পদ্মা নদীতে নাব্য সঙ্কটের কারণে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌপথে সাত দিন ধরে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে দুই ঘাট মিলিয়ে কয়েক হাজার যানবাহন আটকা পড়েছে। এদিকে, ঘাট বন্ধ থাকলেও ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে সমানে চলাচল করছে যানবাহন। এমনকি ঘাটে গিয়ে ফেরি বন্ধ দেখে শত শত গাড়ি আবার এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ফিরে আসছে। এতে করে এক্সপ্রেসওয়েতে বাড়তি গাড়ির চাপ পড়ছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, এভাবে যানবাহন চলাচল করলে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগেই ক্ষতির মুখে পড়বে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। এর আগে দুই প্রকল্পের সমন্বয়হীনতায় ক্ষতির মুখে পড়ে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগের নির্মাণ প্রকল্পের মাল ও বালিবাহী গাড়ির চলাচলে ইতোমধ্যে দেশের প্রথম ও ব্যয়বহুল এই এক্সপ্রেসওয়ের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নির্মাণাধীন রেলপথের অ্যামবেঙ্কমেন্টের কারণে পানি নিস্কাশনের পথ রুদ্ধ হওয়ায় এক্সপ্রেসওয়ের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই এক্সপ্রেসওয়েতে মাল ও বালিবাহী গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
গত ২৯ আগস্ট থেকে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি রুটে রাতে ফেরি বন্ধ এবং দিনে সীমিত আকারে ফেরি চলছিল। এরপর ৩০ আগস্ট লৌহজং টার্নিং চ্যানেল ফেরি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। গত ৩ সেপ্টেম্বর সকালে চ্যানেলের মুখে একটি ফেরি আটকে গেলে ঘাট কর্তৃপক্ষ ফেরি চলাচল পুরোপুরি বন্ধের নির্দেশ দেয়।
বিআইডব্লিউটিসি’র এজিএম মো. সফিকুল ইসলাম জানান, সবকটি চ্যানেলে নাব্য সঙ্কট থাকায় শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি রুটে ফেরি সার্ভিস বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে শিমুলিয়া ঘাট এবং মাদারীপুর অংশের কাঁঠালবাড়ি ঘাট মিলিয়ে হাজার হাজার গাড়ি এখন পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে শত শত পণ্যবাহী ট্রাকও রয়েছে। অন্যদিক, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ঘাট বন্ধ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই যানবাহনের চাপ বেড়েছে পাটুরিয়া- দৌলতদিয়া ঘটে। সেখানেও পারাপারের অপেক্ষায় শত শত যানবাহন আটকে আছে। এতে করে দুই ঘাটেই হাজার হাজার যাত্রী দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিএ’র সব চ্যানেল অচল থাকায় পদ্মা সেতুর নিজস্ব চ্যানেলে ছোট আকারের ফেরি চলছিল। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে সেই চ্যানেলও নাব্যতা হারায়; তাই পুরোপুরি ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। চ্যানলে নাব্যতা ফেরাতে ড্রেজিং চলছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, মঙ্গলবার থেকে ফেরি চালু হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। কিন্তু তা হয়নি। বরং গতকাল বুধবারও ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ঘাটের দুপাশেই হাজার হাজার গাড়ি আটকে থাকে। বিআইডব্লিউটিএ পদ্মায় পালের চর দিয়ে একটি চ্যানেল মার্কিং করেছে জানিয়ে সফিকুল বলেন, এতে সাড়ে ৯ কিলোমিটারের পথ ২৮ কিলোমিটার ঘুরে চাঁদপুরের কাছাকাছি হয়ে গন্তব্যে যেতে ফেরিগুলোর ৫ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। সেটিও প্রবল স্রোতের মধ্যে ঝুকিপূর্ণ; এতে দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
এদিকে, ঘাট বন্ধ থাকলেও ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে চালু রয়েছে। টোল ছাড়াই হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করছে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই মহাসড়ক দিয়ে। শিমুলিয়া ঘাট দিয়ে পারাপারের জন্য এসব যানবাহন গিয়ে আবার ফিরে আসছে। এতে করে এক্সপ্রেসওয়ের উপর বাড়তি চাপ পড়ছে। শুধু তাই নয়, এক্সপ্রেসওয়েতে শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। যে যার মতো করে দ্রতগতিতে চলে। এক গাড়ি আরেক গাড়িকে ওভারটেক করে। শত শত মোটরসাইকেল চলে বেপরোয়া গতিতে। যাত্রীবাহী লোকাল বাসও চলে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে। এতে করে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। বেপরোয়া যানবাহনের কারণে এক্সপ্রেসওয়ে চলাচলকারী প্রাইভেট কার বা জীপের যাত্রীরাও নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করেন না। ঢাকা-মাওয়া রুটে চলাচলকারী ইলিশ বাসের চালক ইয়াছিন বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে চলা এখন ঝুঁকির বিষয়। কেউ নিরাপদ নয়। কর্তৃপক্ষের উচিত কঠোর হওয়া। হাইওয়ে পুলিশ কঠোর হলেও এসব সমস্যা থাকতো না। কিন্তু তারা ঠিকমতো ডিউটি করে না। পদ্মা সেতু প্রকল্প দেখতে যাওয়া এক ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার এত টাকা খরচ করে এক্সপ্রেস করেছে পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচলের জন্য। পদ্মা সেতু চালুর আগে এটি খুলে দেয়া ঠিক হয়নি। এক্সপ্রেসওয়েতে চলার সময় নিয়ম-কানুন কেউ মানে না। সে কারণে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। চলতে আরামদায়ক হলেও এ মহাসড়কটি যাত্রীদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়।
৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুকে রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত করতে বাবুবাজার ও পোস্তগোলা সেতু থেকে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। গত মার্চে যান চলাচলের জন্য সড়কটি খুলে দেওয়া হয়। এর পাশে চীনের ঋণে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা থেকে মাওয়া-ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে, যা দেশের ১০টি অগ্রাধিকার প্রকল্পের একটি।
সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। চারলেনের এই মহাসড়কের দুই পাশে পাঁচ মিটার করে জায়গা ফাঁকা রেখে ধীরগতির যান চলাচলে নির্মাণ করা হয়েছে সার্ভিস লেন। মহাসড়কটির কোথাও সিগন্যালে পড়তে হয় না। সিগন্যাল এড়াতে নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচটি আন্ডারপাস। পাশের ‹ফিডার রোড› থেকে গাড়ি আসার সুযোগ নেই এক্সপ্রেসওয়েতে। পদ্মা সেতু চালু হলে মাত্র ৪০ মিনিটে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা যাওয়া যাবে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে। দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ঢাকা-মাওয়া-এক্সপ্রেসওয়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। এতে রিকশা, অটোরিকশাসহ ধীরগতির যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। নির্ধারিত স্থান ছাড়া এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি প্রবেশের সুযোগ নেই। পুরো ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে রয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনী। তবে কোনো কোনো অংশ এখনও নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আসেনি। ওই স্থানগুলো দিয়ে ঢুকে পড়ছে যানবাহন। সেগুলো আবার এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নেমে যাওয়ারও সুযোগ পাচ্ছে নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকার কারণে।
সওজ সূত্র জানায়, কয়েকটি অংশে বেষ্টনী খুলে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের মালামাল ও বালিবাহী ভারী গাড়ি চলাচল করত এক্সপ্রেসওয়েতে। গত ১১ জুন তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরে পাশের সার্ভিস লেন দিয়ে এসব গাড়ি চলতে শুরু করে। কিন্তু সার্ভিস লেন ভারী গাড়ি চলাচলের উপযোগী না হওয়ায় সড়কে ভাঙন দেখা দেয়। পরে সার্ভিস লেনেও মালমাল ও ভারী গাড়ির চলাচল বন্ধ করা দেওয়া হয়। কিন্তু বন্ধ করা হয়নি সাধারণ যানবাহন চলাচল। এ কারণেই এখন ক্রমে এক্সপ্রেসওয়ের উপর চাপ বাড়ছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে টোল নির্ধারণ করা হলে এত যানবাহন চলতো না। তাতে রাজস্বও আদায় হতো, ক্ষতির পরিমাণও কমতো। এখন যা হচ্ছে তাতে পদ্মা সেতু চালুর সময় এক্সপ্রেসওয়ে মেরামতের জন্য নতুন করে বরাদ্দ চাইতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন