মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

আদিবাসী প্রসঙ্গ এবং ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন

প্রকাশের সময় : ১৩ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুন্শী আবদুল মাননান
বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। এতে বক্তব্যে রাখেন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ, নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবীর, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, অধ্যাপিকা সাদেকা হালিম প্রমুখ।
ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে আধিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন মহল থেকে জোর চেষ্টা চলছে। উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলো যেমন নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করছে, তেমনি কিছু মহলও একই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত আদিবাসী ফোরাম গঠনের লক্ষ্যই হলো, ওইসব জনগোষ্ঠীর আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করা। বিশ্ব আদিবাসী দিবসে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠানাদির আয়োজনের লক্ষ্যও মূলত একই। এখানে স্মরণ করা দরকার, অতীতে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলোর আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দেয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা একযোগে নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দাবি করছে কেন, তা একটি বড় প্রশ্ন। সাধারণ অর্থে কোনো দেশ বা অঞ্চলের বা ভূখ-ের সর্বপ্রাচীন অধিবাসীদের আদিবাসী বলে অভিহিত করা হয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলো নিজেদের আদিবাসী দাবি করে এটা প্রমাণ করতে চাইছে, বাংলাদেশের বা তার বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের তারাই সর্বপ্রাচীন আদিবাসী। এই দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাংলাদেশের বা ওইসব অঞ্চলের ভূমি বা সম্পদের ওপর তাদের একটি বিশেষ অধিকার জন্মে এবং সেই অধিকার কায়েমের পথ প্রশস্ত হয়।
অথচ ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, হাজংসহ কোনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীই বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন আধিবাসী নয়। তারা মাত্র কয়েকশ বছরের ব্যবধানে অন্যান্য দেশ থেকে এসে বাংলাদেশে বসতি স্থাপন করেছে। বাংলাদেশে বাঙালিরাই সর্বপ্রাচীন অধিবাসী বা আদিবাসী। ইতিহাসের এই সাক্ষ্য এখন স্বীকার বা মান্য করতে চাইছে না উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলো এবং কিছু মহল। তারা যে কোনো মূল্যে নিজেদের বা উপজাতীয়দের আদিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। ইতোমধ্যে আমরা বিভিন্ন সময় ইতিহাসের অকাঠ্য তত্ত্ব-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি (আরো অনেকে দেখিয়েছেন) বাংলাদেশে যেসব উপজাতীয় জনগোষ্ঠী বসবাস করে তাদের কেউই বাংলাদেশের আদিবাসী নয়। উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলো যেমন তেমন দেশের চিহ্নিত কিছু মহল সেটা মানতে নারাজ। তারা লাগাতার তাদের লক্ষ্য হাসিলে কাজ করে যাচ্ছে। ঘটা করে আদিবাসী দিবস পালন ওই তৎপরতারই অংশ। লক্ষ্যণীয়, ওই দিনের অনুষ্ঠানে পূর্বে উল্লিখিত বক্তারা সবাই উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী অভিধায় চিহ্নিত করে তাদের অধিকার সম্পর্কে বক্তব্য দিয়েছেন। সন্তু লারমার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সরকারের সমালোচনা করেছেন। সন্তু লারমা সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, সরকার ‘আদিবাসীদের’ অধিকারের প্রশ্নে আন্তরিক নয়। এটা নানাভাবে নানা যৌক্তিকতার মাধ্যমে প্রমাণ করা যায়। তিনি অভিযোগ করেছেন, বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগ ‘আদিবাসীদের’ অধিকারের পক্ষে কাজ না করে জনসংহতি সমিতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ‘আদিবাসীদের’ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি এর প্রতিকার চেয়েছেন এবং সবাইকে সংগ্রামী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, আমাদের সবাইকে নিজেদের প্রয়োজনেই সংগ্রামী হতে হবে। সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকতে হবে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে দেশ স্বাধীন হলেও ‘আদিবাসীরা’ শোষণমুক্ত হওয়া তো দূরের কথা ‘আদিবাসী’ পরিচয়ই পাননি। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে তথা রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই ‘আদিবাসীদের’ মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের অধিকার দিতে হবে। আদিবাসী স্বীকৃতি সরকারি তরফ থেকে না আসায় অত্যন্ত মনোবেদনা প্রকাশ করে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, আমাদের দেশে এখনো ‘আদিবাসীরা’ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো তাদের শিক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারিনি। এটা অত্যন্ত বেদনার ও হতাশার কথা। ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, কোনো জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণ করে কোনো রাষ্ট্র শক্তিশালী হতে পারে না। সে রাষ্ট্রটি মাথা উঁচু করেও বিশ্বের দরবারে দাঁড়াতে পারে না। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও দার্শনিক ভিত্তি ছিল রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের প্রাপ্ত অধিকার দেয়া। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও ‘আদিবাসীরা’ সে সুযোগ পায়নি। পার্বত্য শান্তি চুক্তি প্রণয়নের পর ‘আদিবাসীরা’ তাদের ভূমির অধিকার সংরক্ষণের জন্য যে দাবি জানিয়ে আসছিল সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বা সংরক্ষিত হয়নি। মামুনুর রশীদ বলেছেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে যে নিয়ম-কানুন হয়েছে, তার কোনোটিই তেমনভাবে কার্যকর হয়নি। অথচ তা হলে ‘আদিবাসীদের’ বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন মান আরো উন্নত হতো।
অন্যদের বক্তব্য প্রায় একই রকম। কাজেই তাদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। যাদের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের বক্তব্যের সারকথা হলো : কথিত আদিবাসীদের অধিকার অনর্জিত রয়েছে। ভাবটা এরকম যেন উপজাতীয় বাদে দেশের সকল মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রকৃত বাস্তবতা এই যে, উপজাতীয়দের চেয়েও দেশের বহু মানুষ শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-বাকরি, অর্থনৈতিক অবস্থা ও সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তারা উপজাতীয়দের অধিকার অনর্জিত থাকার জন্য সরকারকেই দায়ী করেছেন। সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন সরকার কেন উপজাতিদের আদিবাসী বলে না, এ জন্য। তাদের এই ক্ষোভ একটি অযৌক্তিক ও অনৈতিক দাবির প্রতি সমর্থনেরই নামান্তর। সরকার বরাবরই বলে আসছে, বাংলাদেশে তথাকথিত কোনো আদিবাসী নেই। এটাই রাষ্ট্রের অবস্থান। বস্তুত, তারা রাষ্ট্রের এই অবস্থানের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান নির্দিষ্ট করেছেন। উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হলে কী ধরনের বিপদ হতে পারে সে বিষয়ে অনেকেই আলোকপাত করেছেন।
যে সন্তু লারমা উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী বানানোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যিনি একই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতিও বটেন, তিনি এক সময় তথাকথিত শান্তি বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই ‘শান্তি বাহিনী’ বছরের পর বছর ধরে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, মানুষ হত্যা করেছে, অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি করেছে। ‘শান্তি বাহিনীর’ লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করা। গত শতকের ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ‘শান্তি বাহিনী’র দৌরাত্ম্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তখন সরকার দু’টি পন্থা অবলম্বন করে। প্রথমত, নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং যথাসম্ভব এই বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দমন করা। দ্বিতীয়ত, শান্তি স্থাপনের জন্য ‘শান্তিবাহিনী’র সঙ্গে আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত রাখা। ‘শান্তি বাহিনী’ সে সময় আলোচনায় পাঁচ দফা দাবিনামা পেশ করে। মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক তার একটি লেখায় ওই পাঁচ দফা দাবির প্রথম দফাটি উল্লেখ করেছেন। দফাটি এই : ‘বর্তমান বাংলাদেশকে দু’টি প্রদেশে ভাগ করা হবে। একটি প্রদেশের নাম হবে বাংলাদেশ, রাজধানী ঢাকা। আরেকটি প্রদেশের নাম হবে জুম্মল্যান্ড; রাজধানী রাঙামাটি। ২টি প্রদেশ মিলে একটি ফেডারেশন হবে, ফেডারেশনের নাম হবে ফেডারেল রিপাবলিক অব বাংলাদেশ, রাজধানী ঢাকা। সাংবিধানিকভাবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে বিষয় বণ্টন হবে; শুধু চারটি বিষয় থাকবে কেন্দ্রের হাতে, বাকি সব প্রাদেশিক সরকারের হাতে।’ সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম অতঃপর লিখেছেন: ‘শান্তি বাহিনীর পাঁচ দফা দাবিনামা ছিল অনেকটাই ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কর্তৃক পাকিস্তান সরকারের কাছে উপস্থাপিত ছয় দফা দাবিনামার অতিকিঞ্চিৎ সংশোধিত রূপ। পাঁচ দফা দাবিনামা মেনে নেয়া মানে ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মানচিত্র আবারো অংকন করা।’
বলা বাহুল্য, এ দাবিনামা মানা সম্ভব ছিল না এবং মানাও হয়নি। ‘শান্তি বাহিনী’ আনুষ্ঠানিকভাবে তার দাবিনামা পেশ করে ১৯৮৭ সালে। এর দশ বছর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি ও পার্বত্য জনসংহতি সমিতির মধ্যে একটি চুক্তি হয় যা ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এই চুক্তির পর এত বছর অতিবাহিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বলা যাবে না। জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠাকামীরা তাদের লক্ষ্য থেকে সরে এসেছে, এমন দাবিও জোর দিয়ে কেউ করতে পারে না। পর্যবেক্ষকদের মতে, তারা এখনো তৎপর ও সক্রিয়। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে উঠেছে। তারা হত্যা, চাঁদাবাজি ও জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
এর মধ্যেই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১’ সংশোধিত হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ গত ৮ আগস্ট প্রণয়ন ও জারি করেছেন মাননীয় প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৯ সালে ৩ জুন বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে সরকার ল্যান্ড কমিশন গঠিত করে। ২০০১ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১’ প্রণীত হয়। ওই সময়ই এই আইন নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বাঙালীদের ভূমি অধিকার এই আইনে খর্ব হয়েছে। জনসংহতি সমিতিও এ আইনের ব্যাপারে আপত্তি তোলে। তার মতে, এতে উপজাতীয়দের ভূমি অধিকার নিরংকুশ হয়নি। কমিশনের নিয়ন্ত্রণও রয়ে গেছে সরকারের হাতে। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না। শুধু এটুকু বলবো যে, জনসংহতি সমিতি আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে আইনের ১৯ দফা সুপারিশ পেশ করে। এই সংশোধনীগুলো পেশ করা হয় বাঙালীদের ভূমি অধিকার আরো খর্ব ও অনিশ্চিত করে উপজাতীয়দের অধিকার নিশ্চিত ও সংহত করার জন্য এবং কমিশনের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার জন্য। যতদূর জানা গেছে, আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে আসা জনসংহতি সমিতির সংশোধনী প্রস্তাবগুলো সংশোধিত আইনে গুরুত্ব ও প্রাধান্য পেয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে কম; সংক্ষেপে দুয়েকটি বিষয় ও প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করছি।
এক : মূল আইন বা ২০০১ সালে প্রণীত ৫৩ নং আইনের ৪ ধারার ২ উপধারায় উল্লিখিত ‘যে কোনো পার্বত্য জেলায়’ শব্দগুলোর পরিবর্তে সংশোধিত আইনে ‘যে কোনো পার্বত্য জেলাসহ অন্য কোনো স্থানে’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। ৪ নং ধারাটি কমিশনের কার্যালয় সংক্রান্ত। দেখা যাচ্ছে, মূল আইনে এর শাখা কার্যালয় যে কোনো পার্বত্য জেলায় স্থাপন করার কথা থাকলেও সংশোধিত আইন অনুযায়ী অন্য কোনো স্থানেও স্থাপন করা যাবে। অর্থাৎ কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরেও দেশের যে কোনো স্থানে শাখা কার্যালয় স্থাপন করতে পারবে।
দুই : ২০০১ সালের আইনের ৬ ধারার উপধারা (১) এর
(ক) দফা (ক) এর পরিবর্তে সংশোধিত আইনে দফা (ক) প্রতিস্থাপিত হয়েছে এভাবে : (ক) পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং অবৈধ বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, নীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পন্ন করা;
(খ) দফা (খ) তে উল্লিখিত ‘আইন ও রীতি’ শব্দগুলির পরিবর্তে ‘আইন, রীতি ও পদ্ধতি’ শব্দগুলি ও কমা প্রতিস্থাপিত হইবে;
(গ) দফা (গ) এর পরিবর্তে যা প্রতিস্থাপিত হয়েছে তা এরকম : (গ) পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন। নীতি ও পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে চলে আসা ভূমিসহ (ঋৎরহমব খধহফ) কোনো ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান বা বেদখল করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিল করণ এবং বন্দোবস্তজনিত বা বেদখলজনিত কারণে কোনো বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল;
তবে শর্ত থাকে যে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী অধিগ্রহণকৃত এবং বসতবাড়িসহ জলে ভাসা ভূমি, টিলা ও পাহাড় ব্যতীত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা এবং বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকার ক্ষেত্রে এই উপধারা প্রযোজ্য হইবে না।’
উল্লেখ করা দরকার, মূল আইনে এই ‘শর্তের’ অংশটি ছিল এরকম। ‘তবে শর্ত থাকে যে, প্রযোজ্য আইনের অধীনে অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং রক্ষিত (জবংবৎাবফ) বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া। ভূ-উপগ্রহ এলাকা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প-কারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমির ক্ষেত্রে এই উপধারা প্রযোজ্য হইবে না।’
এখানে বিবেচ্য বিষয় এই যে, ‘আইন ও রীতি’র জায়গায় ‘আইনে, রীতি ও পদ্ধতি’ প্রতিস্থাপিত হলো যেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অন্যদিকে ‘শর্তের’ জায়গায় বনাঞ্চল, এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প-কারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমি বাদ গেল কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অনেকের অভিমত, পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই-তৃতীয়াংশ ভূমিই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এখন এই বনাঞ্চলের ভূমির দাবীও যে উপজাতীয়রা করতে পারবে।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কথা নিয়ে আমরা ইতি টানবো এই নিবন্ধের। তিনি আগে উল্লেখিত নিবন্ধের শেষাংশে বলেছেন; ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি মোটেই শান্তিময় নয়। আট দশ দিন আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন আইন সংশোধিত হলো। আমার মতে, সংশোধনীর কারণে সমস্যা বাড়বে। যা হোক, বিবেচনা সরকার করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার এই মুহূর্তের ক্রাক্স বা চুম্বক অংশ হলো একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর। প্রশ্নটি হলো, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা থাকবে কি থাকবে না ? যদি থাকে, তাহলে কত সংখ্যক ও কোন কোন শর্তে ?’ এক মানববন্ধনে তিনি বলেছেন : ‘১৯৮৭ সালে পার্বত্যাঞ্চলের এসব দেশদ্রোহীরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলো পুরো বাংলাদেশ দু’টি ভাগে ভাগ করার। এক ভাগের নাম বাংলাদেশ, যার রাজধানী ঢাকা। আর এক ভাগের নাম হবে জুম্মল্যান্ড, যার রাজধানী রাঙামাটি। এই দুটি অংশ মিলে একটি ফেডারেল সরকার হবে। তখন আমরা রাজি হয়নি। কিন্তু বর্তমান ভূমি আইন বাস্তবায়নের ফলে বিদ্রোহীদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন