খানাখন্দে ভরা এবড়োথেবড়ো সড়ক। ভাঙাচোরা রাস্তার বিভিন্ন স্থানে জমে আছে ময়লা পানি। এর মধ্যে উন্নয়ন কাজের জন্য কোথাও কোথাও খোঁড়া হয়েছে, পাশে রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী। বৃষ্টিতে পানি জমে সড়ক হয়ে ওঠে খাল! যেখানে সেখানে ফেলা হয় বর্জ্য, ময়লা। জমে থাকা পানিতে ময়লা আবর্জনা মিশে পুরো এলাকার পরিবেশ দূষিত। এসব সড়কে যানবাহন তো দূরে থাক, পায়ে হেঁটে চলাও মুশকিল। শুদু তাই নয়, প্রতিটি ওয়ার্ডের রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা গড়ে তুলেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রাস্তায় অবাধে চলছে হাজার হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ মানুষ। সব মিলে নতুন ওয়ার্ডগুলোতে এখনও বিরাজ করছে গ্রামের আবহ। সিটি করপোরেশনের সুবিধা বঞ্চিত ওয়ার্ডগুলোতে সারা বছরই ভোগান্তি নিত্যসঙ্গী।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইল, সারুলিয়া, ডেমরা, মান্ডা, দক্ষিণগাঁও ও নাসিরাবাদ ইউনিয়নকে ৫৮, ৫৯, ৬০, ৬১, ৬২, ৬৩, ৬৪, ৬৫, ৬৬, ৬৭, ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭১, ৭২, ৭৩, ৭৪ ও ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয় এবং ডিএসসিসির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চার বছর যাবত দক্ষিণ সিটির অন্তর্ভুক্ত হলেও ওয়ার্ডগুলোতে সুযোগ সুবাধা কিছুই নেই। ২০১৮ সালে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে কিছু কাজ হলেও এখনও সেগুলো অসমাপ্তই রয়ে গেছে। কোথাও পাকা, কোথাও পাকা ড্রেনগুলোতে ময়লা আবর্জনা জমে ভরাট হয়ে যায়। সেগুলো নিয়মিত পরিস্কার না করায় সামান্য বৃষ্টিতেও ড্রেনগুলো উপচে পড়ে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ডেমরার ৬৩ নং ওয়ার্ডের সড়কগুলোর বেহাল দশা। বৃষ্টিতে জমে আছে পানি। কোথাও কোথাও হাঁটু পানি পাড় হয়ে চলতে হচ্ছে। মাতুয়াইল মাদরাসা বাজার সড়কের উপর ময়লা আবর্জনা স্তুপাকারে রাখা হয়েছে। সেই ময়লাগুলো গিয়ে মিশেছে জমে থাকা পানিতে। তাতে পুরো এলাকা ময়লার গন্ধে একাকার। স্থানীয় বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, ময়লা আবর্জনার গন্ধে এলাকায় বসবাস করা দুরুহ হয়ে পড়েছে। তার উপর মানুষ ময়লা পানি পেরিয়ে ঘরে জীবাণু বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। বেহাল সড়কে যানবাহন চলাচলে প্রতিদিনই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। হেঁটে চলাও দায়। সড়ক যেন হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ। একই দশা সবগুলো ওয়ার্ডের বিভিন্ন শাখা সড়কেও। ৬৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল মতিন সাউদ জানান, এটি দক্ষিন সিটি কপোরেশনের সবচেয়ে বড় ওয়ার্ড। সমস্যা তো অনেক, খালগুলো ভরে গেছে সংস্কারের অভাবে। যে কারণে অল্প বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে যায়, মেয়র মহোদয় কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছি, তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, শিগগিরি খাল খনন শুরু হবে। তিনি বলেন, আমার এলাকা সাইনবোর্ড থেকে ডেমরা যে কারণে অনেক বাজেট দরকার। নিচু এলাকা বলে পানি জমে যায়, ড্রেনেজ ব্যাবস্থা নাই। নতুন ওয়ার্ড হলেও মেয়র মহোদয় এই এলাকার উন্নয়নে দৃষ্টি দিবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, আগে মশার ওষুধ পেতাম না, এখন তো পাচ্ছি। সমস্যাগুলোর সমাধান হতে সময় লাগবে। তিনি বলেন, মেয়র মহোদয় কাছে আপনাদের মাধ্যমে জোড় অনুরোধ রইল, তিনি যেন এই এলাকার উন্নয়নে দ্রুত ব্যবস্থা নেন।
৬৫ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামছুদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, মেয়র মহোদয় যাত্রাবাড়ী থেকে যে খাল খনন ও উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেছেন তা মাতুয়াইলের ভিতর দিয়ে গেছে। সেটি সংস্কার হলে এই এলাকার পানিবদ্ধতা সমস্যা আর থাকবে না। তিনি বলেন, মশার ওষুধ ছিটানোসহ এলাকাবাসীর সব ধরনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা খুব শিগগিরিই হয়ে যাবে বলে আশা করছি।
৬০ নং ওয়ার্ডের পাটেরবাগ এলাকায় দেখা গেছে, সড়কের চিহ্ন থাকলে চলাচলের অবস্থা নেই। এমনও সড়ক আছে যেগুলোর পাশের জমিতে এখনও ধান লাগানো হয়। অথচ আশপাশে অনেক বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা দবির উদ্দিন বলেন, আমাদের এখানে গ্যাস থাকলেও পানির সমস্যা। বহুবার অভিযোগ করেও কাজ হয়নি। সড়ক বলতে সেই পুরাতন আমলের মাটির সড়কই চলাচলের জন্য ভরসা। উন্নয়নের ছিঁটেফোটার ছোঁয়া লাগেনি। বলতে গেলে আমরা এখনও গ্রামেই বসবাস করছি। ৬৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহমুদুল হোসেল পলিন বলেন, নতুন ওয়ার্ডগুলোতে সমস্যার অন্ত নাই। আর পানিবদ্ধতা তো আছেই। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে থাকে। এ ছাড়া যেখানে সেখানে ময়লা বর্জ্য ফেলা হয়। ময়লা ফেলার জন্য নির্দ্দিষ্ট কোনো ডাস্টবিন নাই। এ কারণে পরিবেশ বলতে কিছুই নাই। তিনি বলেন, এসব বিষয়ে মেয়র মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু বাজেট না থাকায় তিনিও কিছু করতে পারছেন না। তিনি বলেন, পুরাতন ওয়ার্ডগুলো যে সব সুবিধা পাচ্ছে, আমরা তা মোটেও পাচ্ছি না। ডিএনডি প্রজেক্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত মেয়র মহোদয় অপেক্ষা করতে বলেছেন। ৬০ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, ড্রেনেজ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় ন্যূনতম সুবিধা বলতে যা বোঝায় আমরা তাও পাচ্ছি না। অথচ শুনেছি সিটি করপোরেশনের ট্যাক্স বসানোর প্রক্রিয়া চলছে। সুবিধা না পেলে আমরা কেন ট্যাক্স দিবো? ৬১ নং ওয়ার্ডের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর ময়লা ভাগাড় তৈরী করা হয়েছে। এর পাশেই দনিয়া কলেজ এবং কয়েকটি নামকরা মাদরাসা। দুর্গন্ধে আশপাশ দিয়ে হাঁটাও যায় না। দনিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা জয় ময়লা ও বর্জ্য অপসারণের দায়িত্ব নেয়ার পর এলাকা ময়লার সয়লাব। এদিকে, নতুন ওয়ার্ডগুলো পড়েছে ঢাকা-৪ ও ঢাকা-৫ সংসদীয় আসনে। একজন জাতীয় পার্টি এবং অন্যজন আওয়ামী লীগের এমপি। সবগুলো ওয়ার্ডের রাস্তা ফুটপাত দখল করে দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পুলিশের সহযোগীতায় এসব দোকান থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। এ কারণে রাস্তা বা ফুটপাত দিয়ে পায়ে হাঁটাও যায় না। দনিয়া এলাকার ব্যবসায়ী সহিদ বলেন, রাস্তা দখল করে দোকান বসানোর কারণে আমাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু কাকে বলবো এ দুঃখের কথা। দখলদারদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না। সরেজমিনে দেখা গেছে, দনিয়া এলাকায় বর্ণমালা স্কুল রোডের দুপাশ দখল করে শতাধিক ফাস্টফুডের দোকান বসানো হয়েছে। এ ছাড়া সবগুলো ওয়ার্ডে অবাধে চলছে নিষিদ্ধ ব্যটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। এগুলোর চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণেও এমপির লোকজন।
উন্নয়ন বঞ্চিত নতুন ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৪ নম্বর ওয়ার্ড। ভয়াবহ মশার উপদ্রব আর রাস্তার খানা-খন্দে জর্জরিত এ ওয়ার্ডের পশ্চিম নন্দীপাড়া। সিটি কর্পোরেশনের অধীনে এলেও এখানে নেই কোনো ভালো স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও খেলার মাঠ। এসব এলাকায় মিলছে না সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক প্রদেয় সেবাসমূহ। নেই কোনো সুয়ারেজ সিস্টেম। প্রায় এক লাখ বসতির জন্য এই এলাকায় ওয়াসার তিনটি পানির পাম্প থাকলেও সচল মাত্র একটি। ফলে মাসে দু-এক বার পানির জন্য হাহাকার থাকে এই এলাকায়।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের ১১টিতে ইতোমধ্যেই প্রাথমিকভাবে উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। বাকি সাতটি ওয়ার্ডেও পর্যায়ক্রমে উন্নয়ন কাজ শুরু হবে। মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোতে বাসযোগ্য নগরীর রূপ দিতে শিগগিরই কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া মান্ডা, ডেমরা, নাসিরাবাদ ও দক্ষিণগাঁও এলাকার ওয়ার্ডগুলোর জন্য ৫১৫.৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮১.৩৬ কিমি রাস্তা, ৬১.৭৯ কিমি নর্দমা, ৭.৯৫ কিমি ফুটপাথ ও ১২টি আরসিসি ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পের উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। এসব বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান প্রকৌশলী রেজাউর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, পুরো এলাকাজুড়েই আমরা একটি মাস্টারপ্লান হাতে নিয়েছি। এজন্য কনসালটেন্টও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখন কাজ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। নতুন ১৮টি ওয়ার্ড নিয়ে আলাদা কোন পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন-পুরাতন কোন ইস্যু না। সবগুলো ওয়ার্ড নিয়েই মাস্টারপ্লান। জনদুর্ভোগ নিরসনে দ্রুতই কাজ শুরু করার পরিকল্পনা আছে আমাদের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন