সীমান্তে ‘পান থেকে চুন খসা’র মতো ব্যাপারেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশীদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা এবং ধরে নিয়ে যাওয়াসহ নির্যাতন করে। বিষয়টি বছরের পর বছর ধরে চলছে। দুই দেশের মধ্যে ‘সীমান্ত হত্যা’ শূন্যে নামিয়ে আনার সমঝোতা হলেও বিএসএফ তা মেনে চলছে না। উল্টো সীমান্ত হত্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের সাড়ে আট মাসে বিএসএফ ৩৯ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। গত বছর হত্যা করে ৪৩ জনকে, যার মধ্যে ৩৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ বছরে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশীকে বিএসএফ হত্যা করেছে। এসব হত্যাকান্ডের সমর্থনে বিএসএফ প্রধানত ‘গরু পাচারকারি’দের ওপরই দোষ চাপিয়েছে। বিএসএফ-এর এ অভিযোগ যে সত্যের অপলাপ ছাড়া কিছুই নয়, তা ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই-এর অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে। বলা যায়, সিবিআই থলের বিড়ালটি বের করে দিয়েছে। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার বিষয়টিকে গরু পাচারকারি হত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা যে ঢাহা মিথ্যা তা তাদের তদন্তে প্রকাশিত হয়েছে। তদন্তে বলা হয়েছে, সীমান্তে গরু পাচারের সাথে বিএসএফ নিজেই জড়িত। বহুদিন ধরে বিপুল অর্থের বিনিময়ে গরু পাচারে সাহায্য করে আসছে বিএসএফ এবং শুল্ক বিভাগ। এ নিয়ে বিএসএফ-এর এক ব্যাটেলিয়ন কমান্ডেন্টের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। বিএসএফ এবং শুল্ক বিভাগের এমন আরও বেশ কয়েকজন অফিসার সিবিআই-এর নজরে রয়েছে।
বিশ্বের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তই সবচেয়ে ‘রক্ষক্ষয়ী’ এবং ‘প্রাণঘাতী’ সীমান্ত হিসেবে চিহ্নিত। এমন সীমান্ত আর কোনো দেশে নেই। আগে ফিলিস্তিনিদের গাজা ভূখন্ডের সঙ্গে ইসরাইলে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মেক্সিকোর সীমান্তকে সবচেয় প্রাণঘাতী হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। ভারতের সাথে বাংলাদেশসহ চীন, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের সীমান্ত থাকলেও সেখানে বাংলাদেশ সীমান্তের মতো হত্যাকান্ড হয় না। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা ও নির্যাতন করার পেছনে বিএসএফ একটি কমন কথা ‘গরু পাচারকারি’ হিসেবে অভিহিত করে। তাদের এই অজুহাত কতটা সত্য তা কখনো তদন্ত করে দেখা হয়নি। এবার ভারতেরই গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই তদন্ত করে জানিয়ে দিয়েছে, বিএসএফ-এর এসব অজুহাতের কোনো ভিত্তি নেই এবং স্বয়ং বিএসএফই গরু পাচারের সাথে জড়িত। সিবিআই জানিয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী বিএসএফকে সীমান্তে গরু ধরতে হয়। খাতা-কলমে দেখাতে হয়, মাসে কতজন পাচারকারিকে গ্রেফতার করেছে এবং কত গরু উদ্ধার হয়েছে। এ নিয়মের সূত্র ধরে বিএসএফ বিভিন্ন সীমান্তে বাজেয়াপ্ত গরু ধরে তা খাতায় ‘বাছুর’ হিসেবে উল্লেখ করে নিলামে বিক্রি করে। নিলামে উঠা গরু চাতুর্যের সাথে সেই পাচারকারিদের কাছেই বিক্রি করে দেয় এবং তা পুনরায় পাচার করতে সহযোগিতা করে। বিএসএফ-এর এ ধরনের চাতুরির দায় চাপানো হচ্ছে বাংলাদেশীদের ওপর এবং সীমান্তে গুলি ও নির্যাতন করে হত্যা করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে বিএসএফ গরু পাচারের সঙ্গে বিজিবিকে দায়ী করলে বিজিবি এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বিএসএফকেই দায়ী করে। অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মধ্যেই সিবিআই-এর তদন্তে প্রকৃত সত্য উন্মোচিত হয়েছে। সিবিআই সূত্র এ কথাও জানিয়েছে, গরু পাচারের সাথে অস্ত্র পাচারের মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটছে। সীমান্তে শুধু গরু পাচারকারি অজুহাতে বিএসএফ বাংলাদেশীদের হত্যা করছে তা নয়, মাছ ধরা, সীমান্ত অতিক্রম করার মতো ঠুনকো অজুহাতেও হত্যা করছে। অথচ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বহু জায়গায় দুই দেশের মানুষ পারস্পরিক সহবস্থান এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে বসবাস করছে। পাশাপাশি জমিতে চাষাবাদ করছে, এমনকি বাংলাদেশের মসজিদে এসে ভারতীয়রা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছে।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে এখন বন্ধুত্বের ‘সোনালী অধ্যায়’ চলছে বলা হলেও, ভারত যে তা বিশ্বাস করে না, এটা সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হচ্ছে। এমন কোনো মাস নেই, যে মাসে বিএসএফ সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা করছে না। সম্পর্কের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মধ্যে এই যে রক্তের দাগ, তা কি করে বন্ধুত্বের নিদর্শন হয়? ভারত সরকার মুখে মুখে বন্ধুত্বের কথা বললেও তারই সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশীদের চরম শত্রু মনে করে গুলি ও নির্যাতন করে হত্যা করছে। তাহলে, ভারত সরকার ও বিএসএফ কি আলাদা? এমনটা মনে করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। ভারত সরকার যদি আন্তরিকভাবে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে চায়, তবে বিএসএফ-এর পক্ষে সীমান্তে গুলি ও নির্যাতন করে বাংলাদেশী হত্যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। দুই দেশ সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করলেও ভারত তা মানছে না। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিজিবি ও বিএসএফ-এর যৌথ সীমান্ত সম্মেলনেও সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি পুর্নব্যক্ত করেছে ভারত। এখন দেখার বিষয়, এ প্রতিশ্রুতি ভারত কতটা প্রতিপালন করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন