বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

সুন্দরবন : আগ্রাসী উন্নয়নের নতুন শিকার

প্রকাশের সময় : ১০ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আলতাফ হোসেন হৃদয় খান

প্রাণ ও প্রকৃতির অনন্য এক জাদুঘর আমাদের সুন্দরবন। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, স্বাদুপানির ডলফিন, নোনাজলের কুমির, দুরন্ত হরিণ, সুন্দরী, গেওয়া, গরান- এসব কিছু মিলিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন হয়ে উঠেছে আশ্বর্য এক বিস্ময়। অথচ এই সুন্দরবনেরই একেবারে নিকটে হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প। প্রায় দু’বছর ধরে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণ, যৌথ কোম্পানি গঠন, সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশসহ নানা কর্মযজ্ঞ চলতে থাকলেও প্রকৃতিপ্রেমী সচেতন মহলের ধারণা ছিল হয়তোবা কোনো একপর্যায়ে সুন্দরবন রক্ষার স্বার্থে বিধ্বংসী এ প্রকল্প হতে সরকার সরে আসবে। কিন্তু সর্বশেষ গত এপ্রিলে ভারতের সাথে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট তিনটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় চুক্তিকে অনেকেই দেখছেন কফিনের শেষ পেরেক হিসেবে।
উন্নয়নের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে বিদ্যুৎ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট মানুষগুলোর কাছে গত নির্বাচনে এ সরকারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল বিদ্যুৎ সমস্যা দূরীকরণ। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকট উত্তরণে ১৩২০ মেগাওয়াটের এতবড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে যে সুন্দরবন এলাকাকেই বেছে করা হবে সেটি কেউ ঘুর্ণাক্ষরেও কল্পনা করেনি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জ্বালানি হচ্ছে কয়লা। কয়লা খনি ব্যবসার প্রসারে পরিবেশ সংরক্ষণের উপায় হিসেবে আধুনিককালে সিসিএস (পধৎনড়হ পধঢ়ঃঁৎব ধহফ ংঃড়ৎধমব) নামে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় সেটি আদতে কোনো কাজে আসে না। তাই রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মারাত্মক দূষণ যে বাতাস-মাটি-পানির মাধ্যমে সুন্দরবনে প্রাণ-প্রকৃতিতে চরমতম আঘাত হানবে তা বলাই যায়। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে প্রয়োজন হবে ৪৭ লক্ষ টন কয়লা যা জাহাজযোগে নিয়ে আসা হবে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা হতে। সুন্দরবনের বুকের উপর দিয়ে বয়ে চলা পশুর নদীর উপর দিয়ে দূষিত কয়লা বোঝাই জাহাজগুলো চলাচল করবে বছরের প্রায় ২৩৬ দিন। এতে পরিবহনকালে কয়লার ভাঙা টুকরা, তেল, ময়লা-আবর্জনা দিয়ে সুন্দরবনের পানি দূষিত হবে। সৃষ্ট ঢেউয়ে পাড় ভাঙবে। উন্মুক্ত চলাচলের সুযোগে সুন্দরবনে চোরাই শিকারি বাড়বে। এই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পোড়ানোয় তৈরি হবে বিষাক্ত ধোঁয়া। যাতে থাকবে সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড। এছাড়া আর্সেনিক, পারদ, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, রেডিয়াম এগুলোর মারাত্মক দূষণ তো রয়েছেই। এতে এসিড বৃষ্টি হবে যা কিনা উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর জন্য মারাত্মক হুমকি।
থাইল্যান্ডের মাই মোহ’তে ২৬২৫ মেগাওয়াটের অনুরূপ একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে বৃষ্টির পানিতে সালফেটের পরিমাণ আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে ৫০% বেড়ে গেছে। সালফার দূষণে জমির ফলন কমে গেছে। এসিড সৃষ্টির ফলে ওই অঞ্চলের গাছপালা মরে যাচ্ছে। চীনের সানঝি নগরী এক সময় পরিচিত ছিল ফুল ও ফলের নগরী হিসেবে। অথচ মাত্র ৩০ বছরের ব্যবধানে কয়লা দূষণে এখন তা ধূসর পাহাড় আর কালো পানির শহরে পরিণত হয়েছে। ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট ইয়ুগ্যাং গোট্টি’র হাজার বছরের ঐতিহ্য হালের কয়লা দূষণে এতটাই ভঙ্গুর হয়ে গেছে যে, সামান্য স্পর্শেই পাথর খসে পড়ে। তাই যতই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হোক না কেন অনুরূপ ঘটনা সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও ঘটবে। এ প্রকল্পে শুরু থেকেই নানা অনিয়ম একেবারে স্পষ্ট। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশাল পরিমাণ ভূমি অধিগ্রহণে স্থানীয় মানুষের দাবি-দাওয়া আমলে নেয়া হয়নি। ৫ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার ব্যাপারে কোনো চিন্ত করা হয়নি। শত শত কোটি টাকার ফসল, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি-মাছের খামার আর স্থানীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের কোনো বিকল্প চিন্তা করা হয়নি। কাজ শুরুর পূর্বে কোনো পরিপূর্ণ পরিবেশগত সমীক্ষা রিপোর্ট (ইআইএ) করা হয়নি। আর সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে বাস্তব সত্য ফুটিয়ে তোলা হয়নি।
প্রফেসর ড. আব্দুল্লাহ হারুণ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে সুন্দরবন ও এর আশপাশের এলাকায় প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাববিষয়ক একটি গবেষণা করা হয়েছে। এই গবেষণায় পরিবেশগত প্রভাবের দিকগুলো ৩৪টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে পৃথকভাবে পর্যবেক্ষণ করে এই প্রভাব কতটা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক হবে সেটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। এই ৩৪টি ক্যাটাগরির ২৭টিতেই পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। ৭টি ইতিবাচক প্রভাবের মধ্যে আঞ্চলিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নই একমাত্র বাস্তবিক ইতিবাচক পরিবর্তন। বাকি ৬টিকে ইতিবাচক হিসেবে বলা হলেও সুন্দরবন ধ্বংসে সে প্রভাবগুলো ‘টনিকে’র মতো কাজ করবে। ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোর মধ্যে রয়েছে রামপাল ও তদঃসংশ্লিষ্ট এলাকায় নগরায়ন, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যবসার প্রসার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও হাট-বাজার সৃষ্টি। কিন্তু বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনকে ঘিরে যদি শিল্পের প্রসার হয় কিংবা জনবসতি গড়ে ওঠে তবে সে বন আর কতদিন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে তা ভেবে দেখবার বিষয়।
আধুনিককালে এধরনের বড় কোনো প্রকল্পে পরিবেশগত প্রভাব মোকাবিলা করা হয় দুই উপায়ে। প্রথমটি হচ্ছে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো গড়ে তোলা যার মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর অবস্থান যার মাধ্যমে পরিবেশ আইন ভঙ্গের কঠোর শাস্তি দ্রুত সময়ে নিশ্চিত করা যায়। আমাদের দেশে এ দুটি জিনিসেরই বড় অভাব। আর তাইতো বুড়িগঙ্গায় আশ্রয় পায় নর্দমার পানি, গয়নাঘাট খাল ভরাট করে তৈরি হয় বিশাল বিপণি বিতান আর তিতাসের বুক চিরে তৈরি হয় চলাচলের রাস্তা। যেই উন্নয়নের সিঁড়ি প্রকৃতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয় সেই উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হয়না। পরিবেশ ধ্বংসের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় সেই উন্নয়ন অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়ে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হতে যাচ্ছে সেই উন্নয়নের বাহন যেখান থেকে পাওয়া যাবে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আর বিলীন হয়ে যাওয়া সুন্দরবনের বিস্তৃৃত ন্যাড়া ভূমি।
রামপাল প্রকল্প যে সুন্দরবনের নিশ্চিত ধ্বংস নিয়ে আসছে এব্যাপারে সচেতন বিশেষজ্ঞ মহল শতভাগ নিশ্চিত। বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সভা-সেমিনার’এ তা প্রতিনিয়ত তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু শাসক শ্রেণীর কুম্ভকর্ণের ঘুম যেন ভাঙছেই না। সময়ে সময়ে তাদের কাছে থেকে আমরা শুধু পাচ্ছি সুন্দরবন রক্ষার ‘গায়েবী’ আশ্বাস। অথচ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রকল্পের প্রারম্ভিক কাজ শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। রামপাল প্রকল্প নিয়ে শাসকগোষ্ঠী সুন্দরবনকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের শেষ বিকল্প হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করছেন। ভাবটা এমন যে দেশের উন্নয়নে ‘সুন্দরবনী’য় বিদ্যুৎই লাগবে। অথচ আমরা জানি আধুনিককালে সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের হাজারটা উপায় আছে। কিন্তু হাজার বছরের বিবর্তনে গড়ে ওঠা আমাদের সুন্দরবন পৃথিবীতে একটিই। রামপাল প্রকল্প সেই সুন্দরবন ধ্বংসের নিশ্চিত আয়োজন সম্পন্ন করছে।
আমরা উন্নয়ন চাই। অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশে অগ্রগতি আমাদের সকলের প্রত্যাশা। কিন্তু উন্নয়ন মানেই যত্রতত্র কলকারখানা স্থাপন করে ফেলে নদীগুলোকে বর্জ্যবাহী নালায় পরিণত করা নয়। উন্নতি মানেই পাহাড় কেটে আবাসন শিল্পের জায়গা করে দেয়া নয়। অগ্রগতি মানেই সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিপন্নকারী কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়। স্বল্পমেয়াদি সংকট সমাধানের কোনো টোটকা পদ্ধতি দীর্ঘমেয়াদি যে ক্ষতের সৃষ্টি করবে সেই ক্ষত থেকে ভবিষ্যতে মুক্তি মিলতেও পারে আবার নাও মিলতে পারে কিন্তু হাজার বছরের আবর্তন-বিবর্তনে আমাদের আজকের যে সুন্দরবন তা যদি হারিয়ে ফেলি তবে সেটি যে আর ফিরে পাব না তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা, আমরা কোনটা চাইÑ সুন্দরবন নাকি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র?
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন