথলিক ধর্মের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের ধর্মেও এমন মৌলবাদী রয়েছে। ফ্রান্সিস বলেন, আমি ইসলামিক সহিংসতা নিয়ে কথা চলা পছন্দ করি না। কারণ প্রতিদিন আমি যখন পত্রিকা পড়ি তখন ইতালিতে সহিংসতার খবর দেখি। কেউ বান্ধবীকে খুন করেছে, কেউ শাশুড়িকে খুন করছে। যারা এসব করছে তারা খ্রিস্টান ক্যাথলিক।”
ফ্রান্সিস আরও বলেন, আমি যদি ইসলামিক সহিংসতা নিয়ে কথা বলি তাহলে আমাকে ক্যাথলিক সহিংসতা নিয়েও কথা বলতে হবে। সন্ত্রাসের বিভিন্ন কারণ আছে। আমি জানি এটা বলা বিপজ্জনক। কিন্তু যখন কোনো বিকল্প থাকে না তখন সন্ত্রাস বৃদ্ধি পায়। যখন অর্থই হয়ে ওঠে ঈশ্বর, মানুষের পরিবর্তে বিশ্বে অর্থনীতি হয়ে ওঠে কেন্দ্র, তখন এটাই হয় সন্ত্রাসের রূপ। এটা হলো সব ধরনের মানবতার বিরুদ্ধে মৌলিক সন্ত্রাসবাদ।
পোপ সাংবাদিকদের আরও বলেন, ইউরোপে যুবকদের অর্থনৈতিক সুযোগের ঘাটতিও সন্ত্রাসবাদের একটি কারণ। তিনি বলেন, আমি নিজেকে বিজ্ঞাসা করি আমরা ইউরোপিয়ান তরুণদের কী আদর্শ দিতে পারছি, যাদের কাজ নেই। কাজ না থাকায় তারা মাদকাসক্ত হচ্ছে ও ড্রাগ নিচ্ছে এবং আইএসের সদস্য হচ্ছে।
পোপ ফ্রান্সিসের উপরে উল্লিখিত বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, তিনি এতে কোনো বিষয়ে রাখঢাক করেননি বা রাজনীতিকদের মতো নিজেদের দেশ বা মতের পক্ষে অন্যায় সাফাইও গাওয়ার চেষ্টা করেননি। যেখানে সারা বিশ্বে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও একশ্রেণীর নেতানেত্রী বেছে বেছে ইসলাম ও মুসলমানদের শুধু সন্ত্রাসের জন্য দায়ী করতে অভ্যস্ত, সেখানে পোপ ফ্রান্সিস সহিংসতার জন্য শুধু ইসলাম বা মুসলমানদের দায়ী করতে রাজি হননি। বলেছেন, ইসলামিক সহিংসতার কথা বললে আমাকে পাশাপাশি আমি ইতালিতে সব সময় যা দেখি তার আলোকে আমাকে ক্যাথলিক সহিংসতার কথাও বলতে হবে। শুধু তাই নয়, আধুনিক ইউরোপের তরুণদের অবস্থা তুলে ধরে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আমরা ইউরোপীয় তরুণদের কী আদর্শ দিতে পারছি, যাদের কাজ নেই। কাজ না থাকায় তারা মাদকাসক্ত হচ্ছে ও ড্রাগ নিচ্ছে এবং আইএসের সদস্য হচ্ছে।
আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রশ্নে পোপ ফ্রান্সিস খোলামেলা বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং তার অনুসারীদের কাছে সে হিসেবেই পরিচিত। তাই মুসলমানরা কখনই সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে না। আমাদের দেশের একশ্রেণীর ইসলামবিদ্বেষী আঁতেল ও হীনমন্যতাগ্রস্থ বুদ্ধিজীবী সমাজের সন্ত্রাসসহ সকল অঘটনের জন্য ইসলামকে দায়ী করে যেখানে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর গিলতে অভ্যস্ত সেখানে পোপ ফ্রান্সিসের এই বাস্তবধর্মী বক্তব্য থেকে তাদের অনেক কিছু শিক্ষা গ্রহণের রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তাদের এটাও বুঝতে বাকি আছে যে, নিজেদের যা ঐতিহ্য ও গৌরবের তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না জন্মাতে পারলে দেশ জাতি বা মানবতা কোনো ক্ষেত্রেই তাদের কারো কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সম্ভব হবে না। সুদূর ইউরোপে অবস্থান করেও পোপ ফ্রান্সিস যেখানে অনুধাবন করতে সক্ষম হন যে, ইসলাম শান্তির ধর্ম, অথচ এদেশেরই খেয়েপরে বড় হয়ে যারা ইসলামের মহত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন অষ্টাদশ শতকের বাঙালি কবি আবদুল হাকিমের ভাষায় বলতে হয়, ‘ সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ কিন্তু আমরা তা বলতে চাই না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন