এম এইচ খান মঞ্জ
শিক্ষাবোর্ডে জারি করা নির্দেশনা অনুসারে সকল মেধাবৃত্তি ও সাধারণ বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী বিনাবেতনে পড়ালেখার সুযোগ পাবে। কিন্তু সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, শিক্ষাবোর্ডের এ নির্দেশনা অমান্য করে ঢাকার নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোসহ সারা দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানেই মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফিসহ সব ধরনের ফি বাধ্যতামূলকভাবে আদায় করা হচ্ছে।
ঢাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান এ ব্যাপারে জানিয়েছেন যে, তার স্কুলে ৬০ থেকে ৭০ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এদের তিন বছর বিনাবেতনে পড়াতে হলে বড় অংকের আর্থিক ঘাটতিতে পড়বে প্রতিষ্ঠান। তাই এদের কাছ থেকে টিউশন ফিসহ যাবতীয় ফি আদায় করা হয়। অভিযোগে জানা যায়, ঢাকার নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যেকটিতে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার করে শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে বিপুল অংকের অর্থ আদায় করা হয় শুধু টিউশন ফি হিসেবে। এছাড়া আরও অনেক খাত দেখিয়ে অর্থ আদায় তো রয়েছেই। এসব নামকরা স্কুলের আয়ও বিপুল পরিমাণ। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেয়ার পরও উদ্বৃত্ত থাকে বিপুল অংকের টাকা। ম্যানেজিং কমিটির সভা খরচ, বিনোদন ভাতাসহ আরও বহু খাত দেখিয়ে বিপুল অংকের অর্থ ভাগবাটোয়ারা হয়। অথচ মাত্র ৬০ থেকে ৭০ জন মেধাবী শিক্ষার্থীর টিউশন ফি শিক্ষাবোর্ডের নির্দেশনা মোতাবেক ছাড় দেয়া হয় না। মেধাবী শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফ করে দেবার মানসিকতাও স্কুল কর্তৃপক্ষের নেই। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বেতন মওকুফ করে দিয়ে অনুপ্রাণিত করবার দৃষ্টান্ত স্থাপনেও নেই কোনও আগ্রহ এসব শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের।
বৃত্তিপ্রাপ্তদের সবাই বড় লোকের সন্তান এমনও নয়। মা-বাবার পরিবার চলে বেশ টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে। বৃত্তির টাকাও খুব বেশি নয়। মাসিক ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকার মতো মাত্র। সামান্য কিছু টাকা বই কেনার জন্য দেয়া হয় বছরে। মেধাবীদের বৃত্তির এই টাকা অর্থ হিসেবে আহামরি কিছু না। তবুও এতেই অনেক মেধাবী বেশ উপকৃত ও অনুপ্রাণিত হয়। কিন্তু স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক মানসিকতা এতোই প্রবল যে, শিক্ষাবোর্ড তথা সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে মেধাবীদের কাছ থেকেও বাধ্যতামূলকভাবে টিউশন ফিসহ যাবতীয় ফি কড়ায়-গ-ায় আদায় করা হয় বলে অভিযোগে প্রকাশ।
এ অমানবিক প্রবণতা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত বৈকি। সরকারি নির্দেশনা কেবল শহুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই অমান্য করেনি। এ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহর থেকে উপজেলা পর্যায়েও। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত সবখানেই শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যিক মানসিকতা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছে। ঔদার্য ও মহত্বের দৃষ্টান্ত প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ শিক্ষার মৌলিক কথাই হচ্ছে মহানুভবতার উদাহরণ সৃষ্টি। শিক্ষার এই বাণিজ্যিকীকরণ কতটা নেতিবাচক মানসিকতা সৃষ্টি করছে তা ভাবলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হওয়া ছাড়া উপায় নেই বললেই চলে।
শিক্ষা ছাড়া কোনও জাতি উন্নত হতে পারে না। এই শিক্ষা হচ্ছে একটি জাতির মেরুদ-। এ নিয়ে বাণিজ্য চলতে পারে না। শিক্ষার মহান ব্রত নিয়ে যারা বাণিজ্য করতে চান, তাদের শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হওয়াই উত্তম। বৃত্তিপ্রাপ্ত মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি বাধ্যতামূলকভাবে আদায় করে যারা সরকারি নির্দেশনা অমান্য করছেন তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে আমরা মনে করি। তবে কোনও প্রতিষ্ঠান যদি আর্থিকভাবে দুর্বল হয় এবং নিরুপায় হয়ে মেধাবীদের কাছ থেকে টিউশন ফি নিতে বাধ্য হয় তাহলে তা শিক্ষাবোর্ডের অনুমতিক্রমে নেয়া যেতে পারে। আর যারা বাণিজ্যিক কারণে মেধাবী বৃত্তিপ্রাপ্তদের কাছ থেকে টিউশন ফি নিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হোক।
আমরা যুগ যুগ ধরে দেখে আসছি যেসব শিক্ষার্থী প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষায় বৃত্তি পায় তাদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করা হয় না। কিন্তু অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃত্তিপ্রাপ্তদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করছে। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তা মানছে না বেসরকারি নামি স্কুলগুলো। ভর্তি ফি, নিবন্ধন ফি, উন্নয়ন ফি, টিউশন ফিসহ সবধরনের ফিয়ের টাকাই বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করছে এসব প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর বাইরেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে।
ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়, সকল মেধাবৃত্তি ও সাধারণ বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করবে। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ও শিক্ষাবোর্ডের অধিভুক্ত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক বেতন আদায় করতে পারবে না। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক বেতন আদায় করলে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের বিরুদ্ধে বিধি ভঙ্গের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অন্যান্য শিক্ষাবোর্ডেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। কিন্তু বাস্তবে টিউশন ফি আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি ভঙ্গের জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি শিক্ষাবোর্ড বা শিক্ষা অধিদপ্তর।
নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা বলেন, বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি নেয়া একটি প্রচলিত নিয়ম। তাদের প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষার্থীই বৃত্তি পায়। যদি তাদের কাছ থেকে টিউশন ফি না নেয়া হয় তবে শিক্ষকদের বেতন দেয়া যাবে না। যারা বেসরকারি নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখেন তারা নিঃসন্দেহে এটিকে খোঁড়া যুক্তি বলে উড়িয়ে দেবেন। অন্যদিকে অভিভাবকরা বলছেন, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ অনেকে নানা খাত দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা তুলে নেন। তারপরও তারা বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করছেন।
সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ট্উিশন ফি আদায় করছে তাদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না তা আমাদের বোধগম্য নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজর দেবেন এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
ষ লেখক : প্রিন্সিপাল, এম এইচ খান ডিগ্রী কলেজ গোপালগঞ্জ, সাবেক সংসদ সদস্য ও গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন