কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিণতির কথা বিবেচনা করে আবারো মাদরাসা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা দানের জন্য ঢাকায় একটি এফিলিয়েটিং ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ওঠে। এ আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুদার্রেছীন ও বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া। চারদলীয় জোট সরকার কোনো অবস্থাতেই মাদরাসা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আলাদা ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি মানতে রাজি হয়নি। বরং মাদরাসার ফাযিল ও কামিলের পরীক্ষা, মান ও সার্টিফিকেটের এফিলিয়শনের দায়িত্ব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যস্ত করার জন্য একটি ইসলামী মহল তোড়জোড় চেষ্টা চালায়। শেষ পর্যন্ত গণদাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালে ঢাকায় স্বতন্ত্র ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে।
এ বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে সারা দেশের ফাযিল ও কামিল স্তরের পরীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও সার্বিক চালচিত্র দেখে ইতোমধ্যে আলেম সমাজ ও দ্বীনি মহলে সমালোচনা শুরু হয়েছে এবং অনেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি হতাশা প্রকাশ করছেন। প্রয়োজন ছিল গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে জনগণের বিশেষ করে মাদরাসাছাত্র-শিক্ষকদের চাহিদার আলোকে পথ চলতে সাহায্য করা বা বাধ্য করা। কিন্তু বাস্তবতা হল বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবতেও প্রস্তুত নয় বলে মনে হচ্ছে।
আসলে আমাদের জাতীয় চরিত্রই হল হুজুগে বাঙ্গালি। দূরদর্শিতা নিয়ে কাজ করতে আমরা অভ্যস্ত নই। আমার বাপ-দাদার ভিটেমাটি, নিজের কেনা জমি অন্যে এসে ভোগ দখল করছে তা নিয়ে কোনোই মাথাব্যথা নেই। বড় আশ্চর্য! ধর্মকর্মে ফরজ নির্ণয়ে মনোনিবেশ করার চাইতে আবেগ তাড়িত হওয়াতেই আমরা আনন্দ পাই। নিউস্কীম মাদরাসার নামে বাপদাদার, আল্লাহর অগণিত ওলীর রক্ত পানিকরা পয়সা দিয়ে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো স্কুল-কলেজ হয়ে গেল, শতাব্দিকালের আন্দোলনের ফসল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চরিত্র বদলে ফেলল, নতুন করে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ও একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে তাতে হুঁশ নেই। আশ্চর্য!
দক্ষিণ বাংলায় ইসলামের পরিচর্যায় শর্ষীণা মাদরাসার অবদান অনস্বীকার্য। শোনা যাচ্ছে, আলিয়া নেসাবের মাদরাসা শিক্ষায় আরবি ও কুরআন হাদীসের শিক্ষার নির্দয় সঙ্কোচন দেখে তারা খেই হারিয়ে ফেলেছেন। মাদরাসা দ্বীনিয়া নামে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। নতুন মাদরাসা প্রতিষ্ঠাকে যে কেউ সাধুবাদ দিতে বাধ্য। কিন্তু হতাশ নিরাশ হয়ে আলিয়া মাদরাসাগুলোকে ত্যাগ করার মানসিকতা কোনোদিনও সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
ইদানিং শিক্ষা ব্যবস্থায় নাস্তিক্যবাদী ধ্যান-ধারণার বিস্তার ও মূর্তি সংস্কৃতি প্রচলনের যে তোড়জোড় চলছে তাতে কিছুলোক প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। আরেক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবিকে দেখা যাচ্ছে। তারা এ কথা বলে আনন্দ পাচ্ছেন যে, এমনটি হলে জনগণ নতুন করে ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে। এমন যুক্তি পলায়নি মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষিত ও চিন্তাশীল মহলের কাছ থেকে এমন যুক্তি শোনার পর সাধারণ দ্বীনদার মানুষ এই বলে মনে স্বান্তনা খোঁজেন যে, আল্লাহর দ্বীন আল্লাহ রক্ষা করবেন। আল্লাহ নিজেই তার দ্বীনের হেফাযত করবেন। একটা বিষয় ভালোভাবে বুঝা দরকার। আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘আমিই কুরআন নাযিল করেছি এবং এর হেফাযত আমিই করব।’ (সূরা হিজর, আয়াত-৯) কিন্তু আল্লাহ পাক কি জমিনে নেমে এসে কুরআনের হেফাযত করেন। এই হেফাযতের একটি কাজ আঞ্জাম দেন হাফেজগণ। আল্লাহর দ্বীনের হেফাযতের দায়িত্বও পালন করতে হবে পৃথিবীতে তার খলিফা হিসেবে ঈমানের সূত্রে আমানতপ্রাপ্ত ঈমানদারদের। যদি খেলাফতের এ দায়িত্ব পালন না করে তাহলে এর শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ।
এক সময়ে বাংলা সাহিত্য চর্চার লালনভুমি ছিল আরাকানের রাজসভা। সেখান থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলমানদের অবস্থা কত করুণ ভাবাও যায় না। দীর্ঘ সাতশ বছর মুসলমানরা ভারতবর্ষ শাসন করেছেন। দ্বীনের প্রতি উদাসীন শাসকরা যোগ্যতা হারানোর পর তাদের রক্ষার জন্য আল্লাহ পাক সরাসরি নেমে এসে দিল্লীর মসনদ রক্ষা করেননি। বিশ্বের দিকে দিকে একই চিত্র দেখা যাবে। হ্যাঁ, যেখানে মুসলমানরা আল্লাহর দ্বীন রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে সেখানে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পরাশক্তি অপমানজনক পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছে। আফগানিস্তানের মাটি থেকে আমেরিকার নির্লজ্জভাবে বেরিয়ে যাওয়াকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার উপাায় নেই। বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামী শিক্ষার ওপর একের পর এক আঘাতের বেলায় ইসলামী জনতার অবহেলা ও উদাসীনতা দেখে এক অজানা বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করে আমাদের বুক কাঁপছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন