মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

প্রোপাগান্ডা ও যুদ্ধবাদী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নীরবতা ভাঙতে হবে

প্রকাশের সময় : ১০ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী

বিশ্ব কি আরেকটি (তৃতীয়) মহাযুদ্ধের সম্মুখীন হতে চলেছে? কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বার বার এই প্রশ্ন তুলে এনেছেন। পশ্চিমা সাংবাদিক-নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে জন পিলজার, পল ক্রেইগ রবার্টস, স্টিফেন কিনজার, আন্দ্রে ভিচেক, রবার্ট ফিস্কের মতো লেখকরা মার্কিন নেতৃত্বাধীন একটি বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতির চিত্রই তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নয়া বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সমরশক্তি ও তার ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিস্তৃতির প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপের প্রতি জন পিলজারের প্রখর নজরদারি ছিল এবং অদ্যাবধি তা অব্যাহত আছে। বস্তুনিষ্ঠ ও প্রামাণ্য সাংবাদিকতার জন্য বৃটেনে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিরল রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত পিলজার নিজের প্রজ্ঞাবান দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রখর লেখনী শক্তির পাশাপাশি যুদ্ধের ময়দানকে কোটি মানুষের সামনে হাজির করতে অর্ধশতাধিক ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেছেন। তার সর্বশেষ দুটি ডকুমেন্টারি ফিল্মের শিরোনাম ‘কামিং ওয়ার অন চায়না’। পরিচালক হিসেবে এটি তার ৬০তম চলচ্চিত্র। গত এপ্রিল মাসে আয়োজিত এক বিশেষ কনফারেন্সে জন পিলজার তার উপস্থাপিত বক্তব্যের শিরোনাম দিয়েছিলেন, ‘অ্যা ওয়ার্ল্ড ওয়ার হ্যাজ বিগান : ব্রেক দ্য সাইলেন্স’ (একটি মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছে : নীরবতা ভাঙতে হবে)। এই কনফারেন্সে তিনি নিজের তৈরি একটি ডকুমেন্টারি ফিল্মের রিভিউ করেছেন। সে ফিল্মটির শিরোনাম ‘দ্য ওয়ার ইউ ডোন্ট সি’। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে এই ডকুমেন্টারি ফিল্মটির পোস্টার হিসেবে শত্রুপক্ষের গুলিতে নিহত সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা একজন সৈনিকের লাশ। এই ছবিটি আমাদেরকে বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত সেই ফেলানীর আইকনিক ছবিটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বের দেশে দেশে শুরু হওয়া এই অন্যায্য যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিটি দেশের নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমের নীরবতা ভেঙে প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণের আহ্বানই ছিল পিলজারের বক্তব্যের প্রতিপাদ্য। বিশ শতকের প্রথমার্ধে দুটি মহাযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুকে জায়েজ করতে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা সুপরিকল্পিত প্রোপাগান্ডার আশ্রয় গ্রহণ করত। প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আরোপিত দেশপ্রেমের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হতো। এখন খ-িত প্রচারণার ওপর আর আস্থাশীল নয় যুদ্ধবাজ শাসকরা। তা ছাড়া এখন বছরের ৩৬৫ দিন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই সারা বিশ্বের নিউজ চ্যানেলগুলো সক্রিয় আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী ইহুদি নিধনযজ্ঞ জায়েজ করতে যে একতরফা জার্মান জাতীয়তাবাদী প্রোপাগান্ডার আশ্রয় নেয়া হয়েছিল, সেই হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসের কাছ থেকে শেখা পদ্ধতি আরো সুচারু ও সর্বগ্রাসী প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করছে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের ধ্বজাধারী করপোরেট মিডিয়াগুলো। প্যালেস্টাইনে, লেবাননে, ভিয়েতনামে, কম্বোডিয়ায়, দক্ষিণ সুদানে, আফগানিস্তানে, ইরাকে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায় অব্যাহত যুদ্ধ ও গণহত্যার ড্রাম বাজাচ্ছেন পেশাদার সাংবাদিক ও প্রচারকর্মীরা। চলমান অঘোষিত বা অদৃশ্য যুদ্ধ তথা আরেকটি মহাযুদ্ধের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজ এবং বিভ্রান্তির শিকার সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে নীরবতা ভাঙার আহ্বান জানিয়েছেন জন পিলজার।
বিগত শতকে নব্বই দশকের শুরুতেই সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বলয় ভেঙে পড়ার সাথে সাথেই সাবেক ওয়ারশ সামরিক জোটও ভেঙে দেয়া হয়। অর্থাৎ দুই পারমাণবিক পরাশক্তির মধ্যে দৃশ্যমান ঠা-া লড়াই অবসানের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে গেল। এ হিসেবে ন্যাটো জোট ভেঙে দেয়া বা এর কর্মকা- কমিয়ে আনাই ছিল বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের কাছে প্রত্যাশিত। আদতে এর বিপরীত চিত্রই বিশ্ববাসীর সামনে ফুটে উঠেছে। ঠা-া লড়াই শেষ হওয়ার পরই মূলত ন্যাটো তার আসল চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের পারমাণবিক ক্লাবে ঘোষিত অঘোষিতভাবে অন্তত ১০টি দেশের নাম উঠে এলেও আমরা জানি, এ যাবৎ শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই যুদ্ধে সরাসরি পারমাণবিক বোমা ফেলে জাপানের হিরোশিমা নাগাসাকি শহর দুটিকে ধ্বংস করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই বোমা ফেলে জাপানি সা¤্রাজ্যবাদের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের নতুন রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে নতুন মাত্রায় আবির্ভূত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সাল-পরবর্তী ১২ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মার্শাল ও বিকিনি দ্বীপে শত শত উন্মুক্ত পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালিয়ে এসব দ্বীপকে এটমিক ধ্বংসযজ্ঞ ও রেডিয়েশনের চিরস্থায়ী চারণক্ষেত্রে পরিণত করেছে। বার বছরে শুধুমাত্র মার্শাল আইল্যান্ডে পরীক্ষিত ৬৭টি মারমাণবিক বোমার সম্মিলিত শক্তির যোগফলকে বিভাজিত করলে তা প্রতিদিন হিরোশিমায় ফেলা বোমার চেয়ে বেশি। প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এসব দ্বীপ একসময় অর্থনৈতিক কর্মকা-ে প্রাণবন্ত থাকলেও দশকব্যাপী পারমাণবিক পরীক্ষার চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও মার্শাল দ্বীপে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ বাস করে। মার্কিনিদের ইচ্ছায় মার্শাল আইল্যান্ড স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেটি এখনো মার্কিন সামরিক বাহিনীর মিসাইল টেস্টিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তেজস্ক্রিয়তার কারণে সেখানকার অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে সেখানকার টিকে থাকা প্রাণী জগৎ এবং গাছপালার মধ্যে অস্বাভাবিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। শত শত পারমাণবিক পরীক্ষায় ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়তা আশপাশের দ্বীপ ও জনপদগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ডকুমেন্টারি ছবির চিত্রায়ণের প্রয়োজনে সেখানে গিয়ে পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা থেকে সৃষ্ট থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত অনেক নারী-পুরুষকে দেখতে পেয়েছেন জন পিলজার। সাবেক ঠা-া লড়াই থেকে যাওয়ার আগে থেকেই বিশ্বসম্প্রদায় পারমাণবিক বোমার সংখ্যা ও হুমকি কমিয়ে আনার পক্ষে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। এখানে বিশ্বসম্প্রদায় বলতে সাধারণ শান্তিকামী মানুষদের বোঝানো হচ্ছে। পশ্চিমা শাসকশ্রেণী এ বিশাল জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সমর্থন নিজেদের পক্ষে রাখতেই বারবার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব নিয়ে এক প্রকার মিথ্যা ভান করছে মাত্র। এ প্রসঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সেই প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেছেন পিলজার, যেখানে ২০০৯ সালে ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র প্রাগে আয়োজিত এক বিশাল জনসমাবেশে দাঁড়িয়ে ওবামা নিজেকে একটি পারমাণবিক হুমকিমুক্ত নিরাপদ বিশ্বের জন্য আত্মনিবেদিত বলে ঘোষণা করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শাসকদের সামগ্রিক তৎপরতাই চলে অবিরাম মিথ্যা প্রচারণা ও মিথ্যা ঘোষণার ওপর। যে ওবামা পারমাণবিক হুমকিমুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তার সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য যে কোনো প্রেসিডেন্টের সময়ের চেয়ে বেশি পারমাণবিক বোমার কারখানা তৈরি হয়েছে, পারমাণবিক বোমার মজুদ বেড়েছে, আরো বেশি নিউক্লিয়ার ডেলিভারি সিস্টেম এবং এ খাতে খরচ অনেক বেশি হয়েছে। জনপিলজারের মতে, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের সময় থেকে গত তিন দশকে এ খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খরচ এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি।
অঘোষিত নতুন মহাযুদ্ধ শুরুর পাশাপাশি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে একটি ত্রিমুখী ঠা-া লড়াই বা ¯œায়ুযুদ্ধ চলছে। একই সাথে চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে ইউনিপোলার মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখতেই এই ত্রিমুখী ওয়ারফ্রন্ট খোলা হয়েছে। একদিকে ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়ার প্রতি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া, অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরের প্রতিবেশীদের সঙ্গে চীনের বিরোধ এবং মার্কিন সমরসজ্জা বাড়িয়ে তোলার বাস্তবতা ক্রমে উত্তুঙ্গ হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ চীন সাগরের ডিসপুট এবং মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রত্যাশার বিপরীদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই দশক ধরেই নানাবিধ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হোয়াইট হাউসে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলমানদের সাথে এবং চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। দুই দফায় আট বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং চীনের সাথে মার্কিনিদের সম্পর্ক আরো জটিল ও নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছে। ভোটের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার আগে বিতর্কিত রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু রাশিয়া ও চীনের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলছেন। তবে বর্তমান পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ যখন জায়নবাদীদের চাপিয়ে দেয়া ইসলাম বিদ্বেষ বা ইসলামোফোবিয়ার বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে প্রকারান্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলমান অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য দিয়ে একটি উগ্র মার্কিন জাতীয়তাবাদের বিভ্রান্তিকর জিগির তোলছেন। বিশ্বের ওপর নিজেদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে একটি বৃহত্তর যুদ্ধের ওয়ার্মিং পয়েন্ট হিসেবে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা যখন মধ্যপ্রাচ্যে রিজিম চেঞ্জের কভার্ট অপারেশন হিসেবে আইএস, আল-কায়েদাসহ আঞ্চলিক বিরোধগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে, তখন ডোনাল্ট ট্রাম্পের মুখে হিটলারের সেই বর্ণবাদী কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
ইঙ্গ-মার্কিন আঁতাত ও গোপন ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে অস্ত্রের বলে গরিব আরব ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের বাড়িঘর ভেঙে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে ইরান একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রশক্তির জোট গঠনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তেহরান থেকে। গত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে ইরানের দ্বারা কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আক্রান্ত হওয়ার কোনো নজির নেই। তবে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরাইলের দ্বারা তার আরব প্রতিবেশীরা বার বার আক্রান্ত হয়েছে। তারা মধ্যপ্রাচের আরব দেশগুলোকে অকার্যকর ও দখলের মধ্য দিয়ে কথিত ‘গ্রেটার ইসরাইল’ রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়। সেই ইসরাইলের ডিফেন্স মিনিস্টার এভিগদর লিবারম্যান সম্প্রতি ইরানকে নাৎসি জার্মানির সাথে তুলনা করেছেন। ইরানের সাথে ৫ জাতির পরমাণু চুক্তির যৌক্তিকতা তুলে ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা এই চুক্তিকে ইসরাইল এবং বিশ্বশান্তির জন্য ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করার প্রতিক্রিয়ায় লিবারম্যান যুক্তি দেখান ‘মিউনিখ চুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হলোকষ্ট থেকে বিশ্বকে মুক্ত রাখতে পারেনি। একইভাবে ইরানকে পার্টনার বানিয়ে অবাস্তব চুক্তিও তেমন কোনো কাজে আসবে না।’ অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্র থাকার মিথ্যা অভিযোগ এনে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইরাক, আফগানিস্তান বা লিবিয়ার মতো ইরানকে ধ্বংস করার ফর্মুলাই বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে ইসরাইল। এভাবেই তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো মুসলিম বিশ্বকে একটি অন্তহীন যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে ঠেলে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অজেয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে টিকে থাকতে চায়। ইসরাইলকে এমন শক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্য শুধুমাত্র ইসরাইলি জায়নবাদী ইহুদিদের একার নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোও জায়নবাদীদের এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে। আর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে প্রোপাগান্ডা বা মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে একটি ভ্রান্ত মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা। হিটলার মধ্যপ্রাচ্য বা মুসলমানদের কোনো রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। ইউরোপে একটি খাঁটি আর্য সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে হিটলার ইহুদিদেরকে অন্যতম বাধা মনে করেছিলেন। এ কারণেই প্রথমে ইউরোপের ইহুদি জনগোষ্ঠীকে মাদাগাস্কারে পুনর্বাসিত করার উদ্যোগ নিয়েছিল হিটলার, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এক পর্যায়ে মাদাগাস্কার বৃটিশ অবরোধের সম্মুখীন হলে ইহুদি প্রশ্নে চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে জার্মান নাজি পার্টির নেতারা বার্লিনের ওয়ানশি কনফারেন্সে ‘ফাইনাল সলিউশন’ নামে যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল তার মূল লক্ষ্য ছিল কয়েক মিলিয়ন ইহুদিকে কৌশলগতভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া বা হত্যা করা। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থের মিথ্যা অজুহাত খাড়া করে এবং বিশ্বের মানুষকে মিথ্যা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করে আজকের জায়নবাদী ইসরাইলও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনুরূপ ফাইনাল সলিউশনের নীলনকশা বাস্তবায়ন করছে। তবে বিশ্বের দেড়শ কোটি মুসলমানকে হত্যা বা নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয় বলেই বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে মুসলমানদের মধ্যে জাতিগত বিদ্বেষ ও আত্মঘাতী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ইসলামী সভ্যতার পাদপীঠ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ডি-স্টাবিলাইজ ও অকার্র্যকর করে তোলা।
ভেতরে ভেতরে বিশ্বব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। গত দুই দশকে চীন, রাশিয়া ও ইরান ইউরেশিয়ার একটি নিয়ামক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) চুক্তির মধ্য দিয়ে এই আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট প্রকারান্তরে একটি কৌশলগত সামরিক জোটে পরিণত হয়েছে। ইরানকে এই জোটের অবজাভার মেম্বার হিসেবে রাখা হলেও গত জুন মাসে এসসিও মেমোরেন্ডামে স্বাক্ষর করার পর ভারত ও পাকিস্তানও এই জোটের অংশীদার হিসেবে গণ্য হচ্ছে। চীন, রাশিয়া, ভারত ও পাকিস্তানের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করছে এসসিও। আর বিশ্বের পারমাণবিক ক্লাবের অন্তত চারটি দেশ এই সংস্থার অন্তর্ভুক্ত হলো। ন্যাটোসহ যে কোনো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সামরিক ও অর্থনৈতিক জোটের চেয়ে এই জোট অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠার সম্পদ ও সম্ভাবনা রাখে। ইউরেশিয়ার এই আঞ্চলিক জোটের সম্ভাবনাময় শক্তির সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্যই একদিকে ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়া এবং অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানা বিরোধকে সামনে রেখে জাপান ও ফিলিপাইনের সাথে বিশেষ সামরিক সম্পর্ক তৈরির পাশাপাশি প্রশান্ত মহাসাগর ও চীন সাগরে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি ও তৎপরতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। মার্কিনিদের এই পরিকল্পনা যে অনেক পুরনো, চীনারা তা ভালোভাবে জেনে-বুঝেই নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সামরিক শক্তি অর্জনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। পারমাণবিক সক্ষমতার বিষয়টি বাদ দিলেও চীনা সামরিক প্রযুক্তি, সেনাবাহিনী, নেভি বা বিমান বাহিনীকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সমীহ না করে উপায় নেই। প্রতিরক্ষা জনবল তো বটেই অনেক ক্ষেত্রেই চীনা বাহিনী মার্কিনিদের তুলনায় অগ্রসর।
সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের (১৯৯৬) ৫টি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রাষ্ট্র ছিল চীন, রাশিয়া, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান। পরবর্তীতে ২০০১ সালে উজবেকিস্তানকে স্থায়ী সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আগেই বলা হয়েছে, মেমোরেন্ডামে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানও এ জোটে পা রাখল। এ ছাড়া অবজারভার সদস্য হিসেবে ইরান, আফগানিস্তান, বেলারুশ ও মঙ্গোলিয়া অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে তুরস্ক, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, কম্বোডিয়া, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার নাম রয়েছে। আর গেস্ট এটেনডেন্ট হিসেবে তুর্কমেনিস্তানসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সিআইএস (কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস)ভুক্ত দেশগুলো, আসিয়ানকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই আঞ্চলিক জোটে আমাদের সার্কের আটটি দেশের মধ্যে ৫টি দেশই কোনো না কোনোভাবে অন্তর্ভুক্ত হলেও বাদ পড়েছে বাংলাদেশ। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দেখা যাবে মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্তত ১০টি মুসলিম রাষ্ট্র সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সাথে জড়িত থাকলেও বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই জোটের বাইরে থাকার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বাংলাদেশের শাসকরা কি ইচ্ছা করেই এই জোটের বাইরে রয়ে যাচ্ছেন, নাকি ভিন্ন কোনো হুমকি বা প্রলোভনে দেশকে আঞ্চলিক জোটের বাইরে রাখছেন, তাও পরিষ্কার নয়। সার্কের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এক সময় আমরা গর্ববোধ করতাম। ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির কারণে সার্ক ইতিমধ্যেই একটি অকার্যকর আঞ্চলিক সংস্থায় পরিণত হয়েছে। আঞ্চলিক বাণিজ্যবৈষম্য, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনসহ কোনো বিষয়েই মীমাংসার জন্য এই সংস্থা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। গত মঙ্গলবার প্রকার্শিত এক রির্পোটে জানা যায় বাংলাদেশ আসিয়ানের সাথে অংশিদার হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অনেক দেরিতে হলেও সরকারের এই আগ্রহ নীতিবাচক। এখন বাংলাদেশ যখন বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের রাজনৈতিক হেজিমনির টার্গেটে পরিণত হচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধ দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, তখনো এসব সমস্যা সমাধানে কোনো আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভক্তি ও প্রতিপক্ষকে নির্মূলের অসহিষ্ণু রাজনীতি, ভারতের মতো বড় প্রতিবেশীর মতলববাজি এবং সাংহাই কো-অপারেশনের মতো শক্তিশালী আঞ্চলিক জোটের সাথে সংশ্রব না থাকার কারণে পশ্চিমারা এখানে তাদের স্বার্থ হাসিলে সুযোগ নিতে এখন আইএস কার্ড খেলছে। কোনো আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক জোটে বাংলাদেশ সক্রিয় না থাকলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে নিস্পৃহ থাকলেও শত শত বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ ও উন্নয়নের নামে দেশের সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক খাতগুলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। ট্রানজিট-করিডোর ছাড়াও ভারতকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কয়েকটি বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ, চীনকে ডিপ সিপোর্টসহ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ, জাপানকে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ, রাশিয়াকে রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের কাজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা ভারত, চীন, জাপান, আমেরিকা ও রাশিয়ার প্রতি সমানভাবেই উদার। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই জটিল সময়ে, তথাকথিত আইএস ও জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসের জুজুর ভয়ে আমরা বাংলাদেশকে একটি বাফার স্টেটে পরিণত হতে দেব কিনা সে প্রশ্নে এ দেশের জনগণের যেন এখন কিছুই করণীয় নেই। জনগণের মধ্যে বিভক্তি ও অনাস্থা জিইয়ে রেখে সরকারের পক্ষে পরাশক্তির হেজিমনি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে বাংলাদেশও জায়নবাদী ষড়যন্ত্রের শিকার হতে পারে। এ ক্ষেত্রে দেশের নাগরিক সমাজকে ষড়যন্ত্র ও প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে সজাগ ও সরব হতে হবে। সরকার এবং জনগণের মধ্যে একটি রাজনৈতিক ঐক্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি।
bari_zamal@yahoo.com

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Sogi ১১ মার্চ, ২০১৭, ২:৪১ পিএম says : 0
Great information
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন