মুফতি ড. ইমাম হোসাইন
ইসলাম শান্তির ধর্ম। এ শান্তি শুধু মুসলিমের জন্য নয়, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য এবং সকল সৃষ্টি জগতের জন্য। মহানবী (স.) একটি বিড়ালকে অভুক্ত বেঁধে রাখার জন্য কঠিনতম তিরস্কার জানিয়েছেন অথচ তাঁর উম্মাত মানুষ খুন করতে পারে এটি কল্পনাও করা যায় না। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি। বাংলাদেশের মতো সুশৃঙ্খল সমাজে জঙ্গিবাদের উত্থান অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বিষয়। এর সঠিক কারণ নির্ণয় করে তা প্রতিরোধ করা একান্ত প্রয়োজন। এ প্রবন্ধে ইসলামের আলোকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের কারণ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস সৃষ্টি হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ নি¤œরূপ :
ক. জিহাদবিষয়ক অপপ্রচার : কেউ কেউ জিহাদ বলতে ঐড়ষু ডধৎ বা পবিত্র যুদ্ধ বা জবষরমরড়ঁং ডধৎ বা ধর্মযুদ্ধ বা ঈৎঁংধফব (ক্রসেড) বলে অভিহিত করেন। অথচ এগুলো সব খ্রিস্টান চার্চ ও যাজকদের আবিষ্কৃৃত পরিভাষা। ইসলামী পরিভাষায় জিহাদ অর্থ ‘রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ’। মুসলিম রাষ্ট্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধকে ইসলামে জিহাদ বলা হয়। দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হলো দাওয়াত। দ্বীন প্রতিষ্ঠা বা দ্বীন প্রচারের জন্য হত্যা, জিহাদ বা যুদ্ধ তো দূরের কথা কোনোরূপ শক্তি প্রয়োগও নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন : “দ্বীনে কোনো জবরদস্তি নেই। ভ্রান্তি থেকে সত্য সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগুতকে অবিশ^াস করবে এবং আল্লাহকে বিশ^াস করবে সে এমন এক মজবুত হাতল ধরবে যা কখনো ভাঙবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আল-বাকারাহ : ২৫৬)
খ. দ্বীনের বিজয়ের ভুল ব্যাখ্যা : আল্লাহতায়ালা কুরআনুল কারীমে দ্বীনকে প্রকাশ বা বিজয় দান করার কথা অনেক আয়াতে বলেছেন। এ দ্বীন বিজয়ের ভুল ব্যাখ্যার কারণেও জঙ্গিবাদের উৎপত্তি হয়। দ্বীনের বিজয় ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। তবে এ বিজয়ের অর্থ ও পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ (স.) ও সাহাবীগণের মাধ্যমে জানতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন : “তিনিই প্রেরণ করেছেন তাঁর রাসূলকে সঠিক পথের নির্দেশনা ও সত্য দ্বীন-সহ; যেন তিনি তাকে প্রকাশ করেন সকল দ্বীনের উপর; যদিও মুশরিকগণ তা অপছন্দ করে।” (সূরা আত-তাওবাহ : ৩৩)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন : “আল্লাহতায়ালা মুহাম্মদ (স.)-কে সকল ধর্মের সকল তথ্য প্রকাশ করবেন বা জানিয়ে দিবেন; যদিও ইয়াহুদী-খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা তাদের এ সকল বিষয় প্রকাশ পাওয়া অপছন্দ করত।” আবু হোরায়রা (রা.) ও অন্যান্য মুফাসসিরদের মতে : “শেষ যুগে ঈসা (আ.)-এর পুনরাগমণের মাধ্যমে মহান আল্লাহ এ দ্বীনকে চূড়ান্ত বিজয় ও প্রকাশ দান করবেন। সে সময়ে বিশে^র সকল মানুষ এ দ্বীন গ্রহণ করবে এবং দ্বীন একমাত্র আল্লাহরই হবে।”
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের উপায়সমূহ : বাংলাদেশের জনগণ প্রকৃতিগতভাবে শান্তিপ্রিয়। এদেশে কখনো ধর্মীয় সংঘাত ও জঙ্গিবাদ দেখা দেয়নি। ইদানীং আমাদের দেশেও ধর্মীয় উগ্রতার উন্মেষ লক্ষ করছি। এ জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে আমাদের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ক. আসমানী কারণ নির্ণয় করা : পবিত্র কুরআন ও হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কিছু কিছু অপরাধ সমাজে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়লে আল্লাহতায়ালা সে সমাজে সামাজিক অবক্ষয় ও অশান্তি ছড়িয়ে দেন। আল্লাহতায়ালা বলেন : “যারা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক তাদের জন্য পৃথিবীতে এবং আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহতায়ালা জানেন, তোমরা জান না।” (সূরা আন-নুর : ১৯)
অন্যান্য আয়াত ও হাদিসে অশ্লীলতা, ভেজাল, মাপ বা পরিমাপে কম প্রদান, প্রতারণা, জুলুম, হত্যাকা-, ন্যায়বিচারের দুষ্প্রাপ্যতা প্রভৃতি কারণে সমাজে আল্লাহর শাস্তি ও গজব আসবে বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ কারণগুলো থেকে বেঁচে থাকা প্রয়োজন।
খ. ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা দূরীকরণ : জ্ঞানহীন আবেগ চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদের জন্ম দেয়। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা শিক্ষিত বেকার যুবককে যদি বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, সহিংসতার মাধ্যমে তোমার বেকারত্ব ও সকল সমস্যা দূরীভূত হবে। এ যুবক সহজে তাদের প্রলোভনে পড়ে যেতে পারে।
গ. জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সম্পৃক্ত করা : যেহেতু জঙ্গিবাদের সাথে ধর্মীয় অনুভূতি জড়িত, ফলে এর প্রতিরোধে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। ইসলামের যে বিষয়গুলোর ভুল ব্যাখ্যার কারণে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হয়, সেগুলোর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার জন্য বিজ্ঞ আলিমদের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। মসজিদের ইমাম ও খতীবগণ জুমুার বয়ানে সুন্দরভাবে তুলে ধরতে পারলে জঙ্গিবাদ সমাজে স্থান করতে পারবে না।
সুন্নাতের আলোকে সাহাবীগণের পন্থাই ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও সংস্কারের সঠিক পন্থা। সন্ত্রাস, সহিংসতা, জঙ্গিবাদ, উগ্রতা এগুলো নবী (স.) ও সাহাবীগণের (রা.) কর্মপদ্ধতি নয়। তাই আমাদেরকে জঙ্গিবাদের সঠিক কারণ নির্ণয় করে তার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কখনো ইসলামের কল্যাণ করেনি, যুগে যুগে দেশ ও জাতির ক্ষতিই করেছে। আল্লাহতায়ালা আমাদের দেশ ও জাতিকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত রাখুন।
ষ লেখক : খতিব, নদ্দা সরকার বাড়ী জামে মসজিদ, গুলশান, ঢাকা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন