বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, উগ্রবাদ উত্থানের আশঙ্কা : গণতন্ত্র ও সুশাসনের সংকট

প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী

এক-এগারো পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর পর দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি পরিবর্তনের স্লোগান তুলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধসহ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সূত্রে সংঘটিত পুরনো সব হত্যাকা-ের বিচার করার উদ্যোগ নেয়। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক প্রতিটি হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার আইনের শাসনের মূল দাবি। কোনো সুষ্ঠু বিবেকবান মানুষ হত্যাকান্ড বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করতে পারে না। এ কারণেই বিচারের বাইরে থাকা ঘটনা যতই পুরনো হোক, তার বিচার শুরুর উদ্যোগকে সাধারণ মানুষ সব সময়ই স্বাগত জানায়। তবে বিচারের নামে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের তৎপরতা বিচারহীনতার সংস্কৃতির চেয়েও বড় ধরনের অবিচারের জন্ম দিতে পারে। এর মধ্য দিয়ে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার বদলে আরো বেশি কলঙ্কিত ও বিভক্ত করা হয়। একটি জাতি বহুধাবিভক্ত হলে সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়। বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশও যখন অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতি ও বেপরোয়া লুণ্ঠনের অর্থনীতি জাতির সামনে থাকা বিশাল সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিচ্ছে।
গত মাসের শেষদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে মতিহার ক্যাম্পাসে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। একজন প্রাজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে এভাবে কুপিয়ে মারার ঘটনা এটাই প্রথম নয়, সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনা এতটাই সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে যে, এসব ঘটনা এখন আর সমাজে তেমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে না। এখন ঠা-া মাথায় সাত খুনের আসামিকেও আদালতের বারান্দায় হাসিমুখে ফটোসেশন করতে দেখা যায়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের জানমালের হেফাজতের দায়িত্ব গ্রহণের পর জনগণের টাকায় কেনা ইউনিফর্ম, অস্ত্র, গাড়ি নিয়ে ভাড়াটিয়া খুনির ভূমিকা পালনের পরও খুনের আসামিরা পুলিশ হেফাজতে জামাই আদরে প্রতিপালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠতে দেখা যায়। অন্যদিকে হত্যাকা-ের সাথে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে বা অপরাধের ক্লু খুঁজে বের করতে না পারলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যত্রতত্র রাজনৈতিক নেতাদের মতো রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এভাবেই দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির কর্মকর্তার কারণে পুরো বাহিনীগুলো জনগণের কাছে বিতর্কিত হয়ে পড়ছে এবং জনগণের আস্থা হারাচ্ছে। কোনো দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সমাজের একটি বড় অংশের মানুষের আস্থা হারালে তাদের দ্বারা আইন-শৃঙ্খলার কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা, মানবাধিকারের সুরক্ষাসহ সভ্য সমাজের মানদ- হিসেবে পরিজ্ঞাত প্রতিটি স্তম্ভই একের পর এক ধসে যাচ্ছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম রায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায়ের প্রতি অনাস্থা ও অসন্তোষ থেকে সৃষ্ট শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের নেতা ইমরান এইচ সরকারের সেই আগের জৌলুস বা জনসমর্থনের ভিত্তি এখন আর নেই। এখন তাদের সভা-সমাবেশে মাত্র কয়েক ডজন থেকে শখানেক মানুষের বেশি উপস্থিতি দেখা যায় না। মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-িত একেকজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে পরে এখনো তাদেরকে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। সেই ইমরান এইচ সরকার সম্প্রতি এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে পুলিশি হেফাজতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী শিবির নেতার মৃত্যুকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- হিসেবে আখ্যায়িত করে লিখেছেন, ‘হ্যাঁ একজন শিবির নেতাকে হত্যা(?) করা হয়েছে বলে আমি জানি, আপনারা অনেকেই হয়তো খুশি হয়েছেন। আমি এও জানি এই হত্যার নিশানা হয়তো আপনার আমার দিকেও তাক করা আছে। আপনাকে কিংবা আমাকে হত্যার পরও খুনিরা কাউকে না কাউকে ঠিকই খুঁজে নেবে, যারা বৈধতা দেবে আমাদের হত্যার। আমি গভীরভাবে শঙ্কিত, তাই সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধেই উচ্চকিত।’ যে ইমরান সরকার অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের ফাঁসি ছাড়া আদালতের দেয়া অন্য কোনো শাস্তির আদেশ মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না অথবা এখনো প্রস্তুত নন, সেই ইমরান এইচ সরকার শিবির নেতা হাফিজুরসহ সাম্প্রতিক পুলিশ কাস্টডিতে ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের প্রতিক্রিয়ায় আরো লিখেন, ‘অবিচার দিয়ে কোনো দিনই সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সব হত্যা-গুম-খুন-ধর্ষণের বিচার চাই। এমনকি যদি বিচারবহির্ভূতভাবেও হত্যা করা হয় তারও বিচার চাই।’
দেশে বিচার নিয়ে যেমন বিচারহীনতার জোরালো অভিযোগ রয়েছে, একইভাবে বিচার চাওয়া এবং অপরাধের প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রেও এক ধরনের রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজির ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। ঘটনার পাত্র-পাত্রী বা ভিকটিম ভেদে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তৎপরতাও বদলে যেতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম বা সোহাগি জাহান তনু হত্যার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধনসহ কিছু গতানুগতিক কর্মসূচি পালিত হয়েছে। ব্যাপক জনমতের কারণে তা সরকারের ভিতকেও যেন নাড়িয়ে দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে কথিত জনরোষ থেকে বাঁচাতে একজন সংসদ সদস্যের আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে তাকে কান ধরে উঠবোস করানোর ঘটনায় মানুষের সংক্ষোভ যেন সেসব হত্যাকা-ের চেয়েও অনেক বেশি। একটি অবিচার দিয়ে যেমন ন্যায়বিচারকে জাস্টিফাই করা যায় না, তেমনি একটি অপকর্ম দিয়ে আরেকটি অপকর্মকে জাস্টিফাই করা সমীচীন নয়। একজন শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা অক্ষুণœ রাখার পক্ষে দেশের সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সমর্থন থাকবে। তবে একজন পরিমল জয়ধর যদি ছাত্রী ধর্ষণের দায়ে অথবা শ্যামলকান্তি যদি ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গণরোষের শিকার হন, যুথবদ্ধ সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিকে রক্ষা করা সম্ভব হলেও এর ফলে জনগণের আস্থাহীনতার আঁচ পুরো শিক্ষক সমাজের বুকেই লাগে। ছাত্রকে মারধর করার সময় শ্যামলকান্তি ভক্ত ইসলাম অবমাননাকর কিছু বলেছেন কি বলেননি, সে প্রসঙ্গে উভয় রকম কথার অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও এটা তো বাস্তব যে তিনি একজন ছাত্রের জামার কলার চেপে ধরে পিটিয়েছেন, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে নিষিদ্ধ। তবে ছাত্রকে পেটানো বা শিক্ষককে লাঞ্ছনার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া যখন কুপিয়ে শিক্ষক হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল লোপাটের মতো ঘটনার চেয়েও বেশি প্রচার-প্রচারণা লাভ করে তখন অনেকেই এসব প্রতিক্রিয়া ও তৎপরতাকে কোনো মহলের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রয়াস বলে সন্দেহ করেন। গত সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক অতি উৎসাহী মানুষকে নিজের কানে ধরে ছবি তুলে ফটোসেশন করে গণমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে তোলপাড় তোলার সময়েই ধামরাইয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার হাতে একজন শিক্ষিকা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার পরও তাদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। কোনো শিক্ষক সংগঠন বা নারীবাদী সংস্থাও শিক্ষিকা অবমাননার ঘটনা নিয়ে মাঠ গরম করতে যায়নি। ঘটনা ও তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এই বৈপরীত্য জাতির সামনে হতাশাজনক ও বিভ্রান্তিকর বার্তা তুলে ধরে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এক অরাজক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টির দাবি তুলেছিলেন সাংবাদিক নির্মল সেন। নির্মল সেন ইতিমধ্যে গত হয়েছেন, তবে দেশের মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পায়নি। লুটপাট-বিশৃঙ্খলা, দুর্ভিক্ষপীড়িত তলাবিহীন ঝুড়ির অবস্থা থেকে বাংলাদেশ এক সময় ‘এশিয়ান টাইগার’ এবং বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত অগ্রসরমান মধ্য আয়ের সম্ভাবনাময় বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার পরও সমাজের কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি বা ন্যূনতম সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কেন? এখন প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ অস্বাভাবিকভাবে হত্যাকা-, গুম-অপহরণ ও অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছে। একেকটি হত্যাকা- বা অস্বাভাবিক নাশকতার ঘটনার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ আখ্যায়িত করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় আত্মতুষ্টির ঢেঁকুর তোলতে দেখা যায়। কখনো কখনো বিদেশি নাগরিক খুন অথবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশের হাতে মাদরাসা ছাত্র হত্যা কিংবা বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর মতো স্থানীয় গণবিস্ফোরণের সৃষ্টি হলে তার পেছনে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজা হয়। এ ধরনের প্রায় প্রতিটি ঘটনার পর শতশত মানুষকে নাশকতা মামলার আসামি বানিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানি ও গ্রেফতার বাণিজ্যের শিকারে পরিণত করা হয়। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একশ্রেণীর মানুষ জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি একশ্রেণীর সরকারি আমলা এবং পুলিশ কর্মকর্তাও কিকব্যাক, ঘুষ, গ্রেফতারবাণিজ্য ও দখলবাজি করে অগাধ সম্পদের মালিক হয়ে বিদেশে সেকেন্ড হোম বানাচ্ছেন অথবা অবৈধ পন্থায় বিনিয়োগের নামে টাকা পাচার করছেন। দেশের এহেন বাস্তবতায় জনমানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রায় প্রতিদিনই নানাভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ পরের কথা, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল জননিরাপত্তার বিষয়গুলোকে রাজনৈতিক রং চড়ানোর বাইরে উদ্ভূত পরিস্থিতি স্বীকার করতেও যেন নারাজ।
দেশের আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে শর্ষের ভূত তাড়ানোর দাবি উঠছে শুরু থেকেই। ডিবি পরিচয়ে কথিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাদা পোশাকে সাধারণ মানুষের বাড়িতে হানা দিয়ে আটকের পর অসংখ্য অপমৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যতই দিন যাচ্ছে জননিরাপত্তা যেন ততই নাজুক হয়ে উঠছে, সেই সাথে মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা যতই বাড়ছে সাধারণ মানুষের চেতনা যেন দিন দিন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ বছর আগে ঝালকাঠির এক গ্রামে লিমন হোসেন নামের যুবককে মিথ্যা অভিযোগে আটক করার পর র‌্যাব সদস্যরা তার পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়। এ ঘটনা নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো অনেক দিন গণমাধ্যমে শোরগোল জিইয়ে রেখেছিল। ঘটনার পর লিমনের মা বাদী হয়ে ৬ র‌্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে ঝালকাঠি আদালতে মামলা করেছিলেন। মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা অভিযুক্ত র‌্যাব সদস্যদের অব্যাহতি দিয়ে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছিলেন। সেই সাথে গুলিতে পা হারানো লিমনের বিরুদ্ধে অস্ত্রমামলাসহ একাধিক মামলা দিয়েছিল র‌্যাব। এর পরের ঘটনা প্রায় সবাই জানেন। গণমাধ্যম এবং দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তীক্ষè নজরদারির কারণে লিমনকে সব অভিযোগ থেকেই অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয় র‌্যাব। লিমনের মতো দুর্ভাগ্য অথবা সৌভাগ্য সবার জোটেনি। গত একযুগে র‌্যাবের বিরুদ্ধে অন্তত ৭০০ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে হয়তো এমন কিছু আছে যারা এক সময়ের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ওয়ানটেড অপরাধী। যারা বছরের পর বছর ধরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে অথবা পুলিশ ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে অপরাধ জগতে ধরাছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করছিল। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের শুরুতে অপারেশন ক্লিনহার্ট এবং র‌্যাব গঠনের পর সেসব দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা নানাভাবে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। তবে সেই থেকে শুরু এলিটফোর্সের বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- এখনো বন্ধ হয়নি। হত্যা ও গুমের অভিযুক্ত বাহিনীর সদস্য হিসেবে এখন পুলিশ এবং ডিবির নাম ক্রমবর্ধমান হারে যুক্ত হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত থেকে বিভিন্ন সময়ে সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আটক অভিযানের বিরুদ্ধে নির্দেশনা জারি করা হলেও আদালতের নির্দেশনা যেন থোরাই কেয়ার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সর্বশেষ গত সোমবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাদা পোশাকে, বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। সেই সাথে বহুল বিতর্কিত ৫৪ ধারায় পুলিশের গ্রেফতার দেখানোর আইনগত সুযোগও রহিত করেছে আদালত। সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় ঐতিহাসিক, মানবাধিকার রক্ষায় ইতিবাচক মাইলফলক।
ক্রমবর্ধমান হত্যাকা-, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, গুম-অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্তিত্বকেই বিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই অকার্যকর হয়ে গেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক কর্মকা- মুখ থুবড়ে পড়তে বসেছে। মূলত রাজনৈতিক-সামাজিক স্থিতিশীলতা, জননিরাপত্তাকে অগ্রাহ্য করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন যে অসম্ভব বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা এখন তলানিতে ঠেকেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি দেশের সাধারণ মানুষের যেমন আস্থা নেই, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়েছে। দেশের বৃহত্তম স্থানীয় সরকার নির্বাচন হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেই এই সত্য বেরিয়ে আসে। সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমের কর্মীরা যখন ঘোষিত অঘোষিত তথ্য নিষেধাজ্ঞা ও স্বাধীন মত প্রকাশকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন, তখন বিদেশি গণমাধ্যম সরকারের জন্য অপ্রিয় সত্যগুলো তুলে ধরতে দেখা যাচ্ছে। ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা এক নিবন্ধে বাংলাদেশে চলমান ধারাবাহিক হত্যাকা-ের মূলে সরকারের বিরোধী দল দমনকে দায়ী করেছেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক উড্রো উইলসন সেন্টারের সিনিয়র এনালিস্ট মাইলামের মতে বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়নের কারণে এখানে উগ্রপন্থিদের উত্থান ঘটেছে। তিনি আরো লিখেছেন, ২০১৪ সালের পর আওয়ামী লীগ কার্যত বাংলাদেশকে একদলের রাষ্ট্র বানিয়েছে। সরকারের কথিত আইন প্রয়োগের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো বিএনপি। ‘দ্য রিয়েল সোর্স অব টেরর ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের দীর্ঘ নিবন্ধে ঝানু কূটনীতিক লিখেন, ১৯৯০ পরবর্তী ক্ষমতাসীন এই দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি বরাবরই ‘পাওয়ার ট্রেডে ব্যস্ত থেকেছে’। বর্তমান সরকারের সময় তা সর্বোচ্চ মাত্রা লাভ করেছে। ক্ষমতায় যাওয়া এবং আঁকড়ে থাকার জন্য সরকার যেসব চাতুর্য ও অগণতান্ত্রিক কৌশল অবলম্বন করছে তা দেশের মানুষ এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আর ধামাচাপা থাকছে না। নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট বা গার্ডিয়ানের নিবন্ধে যেমন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি উঠে আসছে, একইভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাখ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যথার্থভাবেই দেশের বাস্তব অবস্থা বিশ্বের সামনে তুলে ধরছেন। দেশের সরকার বিরোধী দল দমনের সাথে সাথে আইনের শাসন ও বিরোধী মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমনে যেসব বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে তা দেশবাসীর কাছে এবং বিশ্বের কাছে অবিদিত থাকছে না। যত দ্রুত সম্ভব সরকার এ দুষ্টচক্রের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল হয়ে সুশাসন, আইনের শাসন ও জননিরাপত্তায় মনোযোগী হবে, দেশ ও জাতির ততই মঙ্গল। জননিরাপত্তা, সুশাসন, ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার সুরক্ষা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় উন্নয়নের মূল মানদ- হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব বিষয় অগ্রাহ্য করে কথিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের রাজনৈতিক গলাবাজি রাষ্ট্রকে ভয়াবহ অন্ধকারে ঠেলে দেবে।
bari_zamal@yahoo.com

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন