পর্যটন শহর কক্সবাজারের কলাতলী মোড়ে নির্মাণাধীন ভবনেরই কয়েকটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে চলছে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষা কার্যক্রম। কক্সবাজারে আসা পর্যটক, যাত্রী ও যানবাহন সবমিলিয়ে দিনভর ভবনটির সামনে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। পরিবেশ না থাকলেও এর মধ্যেই চলছে প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন পায় কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (সিবিআইইউ)। সাতটি বিভাগ মিলে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সংখ্যা ৩০ জনের কম। একজন অধ্যাপকও নেই। সহযোগী অধ্যাপক মর্যাদার শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। একটি অপরিসর কক্ষে কয়েকটি চেয়ার ও বুক শেলফ বসিয়েই বলা হচ্ছে গ্রন্থাগার। স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়েও অভিযোগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো ভিসি নেই। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসনিক পদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রায় সবারই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রেজারার অধ্যাপক আবদুল হামিদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো স্থায়ী ভিসি নিয়োগ দেয়া হয়নি। অথচ একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে একজন পূর্ণকালীন ভিসির বিকল্প নেই। এছাড়া ট্রাস্টি সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের দ্ব›দ্ব বিরাজ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক বলেন, এসএমএস পাঠিয়ে ক্লাসে যেতে নিষেধ করা হয়। এমনকি বকেয়া বেতনও পরিশোধ করা হয়নি। তাদের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি চাইলে তারা তা দিতেও সম্মত হচ্ছে না। এখানে কোনো ধরনের সার্ভিস রুল মানা হয় না। সবচেয়ে ভয়ানক তথ্য হলো কোর্সের চ‚ড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ হলো আমার কাছ থেকে মিড-টার্ম ও অ্যাটেনডেন্স ইনফো নেয়া ছাড়াই।
শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ক্লাস-পরীক্ষার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেমিস্টার ফি জমা দেয়া। এছাড়া ভবনের কয়েকটি ফ্লোরে ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষার্থীদের জন্য তেমন কোনো সুবিধাই নেই। হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, কোনো বিবেচনাই এটিকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না। ম্যানেজমেন্টের টাকাই মুখ্য।
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে আর্থিকসহ নানা সুবিধা নিচ্ছে ট্রাস্টি সদস্যরা। ট্রাস্টি সদস্যদের নির্দেশে দেয়া হয়েছে অসংখ্য অবৈধ নিয়োগ। এক পর্যায়ে অর্থ আত্মসাৎ ও নিয়োগে আধিপত্যকে কেন্দ্র করে ট্রাস্টের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকালীন বিওটির চেয়ারম্যান ছিলেন সালাহউদ্দিন আহমদ। আর সেক্রেটারি ছিলেন লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান। বাকি আট সদস্যের সবাই বিওটি সেক্রেটারির স্ত্রী, ভাই, ভাতিজা ও শ্যালকসহ নিকটাত্মীয়। এজন্য মূলত বিওটি চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন আহমদ ও সেক্রেটারি লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান এ দুই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হতো সিবিআইইউ।
অনৈতিক সুবিধা ও নিয়োগে আধিপত্যকে কেন্দ্র করে গত বছর বিওটি চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন আহমদ ও সেক্রেটারি লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমানের মধ্যে বড় আকারের বিভাজন তৈরি হয়। দ্ব›েদ্বর জেরে কয়েক মাস আগে বিওটির সভা করে সালাহউদ্দিন আহমদকে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তার স্থলে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান করা হয়েছে কক্সবাজার-১ আসনের এমপি জাফর আলমকে।
এ প্রসঙ্গে লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা আমি। সালাহউদ্দিন আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান করা হয়। কিন্তু গত সাত বছরে বিশ্ববিদ্যালয় তার কাছ থেকে কোনো ধরনের সহায়তাই পায়নি। উল্টো নানা খাত দেখিয়ে লাখ-লাখ টাকা নিয়েছেন।
অন্যদিকে নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা দাবি করে লায়ন মুজিবুর রহমানসহ তার পক্ষের সদস্যদের বাদ দিয়ে নতুন ট্রাস্ট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমদ। এজন্য সরকারের কাছে একটি আবেদন করেছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী উখিয়ার জনসভায় এসে আমাকে এ বিশ্ববিদ্যালয় দেয়ার ঘোষণা দেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাওয়ার জন্য আবেদন করি। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত থাকায় মুজিবুরকে বিশ্বাস করে যোগাযোগকারী হিসেবে নিয়োগ করি। কিন্তু সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করে নিজের মতো ট্রাস্ট গঠন করে। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নিজেকে উদ্যোক্তা করেছেন মুজিবুর। এ বিষয়টি সংশোধনের জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষিত তহবিল ও স্থায়ী ক্যাম্পাসের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মুজিবুর। এ নিয়ে আদালতে মামলাও রয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসির সদস্য ড. দিল আফরোজা বেগমকে আহŸায়ক ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক নজরুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন করে কমিশন। অন্য দুই সদস্য হলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক ড. মো. ফখরুল ইসলাম ও উপপরিচালক মুহম্মদ নাজমুল ইসলাম।
ইউজিসির সদস্য ও তদন্ত কমিটির আহŸায়ক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, ইন্টারভিউয়ের দেয়ার জন্য তাকে ডেকেছি। পরবর্তী সময়ে জানলাম, মুজিবুর মামলায় সাজা পেয়ে গ্রেফতার হয়েছেন। তাই সাক্ষাৎকার বাতিল করি।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিষয়টি আমি জেনেছি। সেখানে উচ্চশিক্ষার মান খুবই নিম্নমানের। বিওটি নিয়েও ঝামেলা চলছে। পরিস্থিতি ঠিক করতে একটি তদন্ত দল কাজ করছে। এখন একটি পক্ষ বলছে, তদন্ত দল তাদের মতামত না নিয়ে প্রতিবেদন দিচ্ছে। আমার কর্মকর্তারা বলছেন, আইন অনুযায়ী কোনো মামলায় সাজা পাওয়া ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ নেই। আইনের বিষয়টি চেক করে দেখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন