প্রায়ই হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা, সিলেট ও বাগেরহাটে পুলিশ হেফাজতে চারটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ঘটনা সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ঘটেছে। এর শিকার রায়হান আহমদ নামক এক যুবক। তাকে পুলিশি হেফাজতে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে নিহতের স্বজনের দাবি। পরিবারটির ভাষ্যমতে, পুলিশ তাকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে ১০ হাজার টাকার ঘুষ চায়। বলা হয়, টাকা দিলে ছেড়ে দেয়া হবে। রায়হানের মা তার চাচাকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে পাঠান। কিন্তু পুলিশের মন গলেনি। পরে ১০ হাজার টাকা নিয়ে যাওয়া হলেও রায়হানকে আর জীবিত পাওয়া যায়নি। নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যু হয়। এ ধরনের ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অর্জিত সুনামকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এসব ঘৃণ্য ঘটনায় পুরো বাহিনী জড়িত না হলেও কিছু অসৎ সদস্যের কারণে ইমেজ ক্ষুণœ হচ্ছে। অথচ করোনা মহামারীতে পুলিশের আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উদ্ভাসিত। ব্যক্তি যত বড় অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হোক না কেন, তাকে আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি দিতে হবে, এটিই আইনের গোড়ার কথা। কাউকে বিনা বিচারে হত্যা করা যাবে না। আইনের দৃষ্টিতে বন্দুকযুদ্ধ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন আইনের শাসনের সুস্পষ্ট লংঘন।
১৯৪৭ সালের আগে বৃটিশ, ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনী মানুষের উপর জুলুম নির্যাতন করেছে। সেসব নির্যাতনের কাহিনী শুনলে আজো গা শিউরে ওঠে। বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে যারা কাজ করছেন, তারা বৃটিশও নন, পাকিস্তানিও নন; তারা আমাদের কারো ভাই, কারো ছেলে, কারো না কারো আত্মীয়-স্বজন। ভালোভাবে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সিলেট মহানগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে প্রাণ হারানো রায়হান আহমেদের পরিবার কিংবা স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব কেউ না কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে কাজ করেছেন। তাহলে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে রায়হানদের প্রাণ এভাবে দিতে হবে কেন? পুলিশের দায়িত্ব জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করা, বিপন্ন করা নয়।
পুলিশ কাউকে হত্যা করে যদি বলে সে ডাকাত বা জঙ্গি, তবে তাতে তার অপরাধ প্রমাণিত হয় না। অনেকে পুলিশের ছত্রছায়ায় থেকে গুন্ডামি, মাস্তানি, চাঁদাবাজি করেছে। পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করছে না। অথচ বিরোধী মতালম্বী নেতা-কর্মীদের নিপীড়নের জন্য উৎসাহী ভূমিকা পালন করতে একটি শ্রেণি পিছপা হয় না। একটা ঘটনার কথা শুনেছিলাম। একজন পুলিশ সুপার তার অফিসে বসে একজন দর্শনার্থীকে বলেছেন, ‘বলুন তো, অমুক তারিখে অমুক সময়ে একজন লোক, আপনি যে চেয়ারে বসে আছেন, সেই একই চেয়ারে বসে আমার সাথে কথা বলেছিলেন, এমন সময় এখান থেকে ৭০ মাইল দূরে একটি হত্যাকান্ড সংগঠিত হলো। এ হত্যাকান্ডের জন্য কী ওই লোক হত্যাকারী হিসেবে প্রধান আসামি হতে পারে? জবাবে দর্শনাথী না সূচক জবাব দিলেন। কিন্তু পুলিশ সুপার উত্তেজিত হয়ে বলেন, হ্যাঁ প্রধান আসামি হতে পারে, যদি মন্ত্রী বা সরকার দলীয় সংসদ-সদস্য তাকে প্রধান আসামি করার জন্য নির্দেশ দেন। এই ঘটনাটি কারো কারো কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু ঠাÐা মাথায় একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে, পর্দার অন্তরালে এরকম ঘটনা সমাজ ও রাষ্ট্রে হরহামেশাই ঘটছে।
১৯৯৮ সালে পুলিশি হেফাজতে শামীম রেজা রুবেল নিহত হওয়ার পর এ নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। মানবাধিকার সংস্থা বøাস্টের পক্ষে তখন রিমান্ডে নির্যাতনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট দায়ের করা হয়েছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। ২০১৬ সালে ওই রায় আপিল বিভাগও বহাল রাখেন। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী, আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারা অভ্যন্তরে স্বচ্ছ কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, যাতে বাইরে থেকে তারা আইনজীবী দেখতে পারেন যে, আসামির ওপর নির্যাতন হচ্ছে না। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন হলে তা ম্যাজিস্ট্রেটের নজরে এলেই মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের নির্দেশ দেবেন। কিন্তু এসবের কিছুই মানা হচ্ছে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করেই রিমান্ডের নামে চলছে নিষ্ঠুরতা। আমরা মনে করি, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে চললে এবং ফৌজদারি কার্যবিধির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় সংক্রান্ত ১৬৪ ও ৩৬৪ ধারায় সামান্য পরিবর্তন আনতে পারলে মামলার তদন্ত আরো স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের সময় আইনজীবীর উপস্থিতি ও অডিও এবং ভিডিও রেকর্ডিং নিশ্চিত করতে পারলে নির্যাতনের মাত্রা শূন্যের কোঠায় না আসলেও অভিযোগ কমবে। পুলিশি নির্যাতনের সব ঘটনা আমরা জানি না। পত্রিকায় যতটুকু প্রকাশিত হয় কেবল ততটুকুই জানি।
৬ অক্টোবর ২০২০ পত্রিকায় প্রকাশ, ফরিদপুরের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে যুবলীগের এক নেতাকে চোখ বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগে দুই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) সাত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী যুবলীগ নেতা শেখ আরাফাত হোসেন মামলা দায়ের করেছেন।
২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর খুলনার পাইকগাছার জিরবুনিয়া গ্রামে পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে একসঙ্গে ১৩ জন নিহত হয়েছিল। ওই সময়ও পুলিশ দাবি করেছিল, নিহত ব্যক্তিরা সবাই সুন্দরবনের দস্যু; কিন্তু নিহতদের পরিবার দাবি করেছিল, পুলিশ তাদের পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে।
২০০২ সালের ১৮ এপ্রিল একটি পত্রিকায় খবরের শিরোনাম ছিল: দুই পুলিশ কর্মকর্তার বর্বরতা-রিমান্ড না পেয়ে টাকার জন্য স্কুলছাত্রকে থানায় বেদম প্রহার। উত্তরা থানার দুই সাব ইন্সপেক্টরকে ১ লাখ টাকা উৎকোচ না দেয়ায় আকরাম খান নামে গ্রেফতারকৃত এক স্কুলছাত্রকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড নামঞ্জুর সত্তে¡ও তাদের হেফাজতে এনে মারধর করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ২৮ জন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে গ্রেফতারের আগে ও পরে ১২ আসামির মৃত্যু হয়েছে। ২০১৯ সালে হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬ জন। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ২৬০ জন হেফাজতে মারা গেছেন, ২০১৬ সালে এক বছরেই মারা গেছেন ৭৮ জন।
গ্রেপ্তারকৃত আসামিকে থানা হাজতে রাখলে কী নিয়ম পালন করতে হবে সে বিষয়েও আইনে দিকনির্দেশনা রয়েছে। যেমন, আসামিকে থানা হাজতে রাখার পূর্বে তার দেহে কোন জখম থাকলে ২ জন নিরপেক্ষ সাক্ষীকে দেখাতে হবে এবং সাধারণ ডায়রিতে বিষয়টি লিপিবদ্ধ করতে হবে। (পিআরবি ৩২৮ (খ) বিধি, পুলিশ আইনের ৪৪ ধারা। আসামি অসুস্থ হলে বা গায়ে জখম থাকলে থানায় ডাক্তার ডেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে। (পিআরবি ৩২১ বিধি। ডিএমপি অধ্যাদেশ ১৬ ধারা)। আসামিকে থানা হাজতে কোন প্রকার নির্যাতন করা যাবে না। পুলিশ আইনের ২৯(৭) ধারা, দÐবিধির ৩৩১ ধারা। কোন থানায় বা ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত অফিসার উক্ত থানায় বা ফাঁড়িতে আনীত সকল বন্দীর নিরাপত্তা জিম্মার জন্য দায়ী থাকেন। (পিআরবি ৩২৫ ক বিধি)।
যে পুলিশ জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত, তারা কেন নির্যাতন করে মানুষ হত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, সে বিষয়টি রাষ্ট্রের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সরকারের উচিত, থানা হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে একটি স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করা, যাতে নিরপরাধ মানুষ হেফাজতে থাকাকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে না পড়ে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন