অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে চাঞ্চল্যকর মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ, ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও এসআই নন্দ দুলাল এখন রিমান্ডে। গতকাল সকালে সাড়ে ১১টায় কক্সবাজার কারাগার থেকে মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাব তাদেরকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে।
জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদে ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত কিছু কিছু বিষয়ে মুখ খুলতে না চাইলেও র্যাবের কাছে ইতোমধ্যে সব বিষয়ে পরিষ্কার হয়েছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে ওসি প্রদীপ ইতোপূর্বে তার বেপরোয়া কর্মকান্ডের জন্য মর্মাহত। প্রদীপের ছায়ায় বেড়ে ওঠা লিয়াকত-নন্দও ভেঙে পড়েছে। গতকাল র্যাব হেফাজতে নেয়ার সময় ওসি প্রদীপের হাতকড়া পরা ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হলে সর্বত্রই আলোচনার সৃষ্টি হয়।
এদিকে মেজর (অব.) সিনহা হত্যার ঘটনায় সবকটি মামলার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ। গত সোমবার রাতে কক্সবাজারের আর্মি রিসোর্টে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন র্যাবের হাতে আসলে ওই প্রতিবেদনের সব তথ্য, উপাত্ত আমলে নিয়ে যাচাই-বাছাই করে তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তিনি বলেন, র্যাব নিজস্ব গতিতে সততা ও বস্তুনিষ্ঠতা দিয়ে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যা মামলার তদন্ত করছে। এর আগে, গত সোমবার বিকেলে টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুরে মেজর সিনহা হত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
ওসি প্রদীপসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে আরো একটি হত্যা মামলা : পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে আরো পাঁচ লাখ টাকা না দেয়ায় বন্দুকযুদ্ধের নামে টেকনাফের হ্নীলার সাদ্দাম হোসেন নামে এক যুবককে হত্যার অভিযোগে ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে কক্সবাজার আদালতে।
গতকাল বিকাল পৌঁনে ৪টায় নিহত সাদ্দাম হোসেনের মা গুল চেহেরের দায়ের করা ফৌজদারি এজাহারটি জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলা হিসেবে রুজু করেছেন। আদালতের বিচারক হেলাল উদ্দীন ফৌজদারি এজাহার আমলে নিয়ে তা তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলায় হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মশিউর রহমানকে প্রধান আসামি ও ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ২ নম্বর আসামি করা হয়েছে। মোট ২৮ আসামির মধ্যে ২৭ জনই পুলিশ সদস্য। অন্যজন হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের দফাদার নূরুল আমিন। বাদীপক্ষের আইনজীবী ইনসাফুর রহমান সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান।
এসপি, ওসি প্রদীপসহ ৮ জনের ব্যাংক হিসাব স্থগিত : সিনহা হত্যায় সম্পৃক্ততা সন্দেহে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন, টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ এসআই লিয়াকত আলী, প্রদীপের স্ত্রী চুমকী কারান, প্রতীম কুমার দাশ, প্রতুশ কুমার দাশ, দিলীপ ও ইলিয়াস কোবরা এই ৮ জনের ব্যাংক হিসাব ৩০ দিনের জন্য স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
গত সোমবার দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একটি চিঠি পাঠিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিএফআইইউ থেকে। একইসঙ্গে চিঠি ইস্যু করার দিন থেকে তিনদিনের মধ্যে স্থগিত করা হিসাবগুলোর নাম, নম্বর, স্থিতি এ সংক্রান্ত তথ্যাদি (হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি প্রোফাইল ফরম, হালনাগাদ লেনদেনের বিবরণী) পাঠাতে বলা হয়েছে ব্যাংকগুলোকে।
তিন এপিবিএন সদস্য গ্রেফতার : এদিকে গত ৩১ জুলাই সিনহা হত্যার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত তিন এপিবিএন সদস্যকে আটক করা হয়েছে। সিনহা হত্যা মামলায় গতকাল তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। সকালে তাদের টেকনাফ কোর্টের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারার আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ওই তিনজন হলেন- এপিবিএনের সাব-ইন্সপেক্টর শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও কনস্টেবল মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। সিনহা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খাইরুল ইসলাম জানান, তাদেরকে সুবিধামত সময়ে রিমান্ডে নেয়া হবে।
বিচার দাবি করলেন শিপ্রা দেবনাথ : মেজর (অব.) সিনহাকে পুলিশ অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে বলে এই খুনের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন নিহত সিনহার টিম সদস্য শিপ্রা দেবনাথ। ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতকে মেজর সিনহা হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে তাদের বিচার দাবি করেছেন শিপ্রা দেবনাথ। একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে শিপ্রা বলেছেন, মেজর সিনহার মত একজন চমৎকার মানুষকে ওসি প্রদীপ-লিয়াকত অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সেদিন হত্যা করেছে। তিনি এই হত্যাকান্ডের বিচার চান। এছাড়াও তিনি বলেন, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে অন্যায়ভাবে কারাগারে পাঠিয়েছিল। কক্সবাজার কারাগারে শত শত নারী পুরুষ তিনি দেখেছেন ওসি প্রদীপের জিঘাংসার শিকার হয়ে কারা ভোগ করছেন। তাদের স্বজনরা ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের হাতে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। তিনি প্রদীপ-লিয়াকতের সব অপকর্মেরও তদন্তের দাবি জানান।
উল্লেখ্য, মেজর সিনহা হত্যা মামলার আরো ৭ আসামিকে র্যাব নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। গতকাল ওসি প্রদীপ, ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও এসআই নন্দ দুলালকে হেফাজতে নিয়েছেন। ইতোপূর্বে আদালত চাঞ্চল্যকর সিনহা হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া ১৩ আসামির সকলের ৭ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন