মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

নির্বাচন ২০১৬ : হিলারি বনাম ট্রাম্প : আই বল টু আই বল

প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

॥ মোবায়েদুর রহমান ॥
লড়াইটা জমে উঠেছে ভালো। এক দিকে হিলারি রডহ্যাম ক্লিন্টন। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প। নারীর ক্ষমতায়ন ইস্যুটি নিয়ে আমেরিকা শুধু নিজের দেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী সোচ্চার। অথচ তাদের ২৮৪ বছরের ইতিহাসে তারা একজন নারীকেও প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেয়নি। এই প্রথম তারা ২৮৪ বছর পর হিলারি রডহ্যাম নামের এক নারীকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য মনোনয়ন দিল। অথচ এই উপমহাদেশে অনেক আগেই সেই অর্থে নারীদের ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। ৭০ দশকেই ভারতের মত বিশাল দেশে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হন। পরে প্রতিভা পাতিল ভারতের প্রেসিডেন্ট হন। পাকিস্তানের মত একটি রক্ষণশীল সমাজেও বেনজির ভুট্টোর মত নারী সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। পরবর্তীতে একজন নারী পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার হন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সকলকে টেক্কা মেরেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের দুই প্রধান হলেন নারী। তারা হলেনÑ শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া। জাতীয় সংসদের স্পিকার একজন নারী। তিনি হলেন শিরিন শারমিন চৌধুরী। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা একজন নারী। তিনি হলেন বেগম রওশন এরশাদ। জাতীয় সংসদে সরকারি দলের ডেপুটি লিডার একজন নারী। তিনি হলেন বেগম সাজেদা চৌধুরী।
যাই হোক, হিলারি ক্লিন্টনকে তো নমিনেশন দেওয়া হয়েছে। আজ থেকে তিন মাস পর অর্থাৎ চলতি সালের ৮ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। হিলারি কি ঐ ইলেকশনে জয় লাভ করতে পারবেন? হিলারির প্রতিদ্বন্দ্বী একজন শক্ত ক্যান্ডিডেট। আপাদমস্তক তিনি একজন ব্যবসায়ী। তবে রাজনীতিতে একেবারে নতুন। নতুন হলে কি হবে? রাজনীতিতে নেমেই একেবারে বাজিমাত করেছেন। সিনিয়র রিপাবলিকানদের ধরাসায়ী করে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য মনোনয়নটি বাগিয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা লিখতে গিয়ে রিপাবলিকান পার্টি থেকে আরেকজন প্রেসিডেনসিয়াল ক্যান্ডিডেটের নাম মনে পড়ছে। তার নাম সিনেটর ব্যারি গোল্ডওয়াটার। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন লিন্ডন বি জনসন। প্রেসিডেন্ট কেনেডি নিহত হওয়ার পর জনসন প্রেসিডেন্ট হন। এক বছর পরেই অর্থাৎ ১৯৬৪ সালে নির্ধারিত ছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়। ডেমোক্র্যাটদের তরফ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় লিন্ডন বি জনসনকে। আর রিপাবলিকানদের তরফ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় ব্যারি গোল্ডওয়াটারকে। এগুলো আজ থেকে ৫২ বছর আগের কথা। কালের রথ চক্র এগিয়ে চলে। আজ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেখে ৫২ বছর আগের ব্যারি গোল্ডওয়াটারকে মনে পড়ছে।
গোল্ডওয়াটার ছিলেন মার্কিন রক্ষণশীলতা পুনরুত্থানের মুখর প্রবক্তা। আমেরিকার এই সিনেটর রাজনীতিতে আসার পূর্বে সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। প্রথমে ছিলেন সেনাবাহিনীতে। পরবর্তীতে বিমান বাহিনীতে। তিনি ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। এক দিকে ধর্মীয় ও সামাজিক রক্ষণশীলতার পক্ষে যেমন কথা বলতেন তেমনি তিনি মার্কিন নারীদের গর্ভপাত, সমকামীতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করারও ছিলেন মুখর প্রবক্তা। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে ধর্মের অবশ্যই একটি ভূমিকা থাকবে এ কথাটি তিনি অত্যন্ত জোরের সাথে বলতেন। অ্যারিজোনা থেকে তিনি ৫ বার সিনেটর নির্বাচিত হন। অথচ ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মি. জনসনের কাছে তিনি বিপুল ভোটে পরাস্ত হন। তার পিতা ছিলেন একজন ইহুদি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গেলে কি হবে, মার্কিন রাজনীতিতে তিনি সব সময়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন যখন ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন তখন গোল্ডওয়াটার নিক্সনকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন যে এই কেলেঙ্কারির পর তার অর্থাৎ নিক্সনের পদত্যাগ করা উচিৎ। এবং তার কথা শুনেছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। ১৯৭৪ সালে তিনি পদত্যাগ করেন।

ব্যারি গোল্ডওয়াটারকে বলা হতো যুদ্ধবাজ। আমেরিকাকে শ্রেষ্ঠ জাতি প্রমাণ করার জন্য পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে যে কোন সময় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। সেখান থেকেই দুটি শব্দের উৎপত্তি হয়। একটি হলো Hawk অর্থাৎ বাজপাখি। আরেকটি হলো Dove অর্থাৎ কবুতর। গোল্ডওয়াটার ছিলেন বাজপাখি আর জনসন ছিলেন কবুতর বা শান্তির প্রতীক। মার্কিনিরা যুদ্ধবাজ। তারপরেও কিন্তু গোল্ডওয়াটার বিপুল ভোটে শান্তিবাদী জনজনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালের সেই একই নির্বাচনী ফলাফলের পুনরাবৃত্তি কি ঘটবে ২০১৬ সালে? এটি নিয়ে এখন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে চলছে দারুণ জল্পনা-কল্পনা।

॥ দুই ॥
অথচ বাস্তব ঠিক সে কথা বলছে না। এখন পর্যন্ত অর্থাৎ আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত হিলারি ক্লিন্টন ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে মাত্র ৯ পয়েন্ট এগিয়ে। অথচ অবস্থাটা সম্পূর্ণ উল্টো হওয়ার কথা ছিল। এখনো ইলেকশানের তিন মাস অবশিষ্ট রয়েছে। এরমধ্যে পরিস্থিতি পাল্টেও যেতে পারে। তর্কের খাতিরে বলছি যে যদি শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরেও যান তার জন্য একক ভাবে দায়ী হবেন ট্রাম্প নিজে। রিপাবলিকান পার্টি সেক্ষেত্রে দায়ী হবে না। কারণ অন্তত তিনটি বিষয়ে ট্রাম্প এমন উল্টা পাল্টা কথা বলেছেন, যার জন্য সাধারণ ভোটাররা তো দূরের কথা, তার নিজের দলের বড় বড় নেতারাই তার ওপর চটে আছেন। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়। তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেই বিষয়গুলো নিম্নরূপ :

সিনেট                        ১০০
প্রতিনিধি পরিষদ          ৪৩৫
কলাম্বিয়া জেলা বা
ওয়াশিংটন ডিসি            ৩
-------------------------------
মোট                           ৫৩৮
জনসংখ্যার নৃ-তাত্ত্বিক গঠন : বর্তমানে মার্কিন জনগণের ৬৮ শতাংশই হল শ্বেতাঙ্গ। ১৭ শতাংশ হিস্প্যানিক। ১৪ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ (আফ্রিকান আমেরিকান)। আর ১ শতাংশ হলো দক্ষিণ এশীয় (অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত)। হিস্প্যানিকদের বিরুদ্ধে বিশেষ করে মেক্সিকানদের বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন তার ফলে মেক্সিকান তথা হিস্প্যানিকদের ভোট মোটামুটি তার বিপক্ষে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অবৈধ ইমিগ্রান্ট বা অভিবাসীদেরকে বিতাড়িত করা হবে এবং নতুন কোন ইমিগ্রান্টকে অত সহজে আর রেসিডেন্সি দেওয়া হবে না বলে ট্রাম্প যে সব কথা বলে বেড়াচ্ছেন তার ফলে কৃষ্ণাঙ্গ ১৪ শতাংশের অধিকাংশের ভোট তিনি পাবেন বলে মনে হয় না। আর এই উপমহাদেশ বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের কথা? অ্যারিজোন, আলাবামা, নিউইয়র্ক, মেরিল্যান্ড, পেনসিলভানিয়া, ফিলাডেলফিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া প্রভৃতি স্থানে কিছু কিছু বাঙালির সাথে আমার যোগাযোগ হয়। এরা তো আমাকে বলেন যে, পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশিরা হিলারিকে জেতাবার জন্য নাকি জান কবুল করেছেন। তবে ইন্ডিয়ান আমেরিকানদের মাঝে ভোটের ব্যাপারে বিভাজন রয়েছে। একটি অংশ ট্রাম্পকে চান। আরেকটি অংশ হিলারিকে চান। মোট কথা ট্রাম্পকে প্রধানত নির্ভর করতে হবে ৬৮ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের ভোটের ওপর।
শুধুমাত্র এই শ্বেতাঙ্গদের ভোটের ওপর নির্ভর করেই কি ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন? অনেকেই মনে করেন, পারবেন না। গত দুই নির্বাচনে ওবামার বিরুদ্ধে জন ম্যাককেইন ও মিট রমনি শ্বেত মানুষের ভোট পকেটস্থ করেও জিততে পারেননি। ২০১২ সালে ওবামা রমনিকে হারিয়েছিলেন ৫০ লাখ ভোটে, যার ৩৯ শতাংশ ছিল শ্বেতকায়। ওবামার জয়ের পেছনে বড় শক্তি ছিল আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্প্যানিকদের বিপুল সমর্থন। ট্রাম্পের পক্ষে শুধু ম্যাককেইন-রমনির ভোটারদের দিয়ে জেতা সম্ভব হবে না, তার প্রয়োজন পড়বে আরও ৫০ বা ৬০ লাখ অতিরিক্ত ভোট। ট্রাম্প বাজি ধরেছেন, উইসকনসিন, পেনসিলভানিয়া ও ওহাইওর মতো শ্বেতপ্রধান অঙ্গরাজ্য থেকে এই অতিরিক্ত ভোট ছিনিয়ে আনবেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নিবন্ধিত ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। তিনি পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। নিবন্ধিত ভোটাররা প্রতিটি অঙ্গ রাজ্যে নির্ধারিত কোটা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। এই প্রতিনিধিবৃন্দকে বলা হয় নির্বাচক ম-লী বা ইলেকটোরাল কলেজ। এই নির্বাচক ম-লী ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করেন। নির্বাচক ম-লীর সংখ্যা সিনেট, প্রতিনিধি পরিষদ এবং কলাম্বিয়া জেলা বা ওয়াশিংটন ডিসি থেকে নির্বাচিত মোট সদস্যের সমান। এসব সদস্যের সংখ্যা নিম্নরূপ :
যেসব প্রতিনিধি বা নির্বাচক ম-লী ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করবেন তাদের সংখ্যাও ৫৩৮ এবং সেটি ওপরে উল্লেখিত তিন ক্যাটেগরি অনুযায়ী। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে ৫৩৮ জন নির্বাচক ম-লীর মধ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হবে। এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হলো ২৭০টি ভোট। এখন যদি এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যে কোন প্রার্থীই নির্বাচক ম-লীর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট অর্থাৎ ২৭০টি ভোট পেলেন না তাহলে কি ঘটবে? ঐ সব দেশে আইনের বাইরে কেউ যেতে পারেন না। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বলেছেন যে নির্বাচনে ভোটের কারচুপি ঘটতে পারে সেটিও পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। ২৮৪ বছর ধরে আমেরিকায় ইলেকশন হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৪৭ জন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। একটি বারের জন্যও কেউ কোন কারচুপির অভিযোগ করেননি। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়া মাত্রই পরাজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীকে ‘মাই প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে সম্বোধন করেছেন এবং নির্বাচনী ফলাফল মেনে নিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বরং ঐ ধরনের আশঙ্কা করে নিজের পজিশন অনেক খারাপ করেছেন।

যাই হোক, যদি কোন প্রার্থী ২৭০ ভোট না পান তাহলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য সংবিধানের দ্বাদশ অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে। দ্বাদশ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে যদি কোন প্রার্থী ২৭০ ভোট পেতে ব্যর্থ হন তাহলে প্রতিনিধি পরিষদের (House of Representatives)  ৪৩৫ জন সদস্যের ভোটে (অবশ্যই সংখ্যা গরিষ্ঠের ভোটে) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন এবং সিনেটের ১০০ সদস্যের ভোটে (অবশ্যই সংখ্যা গরিষ্ঠের ভোটে) ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।

এখানে আরেকটি পয়েন্ট উল্লেখ করতে চাই। আমেরিকার ১১টি অঙ্গরাজ্যকে ব্যাটল গ্রাউন্ড স্টেটস (Battle Ground States)  বলা হয়। আসলে এই ১১টি ব্যাটল গ্রাউন্ড স্টেটই নির্ধারণ করে, হোয়াইট হাউজ কার দখলে যাবে। এখন পর্যন্ত এই ব্যাটল গ্রাউন্ড স্টেট বা সুইং স্টেট হলো, কলোরাডো, ফ্লোরিডা, আইওয়া, মিসিগান, নেভাডা, নিউ হ্যামশায়ার, নর্থ ক্যারোলিনা, ওহায়ো, পেনসিলভানিয়া, ভার্জিনিয়া এবং উইসকনসিন।

Email : journalist15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন