গুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ, অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত এবং কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তার উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা আইনের শাসন সমুন্নত রাখার জন্যই আবশ্যক। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড হিসেবে অভিযুক্ত। আইন বলে ব্যক্তি যত বড় অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হোক না কেন তাকে আইনী প্রক্রিয়ায় বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি দিতে হবে, বিনা বিচারে হত্যা করা যাবে না। আইনের শাসন নিরঙ্কুশ করার জন্যই বিচারবহির্ভ‚ত হত্যা, গুম, আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যতন বন্ধ করা দরকার। আইনের দৃষ্টিতে সাজানো বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে হত্যা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নির্যাতন আইনের শাসনের সুস্পষ্ট লংঘন। ২০১৪ সালে ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি আলতামাশ কবীর ঢাকায় এক সেমিনারে বলেন, ‘বিচার বহির্ভ‚ত হত্যাকান্ড হলে বিচার বিভাগ আর রইল কোথায়? যারা আইন হাতে তুলে নেয়, অবশ্যই তাদের বিচার হওয়া উচিত’ (২৫ এপ্রিল ২০১৪, যায়যায়দিন)। বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে প্রাণ হারানোর ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বহু ঘটনাই সাজানো। ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক হীনস্বার্থ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু সদস্যদের অর্থলিপ্সা চরিতার্থে গুম, নির্যাতন, বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে হত্যার বহু অভিযোগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু সদস্যদের কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের সুযোগ ব্যবহার করে কন্ট্রাক্ট কিলিং, নির্যাতন, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের বহু ঘটনা চাউরও হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্তেও বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের কয়েকটি ঘটনা সাজানো বলে প্রমাণ হয়েছে। ড. মিজানুর রহমান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা তদন্তকালে কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বন্দুকযুদ্ধের পর নিহত ব্যক্তির পাশে পেট্রল বোমা রাখা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা বাহিনী থেকে বলা হয়, আইন শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা বাহিনী আটককৃতকে নিয়ে তার সহযোগীদের গ্রেফতার বা আটককৃতের তথ্যানুযায়ী অস্ত্র-মাদক দ্রব্য উদ্ধার অভিযানকালে আটকৃতের সহযোগীরা হামলা চালালে আত্মরক্ষার্থে আইন শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের গুলি চালাতে হয়। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে- এতে আটককৃতব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এ ব্যাখ্যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ। বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলোর গ্রহণযোগ্য তদন্ত হলে সন্দেহ থাকত না কারো মধ্যে, প্রশ্নও উঠত না। দেশে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ভয়াবহরূপ নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এ অপতৎপরতা বন্ধে ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ নামে একটি আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইনে বলা হয়েছে, বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার, গুম ও হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর দায় জড়িত কর্মকর্তাকে ব্যক্তিগতভাবে বহন করতে হবে। নিরাপত্তা বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশকে অজুহাত দেখিয়ে কেউ পার পাবেন না। বর্তমানের পাশাপাশি ভবিষ্যতেও নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ দিয়ে এ ধরনের ঘটনার বিচার হবে। নির্যাতিত ব্যক্তির পাশাপাশি তৃতীয় কোনো পক্ষও বিচার চাইতে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন। সাজানো ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে কাউকে হত্যা করা হলে তা অপরাধ গণ্য হবে এবং এ অপরাধে জড়িতদের শাস্তি পেতে হবে- এটা বিদ্যমান আইনও বলে। চারদলীয় জোট সরকার সন্ত্রাস দমনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর মাধ্যমে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ পরিচালনা করেছিল। ওই অপারেশন চলাকালেও যৌথ বাহিনীর সদস্যদের বিরূদ্ধে নির্যাতন ও ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ চলাকালে বিভিন্ন জনের উপর চালানো নির্যাতন, বিচারবহির্ভ‚ত হত্যার ঘটনাগুলোর দায় থেকে যৌথবাহিনীর সদস্যদের রেহাই দেয়ার জন্য চার দলীয় জোট সরকার দায়মুক্তি আইন প্রণয়ন করেছিল। আওয়ামী জোট ক্ষমতায় আসার পর এ আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করা হয়। রিট আবেদনটির শুনানি শেষে প্রদত্ত রায়ে অপারেশন ক্লিন হার্টের সময়ের বিতর্কিত কর্মকান্ডের দায়মুক্তি দেয়ার জন্য প্রণীত আইন অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত বলেছেন, ‘যৌথবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যৌথবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজে আইন হাতে তুলে নিতে পারে না। যৌথবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে কেউ যদি নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন তা হলে তা বেআইনি, অসাংবিধানিক ও নিন্দাযোগ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা মানবাধিকার লংঘনের সবচেয়ে জঘন্য রূপ। অপারেশন ক্লিন হার্ট-এর সময় যৌথবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা প্রতিকার চেয়ে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন। কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে হত্যা মানবাধিকার লংঘন, শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এ অপরাধের দায়মুক্তি দেয়ার সুযোগ নেই- এটাই ছিল এ রায়ের সারকথা। বিচারবহির্ভূত হত্যা কোনো দেশের আইনেই অ্যালাউ করে না। ভারতের সুপ্রীম কোর্ট এনকাউন্টার (কথিত বন্দুকযুদ্ধ) প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘প্রজাতন্ত্র নিজের সন্তান হত্যা করতে পারে না’। সুপ্রীম কোর্ট আরো বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী সন্দেহ হলেই কাউকে হত্যা করতে পারবে না।
গুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভ‚ত হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার সুযোগ নেই। গুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত, বিচার তামাদি হয় না। কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুক যুদ্ধ প্রশ্রয় দেয়া প্রকারান্তরে ‘লাইসেন্স টু কিলিং’ প্রদানেরই শামিল। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসাক)-এর তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ২৮ জুলাই পর্যন্ত দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটেছে ১৯৬টি। আগের বছরগুলোতেও বিচারবহির্ভূত হত্যার অসংখ্য অভিযোগ শোনা গেছে। রাষ্ট্রকে প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা ও আইনী অধিকার নিশ্চিত করতে হবে; এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। গুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতিটি অভিযোগের তদন্ত, তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে দায়ীদের বিচার আইনের শাসন সুদৃঢ়করণের জন্যই জরুরি।
লেখক: কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন