সৌমিত্র চক্রবর্তী, সীতাকু- (চট্টগ্রাম) থেকে : লতায় ঝুলে থাকা সবুজ শিমগুলোর গায়ে লাল বিন্দু চিহ্ন, পাতা হলদে হয়ে কুঁকড়ে গেছে। কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা শিম ক্ষেতের এই করুণ অবস্থা দেখে হতাশ হয়ে পড়েছেন চাষি নিজাম উদ্দিন। এই রোগ থেকে ক্ষেত রক্ষা করতে অনেক ধরনের ওষুধ ব্যবহার করলেও কোনো সুফল মেলেনি। বরং দিন দিন অজ্ঞাত এই রোগ যেন আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে এই রোগ প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই বলেই ধারণা জন্মেছে তার। তাই রোগ যেন একটি পাতা বা শিম থেকে অন্য পাতা বা গাছে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে লক্ষ্যে হলদে হয়ে যাওয়া পাতা আর লাল দাগ পড়ে যাওয়া শিমগুলো দ্রুত তুলে ফেলছেন তিনি। গত সোমবার সীতাকু- পৌর সদরের শেখপাড়া এলাকায় অবস্থিত তার ক্ষেতে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা গেছে। এ সময় শিম চাষের অবস্থা জানতে চাইলে রোগাক্রান্ত গাছের হলদে পাতা ও শিমগুলো দেখিয়ে নিজাম উদ্দিন বলেন, এবার শিম চাষিরা মোটেও ভালো নেই। মৌসুমের প্রথম দিকে কয়েক দিন রোগব্যাধি না থাকলেও কিছু দিন ধরে গাছের পাতাগুলো হলদে হয়ে ঝরে যাচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে প্রচুর শিম। আবার অনেকগুলোর গায়ে লাল লাল ছোট ছোট বিন্দু আকার ধারণ করে বিক্রির অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ফলে আশানুরূপ পরিমাণ শিম বিক্রি তো সম্ভব হচ্ছেই না, উল্টো ব্যাপক লোকসানে পড়ছেন তারা। কৃষক নিজাম আরও জানান, দীর্ঘদিন ধরে তিনি শিম চাষ করেন। এবার ১৬০ শতক জমিতে শিম চাষ করেছেন। অক্টোবরে শিমের বীজ রোপণ করেন। এই জমি চাষ করতে তার খরচ পড়েছে প্রায় ৯৫ হাজার টাকা। কঠোর পরিশ্রমে গাছগুলো ফলনের উপযুক্ত হয়। ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে শিম তোলা শুরু হয়। প্রথম দিকে প্রতি কেজি শিম পাইকারি দরে ৩০ টাকাও বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন সেই দাম নেই। প্রতি কেজি বড়জোড় ১৪-১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যেই রোগে শিম ও ক্ষেতের বেহাল দশা হয়ে গেছে। নিজাম বলেন, সীতাকু- পাহাড়ে নির্দিষ্ট মৌসুমের কিছু আগেই শিম চাষ হয়। ফলে মৌসুমের আগের শিমগুলো পাহাড়ের চাষিরাই বিক্রি করে লাভবান হতে পারেন। পাহাড়ি চাষিরা যখন শিম চাষ করেন তখন সমতল ভূমিতে ধান চাষ থাকে। ফলে এখানকার চাষিরা ধান উঠে যাওয়ার পর অক্টোবরের দিকে শিম রোপণ করেন। এ কারণে তাদের ফলন তুলতে হয় কিছুটা দেরিতে। এই কাতারে পড়েন তিনিও। এ জন্য মৌসুম শুরুতে যে ভালো দাম থাকে সে সুবিধা নিতে পারেন না সমতল ভূমির কৃষকরা। তার ওপর যদি রোগবালাই কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয় তাহলে তো কথাই নেই। দুই বছর ধরে লাভের মুখ দেখছেন না জানিয়ে কৃষক নিজাম বলেন, যখন ক্ষেতে রোগবালাই হয় তখন কৃষি কর্মকর্তাদের পাওয়া যায় না। তারা একেবারেই ক্ষেতে আসতে চান না। আপনারা (প্রতিবেদক) যেমন হঠাৎ করে এসেছেন তেমনি তারাও হঠাৎ কখন আসেন আবার চলে যান জানি না। অধিকাংশ কৃষকই তাদের কোনো সহযোগিতা বা পরামর্শ পান না। এ কারণে কৃষকরা নিজের অভিজ্ঞতায় কীটনাশক কিংবা বালাই নাশক ব্যবহার করেন। এতে কখনো সুফল আসে আবার বেশির ভাগ সময় আসে না। এবার খরচ উঠবে না বলে তিনি মনে করেন। একই অভিযোগ করেন, ওই এলাকার অপর চাষি মো. হাশেম। তিনিও কৃষি কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কথা উল্লেখ করে বলেন, কুয়াশা ও আবহাওয়া পরিবর্তনে শিম গাছের পাতা মরা ও শিমে দাগ লেগে যাওয়ার এই রোগ হয়। এই রোগ থেকে বাঁচতে আমরা ডিকলার, চাঙর, সানসিট, ভিটামিনসহ নানারকম ওষুধ দিয়েছি। কোনো লাভ হয়নি। এই এলাকার প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেতেই এ রোগ হয়েছে বলে জানান তিনি। তাই সব কৃষকই এবার লাভের বদলে লোকসানের শিকার হবেন বলে তাদের অভিমত। এদিকে শুধু শেখপাড়া নয়, এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলার নুনাছরাসহ পৌর সদর, মুরাদপুর, বাড়বকু-সহ অন্যান্য স্থানেও। সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার উপজেলায় ২৫০০ হেক্টর জমিতে ২৪ হাজার ৫০০ কৃষক শিম চাষ করেছিলেন লাভের আশায়। কিন্তু এই রোগে তাদের মধ্যে একটি অংশই ক্ষতিগ্রস্ত বলে কৃষকরা জানান। অবশ্য এ ব্যাপারে কৃষকদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুশান্ত সাহা। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, শিমের পাতা হলদে হয়ে শুকিয়ে যাওয়া এবং শিমের ওপর দাগ পড়ে যাওয়াটা ভাইরাস জনিত রোগ। কৃষকরা এসব বিষয়ে আমাদের কাছে জানতে চাইলে আমরা পরামর্শ দিয়ে থাকি। শিম ক্ষেতে এ রোগ হয়েছে বলে স্বীকার করলেও তার দাবি, সবখানে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়নি। আর কৃষকদের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা কদাচিৎ মাঠে যাই এ কথা ঠিক নয়। প্রায়ই মাঠে গিয়ে কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের নানা পরামর্শ দেন দাবি করে তিনি বলেন, এরপরও কিছু কিছু কৃষক এসব অভিযোগ করেন কেন জানি না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন