ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, রিকশা ভ্যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এসব অবৈধ যান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। মেয়র ওই দিন বলেছেন, এ ধরনের রিকশা বা যানবাহন ডিএসসিসি’র সড়কে পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মেয়রের ঘোষণার পর ১০দিন অতিবাহিত হতে চলেছে। কিন্তু এসব নিষিদ্ধ যানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযানে নামেনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তবে বিভিন্ন পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে মালিকদেরকে এসব অবৈধ যান অপসারণের জন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। সরেজমিনে দক্ষিণ সিটির কয়েকটি এলাকা ঘুরে মালিক ও চালকদের সাথে কথা বলে যে চিত্র পাওয়া গেছে তাতে মালিকপক্ষ সিটি করপোরেশনের নিষেধাজ্ঞাকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না। তাদের কথা, সরকার এসব যানকে বহু আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু উচ্ছেদ করতে পারেনি। মার্লিপক্ষের ধারণা, এবারও সরকার হয়তো ব্যাটারিচালিত অবৈধ ইজিবাইক, রিকশার নিষিদ্ধকরণ ঘোষণার মধ্যেই নিষেধাজ্ঞা সীমাবদ্ধ থাকবে। শেষ পর্যন্ত আর উচ্ছেদ অভিযান হবে না।
অন্যদিকে, এসব নিষিদ্ধ যান থেকে যারা কোটি কোটি টাকা চাঁদা তোলেন সেই সব প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতারা চাঁদার অঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছেন। আলাপকালে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশার চালকরা জানান, অভিযান যাতে না চলে সেজন্য নেতারা তদবির করছেন বলে তাদেরকে মালিকপক্ষ জানিয়েছে। এজন্য বাড়তি টাকার প্রয়োজনের কথা জানিয়ে নেতারা চাঁদার অঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছেন। আগে যে বাইক থেকে দিনে দেড়শ’ টাকা চাঁদা নেয়া হতো, এখন তা বাড়িয়ে দু’শ টাকা করা হয়েছে। মালিকরা জানান, তারা চাঁদার অঙ্ক বাড়িয়ে হলেও অভিযান বন্ধ করতে চান। এজন্য নেতাদের সাথে তারা দেনদরবার করে চলেছেন।
জানা গেছে, সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা কমপক্ষে ১৭ লাখ। এর মধ্যে ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান। বাকি ৭ লাখ ইজিবাইক। আর ঢাকায় এই সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। এর মধ্যে ১০ লাখ রিকশা বাকি ২ লাখ ইজিবাইক। এসব অবৈধ যান থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এই চাঁদা তুলে থাকে। চাঁদার একটা বড় অংশ পায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ।
নিষিদ্ধ ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশায় সয়লাব ঢাকা। মহাসড়কসহ সারাদেশসহ ঢাকার অলিতে-গলিতে এখন শত শত ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। এসবের কারনে যানজট, দুর্ভোগ আর দুর্ঘটনা মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে গেছে। রাজধানীতে ইজিবাইকের দৌরাত্ম দেখলে আর মনেই হয় না এগুলো নিষিদ্ধ কোনো যান। এর সাথে যোগ হয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। ১০ লাখ রিকশার শহর ঢাকায় এখন মোটরচালিত রিকশা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে অথচ এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ডিএমপি সদর দফতরের ট্রাফিক বিভাগ থেকে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা যাতে না চলে সে বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। সেই নির্দেশনাও মানছে না পুলিশ। নিষিদ্ধ এসব যানের নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় রাজনীতিক ও প্রভাবশালীরা। যারা দুহাতে কামিয়ে নিচ্ছেন টাকা। আর এই টাকার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। নিষিদ্ধ যানবাহনগুলোর ব্যাটারি চার্জ করা হয় চুরি করা বিদ্যুত দিয়ে। এতে করে বিদ্যুত সঙ্কটে একদিকে রাজধানীবাসী ভোগান্তি পোহাচ্ছে অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। এ প্রসঙ্গে বিআরটিএ-এর সচিব মুহাম্মদ শওকত আলী ইনকিলাবকে বলেন, দিন দিন নিষিদ্ধ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে আলোচনা চলছে। ইজিবাইক বা এর যন্ত্রাংশ যাতে আমদানী করা না যায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিআরটিএ-এর অভিযান অব্যাহত আছে। আগামীতে অভিযান আরও জোরদার করা হবে।
সারাদেশের ২১টি মহাসড়কে ব্যাটারীচালিত ইজিবাইক, নছিমন, করিমন, চাঁদের গাড়িসহ সিএনজি অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করেছে সরকার। ২০১৭ সালে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর মহাসড়কগুলোতে ইজিবাইকসহ থ্রি হুইলার চলাচল বন্ধ থাকে। হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতায় সে সময় মহাসড়কে দুর্ঘটনাও অনেকটা কমে যায়। কিন্তু এ সুফল মাত্র কয়েক মাস স্থায়ী হয়। আবার আগের মতোই মহাসড়কে চলতে থাকে নিষিদ্ধযানগুলো। এখন দেশের সবগুলো মহাসড়কেই ইজিবাইক চলাচল করে। এর সাথে যোগ হয়েছে মোটরচালিত রিকশা। এরপর এ বিষয়ে হাইকোর্ট একটি আদেশ জারি করে। ওই আদেশে দেশের ১০টি জেলার মহাসড়কে ব্যাটারীচালিত ইজিবাইক, নসিমন, করিমন, সিএনজি অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু হাইকোর্টের সেই নির্দেশনাও এখন আর কার্যকর হচ্ছে না। এতে করে একের পর এক দুর্ঘটনায় বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
শুধু মহাসড়ক নয়, নিষিদ্ধ ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশায় রাজধানী এখন সয়লাব। নগরীর প্রতিটি এলাকায় এখন এগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। নিষিদ্ধ এসব যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে রাস্তায় আর হাঁটাই যায় না। পাড়া-মহল্লার অলিগলিতেও যানজট এখন নিত্যদিনের ঘটনা। সকালে সন্তানদের স্কুলে দিতে গিয়ে অবিভাবকরা পড়ছেন মহাবিপাকে। রিকশা ফেলে পায়ে হেঁটে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় নিষিদ্ধ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশায় সয়লাব। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্যামপুর, কদমতলী, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, সবুজবাগ, খিলগাঁও, হাজারীবাগ, লালবাগ থানা এলাকায়। প্রতিটি এলাকার অলিতে-গলিতে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশায় সয়লাব। প্রভাবশালীদের ভয়ে এ নিয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস করে না। আর পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয় না বলে ভুক্তভোগিদের অভিযোগ। তবে অনেকেই আশাবাদি এবার কাজ হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ খোকন ইনকিলাবকে বলেন, আমরা আশাবাদি। মেয়র মহোদয় নাগরিকদের স্বার্থে এ অবশ্যই নিষিদ্ধ যানের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করবেন। তিনি বলেন, প্রতিদিনই কোনো না কোনা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মালিকদের সতর্ক করা হচ্ছে। যাতে তারা তাদের বাইক অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারেন। কারণ ঢাকায় ডাম্পিংয়ের ব্যবস্থা নেই। গাড়িগুলো আটক করে কোথায় রাখবে সে ব্যবস্থাও নেই। বলা যায়, মালিকপক্ষকে সুযোগ দেয়ার জন্যই সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকা অবৈধ ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশার সাথে ২০ হাজার অবৈধ সিএনজি অটোরিকশাও আছে। সেগুলোকেও উচ্ছেদ করতে হবে।
উল্লেখ্য, ডিএসসিসি›র আওতাধীন এলাকায় অযান্ত্রিক যানবাহন নিবন্ধন, নবায়ন ও মালিকানা পরিবর্তনের জন্য করপোরেশন ইতোমধ্যে এক গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে। আগ্রহী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ১৩ সেপ্টেম্বর হতে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখ পর্যন্ত নগর ভবনের ভান্ডার ও ক্রয় বিভাগ এবং আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর দফতর থেকে অফিস চলাকালে নিবন্ধন/নবায়ন/মালিকানা পরিবর্তনের জন্য ১০০ টাকার (অফেরতযোগ্য) বিনিময়ে আবেদনপত্র সংগ্রহ ও জমা দিতে পারবেন। গৃহীত আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে যোগ্য বিবেচিত হওয়া আবেদনগুলোর অনুক‚লে নির্ধারিত ফি জমাদান সাপেক্ষে নিবন্ধন প্রদান করা হবে। প্রকাশিত গণবিজ্ঞপ্তি অনুসারে ১৩ সেপ্টেম্বের থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোটর, যন্ত্র, ইঞ্জিন ও ব্যাটারিচালিত রিক্সা-ভ্যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ধরণের যানবাহন নিবন্ধন প্রদান করা হবে না এবং এই ধরণের সকল অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন