মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা ও সামাজিক বিপর্যয়

প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী  : আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজন এখনও ততটা উপলব্ধি হয়নি, কিন্তু অচিরেই যে হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। এখন কথা হচ্ছে, কেন এ বৃদ্ধাশ্রম? কাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম? বলাবাহুল্য, এটি বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য। যদিও ভারতের বারাণসি-বৃন্দাবন প্রভৃতি তীর্থস্থানে বৃদ্ধাদের বিশেষ করে বিধবাদের যে দুঃসহ জীবন-যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়, আমাদের দেশে তা প্রায় নেই বললেই চলে। থাকলেও তা একান্তে লোকচক্ষুর অন্তরালে। প্রকাশ্যে খুব একটা দেখা যায় না।
খুব সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, আমরা যারা বৃদ্ধের পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়েছি বা হতে চলেছি, তারাই কিন্তু আংশিকভাবে এ অবস্থার প্রেক্ষাপটের জন্য দায়ী। কিছুটা দায়ী বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা। বাকিটা পরিবেশ ও পরিস্থিতিজনিত কারণ। যৌথ সমাজ ব্যবস্থা অনেক দিন হলো ভেঙে পড়েছে। বিদায় নিয়েছে মূল্যবোধ। মানবিক সূক্ষ্ম অনুভূতি অনেক আগেই হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে। বিশ্বায়নের ¯্রােত গা ভাসিয়ে আমরা বিশ্বজয়ের অলীক স্বপ্নে বিভোর। এদিকে, নিজেদের ঘর যে স্রোতে ভেসে যেতে চলেছে, নিরাশ্রয় হতে চলেছি আমরা, সেদিকে কারোরই দৃষ্টি নেই। অনেকটা সেই একচক্ষু হরিণের অবস্থা।
যৌথ সমাজ ব্যবস্থার অনেক ভালো দিক ছিল। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে থাকত গোটা পরিবার। ভালো-মন্দ সব কিছুরই দায়দায়িত্ব থাকত পরিবারের কর্তার হাতে। বাকি সব সদস্যই তার নির্দেশানুযায়ীই চলতেন। এর ফলে প্রত্যেকটি পরিবারেই নির্দিষ্ট নিয়মনীতি বা শৃঙ্খলা ভাব বজায় থাকত। থাকত আচার-আচরণ, ব্যবহার বিধি, মান্যমানতার একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সবার আয়ের পরিমাণ সমান না থাকলেও বিচক্ষণ বয়োজ্যেষ্ঠ কর্তার সংসারে তেমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি হতো না। সাংসারিক সুখ-শান্তিও খুব একটা বিঘিœত হতো না। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী সব কিছুই বদলায়। মানুষের মানসিকতাও তার ব্যতিক্রম নয়। সাধারণত একটা পরিবারে শান্তি বজায় থাকে ততক্ষণ পর্যন্তই যতক্ষণ সব সদস্যের মানসিকতা মোটামুটি একই থাকে। শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত হয় তখনই যখন পরিবারে অন্য একটি পরিবারের সদস্য এসে সংযুক্ত হন। দুটো আলাদা পরিবারের মানসিকতা এক না-ও হতে পারে। না হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে ক্ষুদ্রতর স্বার্থকে বলি দিতে হয়। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। দেওয়ার মাঝে একটা অনাবিল আনন্দ, তৃপ্তি থাকে, থাকে একটা স্বর্গীয় অনুভূতি। যে কোনো দিন কাউকে কোনো কিছু দেয়নি, সেই স্বর্গীয় সুখের মর্যাদা সে কী করে বুঝবে? বুঝতে গেলে যে অনুভূতির প্রয়োজন, সেই সূক্ষ্মানুভূতি আজ কোথায়?
একান্তভাবে নিজের পরিবারের সদস্যদের সুখ-সুবিধার দিকে নজর দিতে গিয়ে আমরা শামুকের মতো নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছি। সরে এসেছি যৌথ পরিবারের কলকোলাহল থেকে নীরব-নিভৃত কোণে। ফলস্বরূপ অনিবার্যভাবেই আমরা অনেকটাই স্বার্থপর হয়ে পড়েছি। মনটাও ছোট হয়ে পড়ছে। যৌথ পরিবারে সব সদস্যের ছেলেমেয়েরা একই সঙ্গে পড়াশোনা-খেলাধুলা করে, একই খাবার ভাগাভাগি করে খায়Ñ যার ফলে শঠতা, নিচতা, স্বার্থপরতা এসে বাসা বাঁধতে পারে না, অনুপরিবারে যার একান্তই অভাব। এখানে গড়ে উঠেছে এক রৈখিক মানসিকতা। এ মানসিকতার সৃষ্টি কিন্তু একদিনে হয়নি। বহুদিন ধরে তিলে তিলে হয়েছে এবং এর জন্মদাতা কিন্তু আমরাই। আমাদের সন্তানেরা আমাদের দেখেই শিখেছে, কীভাবে ক্ষুদ্রতর স্বার্থের খাতিরে বৃহত্তর স্বার্থকে বলি দিতে হয়; কিছু না দিয়েই কীভাবে কিছু নিতে হয়। প্রেয় ও শ্রেয়বোধের দ্বন্দ্ব এখানে সম্পূর্ণভাবেই অনুপস্থিত।
ছেলেবেলায় আমাদের চাহিদা ছিল যৎকিঞ্চিৎ। যা পেতাম তাতেই সন্তুষ্টি ছিল। অন্তত সন্তুষ্ট থাকতে চেষ্টা করতাম। বড়দের যেমন ভয় করতাম শত হস্তের তফাতে থাকারই চেষ্টা করতাম। কিন্তু তাই বলে শ্রদ্ধা-ভক্তির কোনো অভাব ছিল না। হয়তো আমাদের অবচেতন মনে বড়দের কাছ থেকে বিশেষ করে বাবা, মা, দাদা, দাদি বা গুরুজনদের ¯েœহ-মায়া-মমতা বা আদর-যতেœর অভাববোধ থেকেই জন্ম নিয়েছিল নিজেদের ছেলেমেয়েদের প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ-আদর এবং পক্ষান্তরে প্রশ্রয়ের মানসিকতার। এর ফল হয়েছে কিন্তু বিষময়। শিব গড়তে গিয়ে নিজেদের অজান্তে আমরা বাদর গড়ে ফেলেছি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত দিলে, বলা ভালো, পাত্রের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত দিলে উপছে পড়বেই। আমাদের ছেলেমেয়েদের বেলাতেও হয়েছে ঠিক তাই। চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অথবা তার আগেই চাহিদা পূরণ হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের কাছে প্রাপ্ত জিনিসের মূল্য কমে গেছে এবং অচিরেই মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। তারপর একদিন যে দিচ্ছে অর্থাৎ দাতার গুরুত্বও ক্রমশই কমে গিয়ে গ্রহীতার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। পারস্পরিক সম্পর্ক এবং নৈকট্যের মধ্যে অতি সূক্ষ্মভাবে ধীরে ধীরে একটু একটু করে দূরত্বের এক অদৃশ্য প্রাচীরের সৃষ্টি হয়েছে। ফলস্বরূপ বার্ধক্যজনিত একাকিত্ব-অসহায়তা এখন দেখা দিয়েছে এবং এক সময় নিজের অজান্তে বৃদ্ধাশ্রমের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক করতে থাকে।
পরিবেশ এবং পরিস্থিতির প্রভাব সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক। বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে অনেক কিন্তু যা নিয়ে গেছে তার মূল্য অপরিসীম। বিজ্ঞানের দৌলতে আজ আমরা ঘরে বসে পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছি, যোগাযোগ করতে পারছি, বিনিময় করতে পারছি যে কোনো প্রান্তের সঙ্গে। বলতে গেলে গোটা পৃথিবীটাই আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। টিভির কথাই ধরা যাক। টেলিভিশনের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে যাচ্ছি আমাদের মনোপছন্দ যে কোনো জায়গায়-অনুষ্ঠানে যেখানে মনোরঞ্জনের মনোহারি সাগরে ডুব দিয়ে আমরা বুঁদ হয়ে বসে আছি। টিভি ছিল একসময় তথাকথিত মর্যাদার প্রতীক। আজকের দিনে যদিও সেই কৌলিন্য আর ঠিক ততটুকু বজায় নেই। কিন্তু তবুও চলছে এবং আশা করা যায় আরও বেশ কিছু কাল চলবে। তা চলুক আর নাই চলুক, ক্ষতি যা হবার তা কিন্তু হয়েই গেছে এবং এর রেশ চলতে থাকবে আগামী আরও বহু দশক কিংবা শতাব্দী পর্যন্ত। জানি না, ‘বোকা বাক্স’ কথাটার প্রচলন কে করেছিল বা কবে হয়েছিল, কিন্তু নামকরণটা এক কথায় সার্থক। বোকা বাক্সের সামনে বসে আমরা কিন্তু সত্যি সত্যি বোকাই বনে গেছি। একেবারে জলজ্যান্ত বোকা। টিভির কল্যাণে আমরা কিন্তু ক্রমেই অসামাজিক জীবে পরিণত হচ্ছি। হয়ে যাচ্ছি স্বার্থপরও। দু-একটি উদাহরণ আশা করি এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া একটা সামাজিক রীতির অঙ্গ। আগেকার দিনে চিঠির মাধ্যমে প্রবাসী আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের খবর আদান-প্রদান ছিল একটি উৎকৃষ্ট পন্থা। চিঠির প্রাসঙ্গিকতা বহুমুখী। খোঁজখবর নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখকের হাতের লেখা সুন্দরতর হচ্ছে, ভাষার ওপর দখল আসছে বা বাড়ছে, চিন্তাশক্তি বাড়ছে, মননশক্তির উন্নতি হচ্ছে। চিঠি মনের প্রতিফলন বা দর্পণ। চিঠি একটি দলিল। ভবিষ্যতের অনেক সমস্যার সমাধান মিলে চিঠির মাধ্যমে। অনেক ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় অপরাধও ধরা পড়ে চিঠির মাধ্যমে। সরকারের আয়ের একটা বড় উৎস হলো চিঠি। কিছুটা হলেও বেকার সমস্যার সমাধান হয়। এ রকম আরও বহুবিধ উপকারিতাই আছে চিঠির। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, চিঠির পাঠ আজকাল প্রায় উঠেই গেছে। তার বদলে প্রায় সবাই দূরভাষ দিয়েই চিঠির কাজটা সেরে নিচ্ছেন। এতে কাজটা দ্রুতগতিতে এবং সরাসরি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আনুষঙ্গিক অন্য যে সুফলগুলো রয়েছে তার থেকে প্রকারান্তরে আমরা সবাই বঞ্চিত হচ্ছি।
এবার আসছি টিভির প্রসঙ্গে। প্রচলিত/চিরাচরিত সামাজিক রীতি অনুযায়ী আমি হয়তো প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয় অথবা বন্ধুর বাসায় গেলাম খোঁজখবর নিতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্ধ্যার পর। দরজায় নক করলাম অথবা কলিংবেল টিপলাম। গৃহস্বামী অথবা অন্য কেউ দরজা খুললেন, ভিতরে টিভিতে তখন কোনো সিরিয়াল চলছে- উপস্থিত সবার চোখ সেখানে স্থিরবদ্ধ। হঠাৎ করে আমার আগমনে সবার চোখে-মুখে স্পষ্টতই বিরক্তির ছাপ, কিন্তু কপট হাসি হেসে বলতেই হয়Ñ ‘ওঃ তুমি/আপনি? এসো/আসুন, বসো/বসুন .... এবং তারপরই অধরা কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে একটু পরপরই চোখ চলে যাচ্ছে টিভির পর্দায়। এদিকে, আমার অবস্থা? ধ্যাৎ! কেন যে এলাম। অপ্রস্তুতের একশেষ এবং বোকাও। চলে গেলে বাঁচি। হয়তো উঠলামও যাবার জন্য। গৃহস্বামী বললেনÑ ‘ও যাবে/যাবেন? আচ্ছা, এসো/আসুন। আজকে কিন্তু ঠিক আসা হল না। আর একদিন একটু সময় করে এসো/আসবেন ...’। মনে মনে হয়তো বলছেন, না এলেই বাঁচি। অবশ্য সব কিছুর মতো এ ক্ষেত্রেও প্রচুর ব্যতিক্রমও আছে।
গত শতাব্দীর মোটামুটি আটের দশক পর্যন্ত অবসর বিনোদনের বা বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বই পড়া ছিল একটি উৎকৃষ্ট মানের পন্থা। পড়ার বইয়ের নিচে রেখে গল্পের বই পড়েনি এমন ছেলেমেয়ে খুব কমই ছিল। সিরিয়াস বইয়ের পাশাপাশি গোয়েন্দা কাহিনী খুবই জনপ্রিয় ছিল। বাংলার বরেণ্য কথাসাহিত্যিক প্রায় সবার লেখনী থেকেই প্রচুর গোয়েন্দা কাহিনী তথাকথিত হট কেকের মতো বিক্রি হতো। মোহন সিরিজের জন্মদাতা শশধর দত্ত তার নায়কের বিলাসবহুল প্যালেস বালিগঞ্জের ‘রমাপ্রসাদ’ কোথাও না থাকলেও একমাত্র তার মোহন সিরিজের দৌলতে বিরাট অট্টালিকা বানাতে সমর্থ হয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র প্রমুখ থেকে শুরু করে সঞ্জীব চ্যাটার্জি, বিনয় মুখুজ্জে (যাযাবর), কায়কোবাদ, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, নজরুল ইসলাম সব স্বনামধন্য লেখকের লেখনী নিঃসৃত অমূল্য কোটেশনগুলো মুখে মুখে ফিরত। কিন্তু টিভির দৌলতে বই পড়ার প্রথা আজকাল প্রায় উঠেই গেছে। বিবাহাদি উৎসবে বই উপহার দেওয়া একটি অতি উৎকৃষ্ট সুরুচির পরিচায়ক ছিল আজকাল, যার প্রচলন প্রায় নেই বললেই চলে। এ ক্ষতিটা কিন্তু বড়ই মর্ম-পীড়াদায়ক।
এখন কথা হচ্ছে, বোকা বাক্সের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে চোখের বারোটা বাজিয়ে আমরা কি দেখছি বা উপভোগ করছি? এখনকার প্রায় প্রতিটি টিভি সিরিয়ালে দেখা যায়, প্রথম কয়েকটি এপিসোডে দারুণ উৎসাহ উদ্দীপনাযুক্ত উপস্থাপনা। কিন্তু তারপর? দেখে-শুনে মনে হয় পৃথিবীতে বোধ হয় এমন কোনো রাবার তৈরি হয়নি যা টিভি সিরিয়ালের রাবারকে টেক্কা দিতে পারে। আর বিষয়বস্তু? কিছু না বলাই বোধ করি ভালো। কাহিনী বিন্যাস উপস্থাপনা, পরিচালনা, সাজসজ্জা প্রভৃতি যাদের হাতে ন্যস্ত, সে সুচতুর কলাকুশলীরা আমাদের মতো মহান বোকা দর্শককে বোকা বাক্সের সামনে পেয়ে তাদের ইচ্ছেমতো আমাদের নাচিয়ে বেড়াচ্ছ। বোকার মতো আমরা রি-অ্যাক্ট করে যাচ্ছি। ফায়দা লুটছে কিছু সুচতুর অসাধু ব্যবসায়ী। এসব অপরিশীলিত কুরুচিপূর্ণ ঘটনাবলীর প্রতিফলন ঘটছে আমাদের সমাজের দৈনন্দিন জীবনে মারাত্মকভাবে। প্রতিনিয়ত। হাতেগোনা সিরিয়াল আছে যা পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে বসে নিঃসঙ্কোচে উপভোগ করা যায়। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে এমন সব দৃশ্যের উপস্থাপনা করা হয় যা দেখে দস্তুরমতো অস্বস্তিতে পড়তে হয়। সাজসজ্জার কথা বলতে লজ্জাই হয়। বিশেষ করে মেয়েদের সাজ-পোশাকের দৈন্যতা চোখে পীড়া দেয় মারাত্মকভাবে। মনে একটা কথাই জাগে যে, আমাদের এ দেশে মেয়েদের শালীনতা ঢাকার মতো কাপড়ের কি এতই অভাব? লজ্জা, শালীনতা বলে কিছুই আর রইল না। সাজসজ্জা একটি অতি উৎকৃষ্ট শিল্প। কিন্তু টিভি সিরিয়াল নির্মাতারা কাপড়ের দৈর্ঘ্য ছোট করে শরীর প্রদর্শনকেই বোধ করি মূল লক্ষ্য পরিণত করেছেন।
এবার আসা যাক মোবাইল সংস্কৃতি সম্পর্কে। এ ব্যাপারে কিছু বলার আগে বলে নেওয়া ভালো যে, মোবাইলের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমার কোনো দ্বিমত বা বিরুদ্ধ মত নেই। প্রশ্ন বা সংশয় শুধু এখানেই যারা মোবাইল ব্যবহার করছেন তাদের সবারই এটা ব্যবহার করার সত্যি সত্যি তেমন প্রয়োজন বা যৌক্তিকতা আছে কি? যদিও বহুদিন আগেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মোবাইল জাতীয় যন্ত্রের ব্যবহার প্রসঙ্গে সতর্কবাণী উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য করা হয়েছে-হচ্ছে, সে কুফল অনুভূত হওয়ায় পাশ্চাত্য দেশ যা কিছু বর্জন করছে আমরা তাই গ্রহণ করছি। সে আলোচনায় না গিয়ে আমি শুধুমাত্র অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের যারা এখনো স্কুল-কলেজের গ-ি পেরোয়নি তাদের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে চাইছি। তাদের সবারই কি সত্যিকারের প্রয়োজন আছে ব্যক্তিগত মোবাইল রাখার? সঙ্গত কারণেই এ প্রশ্ন মনে জাগছে। ইদানীং প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, মোবাইল হাতে বিভিন্নভাবে মারাত্মক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে দেখা যায়, দ্বি-চক্র যানের আরোহীর এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে এ যন্ত্রটির কারণে। তার কারণ মনোসংযোগের অভাব। গাড়ি চালাতে গেলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে জিনিসটার তা হলো ওই মনোসংযোগ। কিন্তু মোবাইল হাতে নিয়ে কথা বললে মনোসংযোগ ব্যাহত হতে বাধ্য, যার অবধারিত ফল দুর্ঘটনা। আমরা যারা ছেলেমেয়েদের অভিভাবক, জেনেশুনেই কি আমরা আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় সন্তানদের অন্যায় আবদার মেটাতে গিয়ে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিচ্ছি। দুর্ঘটনা ঘটার পরে কিন্তু আমরা আফসোস করছি কেন এটা করলাম বলে!
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, আরও একটি বাস্তব সমস্যার সৃষ্টিকর্তাও কিন্তু আমরা, অভিভাবকরাই। খোলসা করে বলাই ভালো। একই সঙ্গে চলাফেরা করা ছেলেমেয়েদেরই কিন্তু মোবাইল কেনার বা আনুষঙ্গিক খরচ চালানোর সামর্থ্য নাও থাকতে পারে। যাদের নেই তারা হীনমন্যতার শিকার হয়ে পড়ে। এটা বাস্তব সত্য! এবং এর থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে অনেকেই অন্যায় জেনেও প্রলোভনের ফাঁদে পা দেয়। বন্ধু-বান্ধবের কাছে নিজের সম্মান বজায় রাখতে গিয়ে চরম অসম্মানজনক কাজ করে বসে। মা-বাবার আর্থিক অসঙ্গতির কথা চিন্তা না করে অভিমানবশত আত্মসাতের পথ পর্যন্ত বেছে নিতে বাধ্য হয়।
ওই একই ব্যাপার দ্বি-চক্রযান ব্যবহারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের অন্যায়-আবদার মেটাতে গিয়ে আমরা অভিভাবকরাই কিন্তু তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। যে বয়সের যে ধর্ম। যৌবনে মদমত্ত ছেলেমেয়েরা ভয়ডর বলে কিছু মানতে চায় না। কথায়ই আছে, স্টিয়ারিং যার হাতে থাকে সে নিজেকে ছাড়া বাকি সবাইকে হেয় জ্ঞান করে। আজকাল সরকার এবং ব্যাংকের বদান্যতায় গাড়ি, মোটরসাইকেল সহজলভ্য হয়ে গেছে। দ্বি-চক্রযান আজকাল আর দ্বি-চক্রযান নেই, দুরন্ত দুর্বার গতিতে তিনজন আরোহীসহ ছুটে চলা তৃ-চক্রযানকে পাশ দিতে গিয়ে রাস্তার পাশের স্তূপীকৃত ময়লা-কাদা-আবর্জনার স্তূপে ছিটকে চলে সরে যাওয়া পথচারীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। হতে পারে সে পথচারী আমি-আপনি-আমরাই। এর দায়দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরও কম নয়। ভালো-মন্দ বুঝতে গেলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন। সে ক্ষমতা অর্জন করার অর্থাৎ ম্যাচিওরিটি আসার আগেই কিছু করতে গেলে সে অপরিণাম-দর্শিতার খেসারত দিতেই হয়।
পরিবেশ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী মানুষের মানসিকতাও বদলায়। আজ আমরাও বদলে গেছি। অনেকই বদলে গেছে। বদলে গেছে আমাদের মূল্যবোধ। এক চরম নীতিহীনতার ঘূর্ণাবর্তে ঘুরে মরছি আমরা সবাই। ন্যায়বোধ-মূল্যবোধ কবেই বিদায় নিয়েছে আমাদের জীবন থেকে। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সব জায়গাতে আমরা, আমাদের মা-বাবা, দাদা-দাদি, ভাইবোন, বন্ধু-বান্ধবরাই কাজ করছেন এবং তাদের কাজের বিনিময়ে যথারীতি পারিশ্রমিকও পেয়ে যাচ্ছেন। তবে কেন আজ পয়সা ছাড়া কোথাও কোনো কাজ হয় না? প্রাইভেট টিউটর ছাড়া পরীক্ষায় ছেলেমেয়েরা পাস করতে পারে না! ভালো স্কুল-কলেজে পড়তে গেলে ডোনেশন ছাড়া প্রবেশাধিকার পাওয়া যায় না। এমনিতর হাজারো নেই এর জগতে বিচরণ করছি আমরা। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি, যে মনে-প্রাণে না হলেও এসবই কিন্তু আমরা মেনে নিচ্ছি। মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ না মেনে কোনো উপায় নেই। প্রতিকারের কোনো পথ নেই। কে প্রতিকার করবে? রক্ষকই যেখানে ভক্ষক, প্রতিকারের আশা করাটাই সেখানে বোকাস। বিচারের বাণী এখানে মৌন-নীরবে-নিভৃতে কাঁদে।
প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি কথা না বললে সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ছেলেমেয়ে মানুষ করার ব্যাপারে মায়ের ভূমিকাটাই প্রধান। কারণ জন্মের আগে থেকেই নিজস্ব বোধ-বুদ্ধি না হওয়া অবধি সন্তানের অ্যাটাচমেন্ট থাকে মায়ের সঙ্গেই অধিক। বাবাকে সন্তানেরা পায়ই বা কতক্ষণ? যার ফলে সন্তানের ওপর মায়ের প্রাধান্যই বেশি থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্রয়ও। এ অবস্থায় সন্তানের দোষত্রুটি বাবার শাসন থেকে আড়াল করতে গিয়ে অনেক সময় অনেক মা-ই সন্তানদের একটু প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেন। যদিও স্বীকার করতেই হয় আগেকার তুলনায় আজকালকার মায়েরা ছেলেমেয়ের পড়াশোনা থেকে শুরু করে নাচ-গান বা সঙ্গীত শিক্ষা, অঙ্কন প্রভৃতি সব ব্যাপারেই অনেক বেশি যতœশীল এবং এগুলোতে আধিপত্যও রাখেন। এ আধিপত্য ও প্রশ্রয়ের ফল কিন্তু খুব একটা ভালো হয় না। বাবার প্রতি সন্তানের, বিশেষ করে উঠতি ছেলেদের মনে অতি সূক্ষ্মভাবে একটু একটু করে একটি মানসিক দূরত্বের সৃষ্টি হতে থাকে এবং কালে সেটি বিরাট আকার ধারণ করে। যার অবধারিত ফল পিতার প্রতি পুত্রের মতানৈক্য ও বিরোধ।
পরে এ বিস্তর মানসিক দূরত্বও তৈরি হয় এবং এসব কিছুতে আর্ত সুচতুর রূপে কাজে লাগিয়ে কিছু রাজনৈতিক অভিভাবক সাময়িক মোহগ্রস্ত, পক্ষান্তরে পথভ্রষ্ট, সন্তানের মগজ ধোলাই করতে গিয়ে তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করেন, যে পিতা-মাতাই হচ্ছেন সমাজের সবচেয়ে বড় শ্রেণির শক্র। কাজেই যেনতেন প্রকারে এ শ্রেণির শত্রুদের খতম করাই হবে প্রথম এবং প্রধান কাজ। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এ অবস্থায় সন্তানদের মানুষ করার ব্যাপারে মায়েরা যদি আর একটু যতœশীলা, সাবধানতা অবলম্বন করেন তাহলে আজকের এ জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান কিছুটা হলেও সম্ভব। বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজনও হবে না। কারণ আজকে যারা যুবক কাল তো তারাই বৃদ্ধ হবে। একদিনে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমনটা ভাবাই বোকামি। তবে একটু একটু করে একদিন নিশ্চয়ই হবে এমনটা আশা করা যেতেই পারে। আর এ আশা নিয়েই তো আমরা সবাই বেঁচে আছি। নয় কি?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Susmita Das ৮ আগস্ট, ২০১৮, ১১:০২ এএম says : 0
সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা
Total Reply(0)
মো: শরিফুল ইসলাম ২৪ জুন, ২০২০, ৩:৪৭ পিএম says : 0
এই গল্প টি পড়ে আমার অনেক ভালো লেগেছে,,,,সময়উপযোগী একটি গল্প.........
Total Reply(0)
নবাব মন্ডল ১৯ জুলাই, ২০২০, ১১:২৪ পিএম says : 0
বর্তমানে সামাজিক দূরত্বের ভিত্তিতে অস্পৃশ্যতার আলোচনা
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন