দেশে আমদানি বাড়ছে। বাড়ছে রাজস্ব আয়। তৈরি পোশাকসহ কয়েকটি পণ্যের রফতানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এ পর্যন্ত পণ্যসামগ্রী আমদানি হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ ৩৫ হাজার ২৫২ মেট্রিক টন। গতবছরের একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ২০ লাখ ৩২ হাজার ১৯৪ মেট্রিক টন। এবার ২ লাখ ৩ হাজার ৫৮ মেট্রিক টন পণ্য বেশি আমদানি হয়েছে। আমদানির পরিমাণ বেড়েছে ১০ শতাংশ।
গত ২০ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের একক বৃহৎ রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ১২ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। গতবছর এই সময়ে ১২ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়। এবার ৪শ’ ৩৫ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয় হয়েছে। বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। তবে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে এখনও পিছিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এ সময়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা। ঘাটতি রয়েছে ৫ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
যদিও চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৫৪ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৪১ হাজার ১৮৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। সে হিসেবে করোনার সময়েও অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ৫৪০ কোটি ১৭ লাখ টাকা। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আহরণে ঘাটতি হ্রাস পেয়েছে বলে এনবিআরের পরিসংখ্যানে উঠে আসে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এনবিআরের রাজস্ব আহরণে ঘাটতি ছিল প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।
অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, করোনা মহামারীতে আমাদের অর্থনীতির যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সে হিসেবে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে যদি লক্ষ্যের তুলনায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি, তাহলে সেটা খারাপ নয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার ধকল কাটিয়ে আমদানি ও রাজস্ব আদায় ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে। শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি, মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এটি শুভ ইঙ্গিতবাহী। অর্থনীতিতে পড়ছে ইতিবাচক প্রভাব।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল শনিবার দৈনিক ইনকিলাবকে অভিমত দিয়েছেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দিকে যাচ্ছে। আমদানি ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি তারই শুভ লক্ষণ। দেশের অর্থনীতির জন্য এটি সুখবর। করোনা মহামারীর কারণে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ক্ষতির সম্মুখীন। বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে যতটা ক্ষতির আশঙ্কা করা হয়েছিল তার চেয়ে ক্ষতি হয়তো কমই হবে। আমদানি ও রাজস্ব আয়ের এই ধারাবাহিকতা আরও দুই-তিন মাস দেখতে হবে। এই প্রবণতা ধরে রাখতে পারলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যা ৫ শতাংশেরও বেশি আশা করা হয়েছিল সেটা অর্জন সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার ধাক্কা সামলে সচল হচ্ছে আমদানি-রফতানি। ভোগ্যপণ্যের সাথে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, শিল্পের যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি দেশীয় শিল্প-কারখানা ও রফতানিমুখী শিল্পখাতে উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইঙ্গিত বহন করছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমদানি-রফতানি হবে গতিশীল। বিনিয়োগ-শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম দিয়ে দেশের ৯২ শতাংশ আমদানি-রফতানি বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পন্ন হয়। দেশের চলমান মেগা প্রকল্পসমূহ ও বিভিন্ন অবাকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের যান্ত্রিক সরঞ্জাম ও উপকরণ, শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানি করা হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। চট্টগ্রাম বন্দর-শিপিং এবং একক বৃহৎ রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, করোনার ধাক্কা সামাল দিয়েই আমদানি-রফতানির গতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। কিছু ক্ষেত্রে আমদানি-রফতানি গতবছরের এই সময়ের চেয়ে বেশিই হয়েছে। মেগা প্রকল্পসহ উন্নয়ন কার্যক্রম গতিশীল হওয়ায় নির্মাণসামগ্রী আমদানি বেড়েছে। আসছে শিল্পের কাঁচামাল। ভোগ্যপণ্য আমদানিও বাড়ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেছেন, বন্দরের দক্ষতা, সক্ষমতা এবং গতিশীলতা বেড়েছে। এখন দ্রুত মালামাল খালাস হচ্ছে। বন্দরে জাহাজ বা কন্টেইনার জট নেই। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কিছুটা কম হয়েছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয় ৭ লাখ ১৯ হাজার ১৯২ টিইইউএস। আগের বছর একই সময়ে হ্যান্ডলিং হয় ৮ লাখ আট হাজার ৩৬২। এ সময়ে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কম হয়েছে ৮৯ হাজার ১৭০ ইউনিট। গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে ৮৭৯টি জাহাজের আগমন ঘটে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৯৩৭টি।
তবে শিপিং সূত্র জানায়, বর্তমানে তুলনামূলক বড় আকারের জাহাজযোগে অধিক পরিমাণে পণ্য পরিবহন করা হয়। এরফলে কম সংখ্যক জাহাজ বেশি পরিমাণে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহণ করছে। চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার ধারণক্ষমতা ৪৯ হাজার ১৮। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বন্দরে কন্টেইনার মজুদ ছিল ৩৩ হাজার ৫১৫।
চট্টগ্রাম বন্দরভিত্তিক আমদানি রাজস্ব আয় বাড়তে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. ফখরুল আলম জানান, আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এরফলে রাজস্ব আদায় বাড়ছে। গতবছরের তুলনায় চলতি বছরে এ যাবত বেশি অঙ্কের রাজস্ব আয় হয়েছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্যসহ বেশকিছু পণ্যে শুল্ক-করের পরিমাণ জনস্বার্থে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এরফলে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে আছে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত প্রধান প্রধান পণ্যভিত্তিক আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৯৯ হাজার ৩২০ মে. টন। যা আগের বছরের চেয়ে ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৩ মে. টন বেশি। চিনি আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৫৪১ মে. টন। যা আগের বছরের চেয়ে এক লাখ ৮৯ হাজার ৯৫০ মে. টন বেশি। সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানি হয়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ লাখ ৪৫ হাজার মে. টন বেশি। সিমেন্ট ক্লিংকার আমদানি হয়েছে ৬৮ লাখ ১২ হাজার ৯২১ মে. টন। গতবছর আমদানি হয় ৫১ লাখ ৬৭ হাজার ৯১৮ মে. টন।
তবে পেট্রোলিয়াম আমদানি কম হয়েছে। গত তিন মাসে আমদানি ১৭ লাখ ১৫ হাজার ২২ মে. টন। আগের বছরের একই সময়ে আমদানি হয় ২৪ লাখ ৯৫ হাজার ৩৪৪ মে. টন। এবার ৭ লাখ ৮০ হাজার ৩২২ মে. টন কম আমদানি হয়েছে।
আমদানির পাশাপাশি রফতানি খাত মন্দা কাটিয়ে উঠছে। যদিও সার্বিক রফতানি গতবছরের এ সময়ের তুলনায় পরিমাণগত কিছুটা কম। গত ৩ মাসে ১৭ লাখ ৫১ হাজার ৬৩৭ মে. টন পণ্য রফতানি হয়েছে। আগের বছর একই সময়ে রফতানির পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৫৮ হাজার ৬২৭ মে. টন। গত বছরের এ সময়ের তুলনায় রফতানি পরিমাণগত কম হয়েছে এক লাখ ৬ হাজার ৯৯০ মে. টন।
তবে প্রধান রফতানি পণ্য তৈরিপোশাক, হিমায়িত খাদ্যপণ্য, পাটপণ্য এবং অ্যামেনিয়াসহ কয়েকটি পণ্যের রফতানি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে তৈরিপোশাক রফতানি হয়েছে ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৭০৪ মে. টন। গত বছর একই সময়ে রফতানির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৩৩ হাজার ২০৯ মে. টন। যা গেল বছরের তুলনায় ৩৬ হাজার ৪৯৫ মে. টন বেশি। পাটপণ্য রফতানি হয়েছে গতবছরের এই সময়ের তুলনায় ২৯ হাজার ৯৫ মে. টন বেশি। হিমায়িত খাদ্যপণ্য রফতানি হয়েছে ৬ হাজার ৫৩৪ মে. টন বেশি।
সর্বশেষ প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, করোনার সময়েও ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর) আমদানি হয়েছে এক হাজার ১৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য, যা মহামারীর পরও গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি কমেছে মাত্র ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম। আগের বছরের প্রথম তিন মাসে আমদানি হয়েছিল এক হাজার ৩২৫ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। তবে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী সামনে আমদানি আরও বাড়বে। কারণ গত কয়েক মাস থেকে দেশের জীবন ব্যবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে। তাই সামনে আমদানি আরও বাড়বে।
অপরদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে ৯৮৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি।
এই তিন মাসে রেমিট্যান্স হিসেবে এসেছে ৬৭১ কোটি ৩২ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
আর ওই রেমিট্যান্সের উপর ভর করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে এখন ৪১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করছে।
উল্লেখ্য, গত বছর ডিসেম্বরে চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর সেদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। পরে চীন থেকে আমদানি শুরু হলেও সেই ধাক্কা এখনও কিছুটা রয়ে গেছে। মার্চ মাসে বাংলাদেশে করোনাভাইাসের প্রকোপ দেখা দিলে এপ্রিল মাসে পণ্য আমদানি তলানিতে নেমে আসে। ওই মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মাত্র ১৬০ কোটি ডলারের এলসি খুলেছিলেন ব্যবসায়ীরা, যা ছিল গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ২৬৮ শতাংশ কম। আর আগের মাস মার্চের চেয়ে ২৬৩ শতাংশ কম। গত বছরের এপ্রিল মাসে ৫২৬ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। আর গত মার্চ মাসে এলসি খোলা হয়েছিল ৪৯৭ কোটি ডলারের। লকডাউন ওঠার পর এ বছরের জুন থেকে এলসি খোলার পরিমাণ বাড়ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন