শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

শিশুর জন্য মায়ের দুধের প্রয়োজনীয়তা

প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জহিরুল আলম শাহীন
মায়ের গর্ভধারণের পর দীর্ঘ নয় মাস দশ দিন পাহাড় সমান দুঃখ-কষ্ট নীরবে সহ্য করে অবশেষে সেই দুঃখীনী মায়ের কোলজুড়ে ফুটফুটে একটি শিশুর জন্ম হয়। সেই সোনামনির মুখ দেখেই দুঃখীনী মা তার সব দুঃখ ভুলে যান। সেই ছোট্ট সোনামনিকে ঘিরে শুরু হয় সব আশা আর ভরসার সংসার। ছোট্ট শিশুটিকে সুস্থ সবল শিশু হিসেবে গড়ে তুলতে মা-বাবা-পরিবার সবাইকে অনেক দায়দায়িত্ব পালন করতে হয়। মায়ের অজ্ঞতা-অবহেলা ব্যস্থতার কারণে কলিজার টুকরা সন্তানটি পরিপুষ্টি খাবার ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৫৪তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে শিশুকে জন্মের প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ২০০৩ সালের ৩১ মার্চ শিশু জন্মের পরবর্তী প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ এবং সাত মাস হতে দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি সহায়ক খাদ্য খাওয়ানো সরকারি আদেশ জারি হয়। ২০০৯ সাল হতে বাংলাদেশ বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালন শুরু করে। আর সারা বিশ্বে এ দিবসটি ১৯৯২ সাল হতে পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর ১ আগস্ট হতে ৭ আগস্ট তারিখ পর্যন্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালিত হয়। এমন অতি গুরুত্বপূর্ণ সপ্তাহটি অতি নীরবই পালিত হয়। দেশ ও জাতি গঠনের একটি বলিষ্ঠ শর্ত হলো শিশুদের সুস্থ সবল ও সুন্দর নীরব দেহ গঠনের মাধ্যমে গড়ে তোলা। সুতরাং বলিষ্ঠ শিশু গড়ে তুলতে হলে মায়েদের এ ব্যাপারে সতেচন ও শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর পক্ষে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের মায়েদের হতে শুরু করে গ্রামগঞ্জ, শহর-বন্দরের সর্বত্রই জাগিয়ে তুলতে হবে জনগণকে যে, মায়ের দুধই শিশুর জীবন। শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর হকে বঞ্চিত করা যাবে না। নির্বিঘেœ শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। আর এ জন্য আমাদের সকলকে এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠতে হবে।
বিশ্ব জগতের মালিক রাব্বুল আলামিন মানব শিশুকে মায়ের গর্ভে ২৮০ দিন অতিবাহিত করে এ দুনিয়াতে আগমন করান। সেই সময় টুকুতে আল্লাহ মায়ের নাভীর সাথে একটি নালী সংযোগ করে শিশুকে খাবারের ব্যবস্থা করে দেন। মা যা খান তার সারাংশ থেকে শিশু খাবার গ্রহণ করে। মানব সন্তানটি দুনিয়াতে আসার পর নাভী কাটার পর আর সয়ংক্রীয়ভাবে খাবার নিতে পারে না কিন্তু আল্লাহ মায়ের স্তনে একটি শিশু কতটুকু খাবে কেমন করে খাবে তার পরিমাণ অবস্থা, তাপমাত্রা, ঘনত্ব, সর্বদিক পরিপুষ্ট করে দুধ সংরক্ষণ করে রেখেছেন। মায়ের দুধে কোন প্রকার জীবাণু নেই। কোন প্রকার ক্ষতিকর পদার্থ নেই। মানব শিশুর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্ব-উৎকৃষ্ট ও পানীয় হলো মায়ের দুধ। মায়ের দুধের কোন বিকল্প নেই। কোনো খাবারই মায়ের দুধের সমতুল্য হতে পারে না। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি দেশজুড়ে প্রচার করতে হবে। মায়েদের বুঝাতে হবে। এ দিবসটি পালনের প্রচারণা শহরের চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। গ্রামবাংলার মায়েরা এখনও এ ব্যাপারে অজ্ঞতায় নিমজ্জিত। তারা শিশুর জন্য মায়ের দুধের গুরুত্ব কেমন বুঝে না। তাই শিশুকে পুরো সময় দুধ খাওয়ায় না বা খাওয়াতে চায় না। তাই সমাজে মায়ের এ ধারণা বদলাতে হবে। বেশী বেশী করে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। এ ব্যাপারে জনসাধারণও মায়েদের জাগিয়ে তুলতে হবে। সমাজের একজন মায়ের সন্তানও যেন মায়ের দুধ খাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। সে ব্যাপারে সবাইকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। তার সাথে সাথে সরকারকে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করে তা বাস্তবায়িত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশের ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে গর্ভবতী ও প্রসূতি নারীদের পরামর্শ দান আরো জোরদার করতে হবে। সুষম শিক্ষায় ও সমন্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন দারিদ্র্য দূরীকরণে মহাপরিকল্পনার পাশাপাশি শিশুর জন্য মায়ের দুধ নিশ্চিত করা পরিকল্পানা সরকারকেই নিতে হবে। ঘরে ঘরে কৃত্রিম খাবার বাজারজাত করা কৌটার দুধ ও নানা প্রকার বাহিরের খাবার গ্রহণের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করার সংবাদ পৌঁছাতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বা সংগঠনগুলোকে এ ব্যাপারে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
১৯৬৭ সালে প্রথম গুঁড়ো দুধ তৈরি হয়। তারপর নানা কোম্পানী নানা কৌশলে দুধ বাজারজাত করতে শুরু করে। ১৯৭৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ শিশুদের সঠিকভাবে মায়ের দুধ ও পরিপূরক খাবার সংরক্ষণ, সহায়তা ও উন্নয়নের জন্য জেনভায় ১৫০টি দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সম্মেলন করেন। এতে গুঁড়ো দুধ বিক্রয়ের ওপর আন্তর্জাতিক নিয়মরীতি গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালে মায়ের দুধের বিকল্প, বিপন্ন সংক্রান্ত বিধি গৃহীত হয়। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এর নিয়মরীতি কেউ পুরোপুরি পালন করছে বলে মনে হয় না। বিদেশ হতে বহু শিশু খাদ্য বা কৃত্রিম দুধ আমাদের দেশে আমদানি হচ্ছে। তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কতটুকু বাজারজাত করা হচ্ছে তা বলা বড়ই কঠিন। সুতরাং এসব শিশু খাবারগুলো আমাদের জন্য মঙ্গলজনক নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে কোটার দুধ খেয়ে শিশু যদিও তুষ্ট পুষ্ট বা স্বাস্থ্যবান মনে হলেও এসব তাদের প্রকৃত স্বাস্থ্য নয়। ভবিষ্যৎ এসব শিশুরা অতিসহজেই নানা রোগে আক্রান্ত হয়। মায়ের দুধ মহান আল্লাহ তায়ালার অমূল্য নিয়ামত। তাই আল্লাহ পবিত্র কোরআনে জন্মের পর শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মায়েরা তাদের সন্তান পূর্ণ ২ বছর পর্যন্ত বুকের দুধ পান করাবে।’ সূরা-আল বাকারা, আয়াত নং- ২৩৩। সুতরাং মায়ের বুকের দুধই নবজাতকের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রদত্ত একটি হক এবং জন্মগত অধিকার। আল্লাহর এ নির্দেশকে অমান্য করা যাবে না বা শিশুকে বঞ্চিত করা যাবে না।
শিশুর জন্মের পরপরই আধা ঘণ্টার মধ্যে মায়ের কোলে নিয়ে শিশুকে বুকের প্রথম দুধ যতœ সহকারে দিতে হবে। বুকের প্রথম দুধ হলদে রঙের হয় অনেক মায়েরা তা ফেলে দেন। সাবধান মায়ের বুকের প্রথম দুধ কোনোভাবেই ফেলে দেয়া যাবে না। এ দুধকে বলা হয় শালদুধ বা কলস্ট্রাম। এ দুধে “ইমিউনোগ্লোবিউলিন’’ নামক এক ধরনের রাসায়নিক উপাদান থাকে। যা শিশুকে সকল প্রকার রোগ জীবাণু থেকে বাঁচিয়ে রাখে এবং দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলে। এ দুধ শিশুর জন্য সব রোগের সারা জীবনের জন্য টীকা। বাহিরের বাতাসের সংস্পর্শে আসে না বলে এ দুধ সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত ও নিরাপদ। এ দুধে আমিষ হিসেবে ল্যাক্টএলবিউমিন এবং ল্যাক্টগ্লোবিউমিন থাকে। যা শিশুর মানসিক ও শারীরিক গঠনের জন্য অপরিহার্য। তাছাড়া মায়ের দুধে ল্যাক্টোফেরিন নামক একটি উপাদান থাকে তা কতগুলো মারাত্মক ব্যাকটোরিয়ার বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলে। মায়ের দুধ খেলে শিশুরা অস্বাভাবিক মোটা হয় না। পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, পক্ষাঘাত, নান ধরনের ক্যান্সার, হাড়ের ক্ষয়, নিউমোনিয়া, এলার্জি, ডায়রিয়াসহ নানা রোগ থেকে রক্ষা পায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যেসব মায়েরা শিশুকে পুরো সময় বুকের দুধ খাওয়ান তাদের স্তন ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার, ডিম্বকোষের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। মায়ের দুধে আছে টরিন নামক এক প্রকার এমাইনো এসিড যা শিশুর মস্তিষ্ক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিশুর স্মরণশক্তি বুদ্ধি বৃদ্ধি করে। দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে মা ও শিশুর মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে।
জন্মের সাথে সাথে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ দিলে মায়ের প্রসবজনিত রক্তচাপ বন্ধ হয়। এতে রক্তপাত কম হয়। ফলে মাকে রক্তশূন্যতায় ভুগতে হয় না। মায়ের গর্ভফুল পড়তে সাহায্য করে। জরায়ু তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। আরো সুবিধা হচ্ছে ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে স্বাভাবিকভাবে মায়ের গর্ভধারণের সম্ভাবনা কম থাকে। তাই দুধ খাওয়ানোর সময়কে প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিও বলা হয়। তবে কোনো মা যদি পুরো আড়াই বছর পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে চান তাহলে এ সময় নতুন করে গর্ভধারণ করবেন না। কেননা গর্ভধারণ করলেই মায়ের বুকের দুধ তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। ফরে যে সন্তানটি আপনার কোলে আছে সে দুধ পাবে না। ফলে শিশুটি সুস্থ সবল হয়ে গড়ে উঠবে না। আমাদের দেশে গুঁড়ো দুধসহ অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত ও কৃত্রিম শিশু খাদ্যের প্রচলন দিনদিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ফলে এদেশের শিশুর মৃত্যুর হারসহ শিশুদের নানা সমস্যা রোগ ব্যাধি বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে মায়ের চেয়ে কৃত্রিম দুধের প্রচার-প্রচারণা বেশী। ফলে এর সহজ শিকার হচ্ছে আমাদের অবুঝ শিশুরা। আমদানি নির্ভর গুঁড়ো দুধের বদলে দেশের ডেইরি ফার্মের বিকাশ সব দিক দিয়েই লাভজনক। অন্তত শিশু পুষ্টির কথা চিন্তা করে কৃত্রিম ও ক্ষতির সকল শিশু খাদ্য নিরুৎসাহিত করতে জনগণকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। শিশু মৃত্যু রোধ ও পুষ্টিহীনতা দূরীকরণের জন্য শিশুর জন্য মায়ের দুধ নিশ্চিত হোক পাশাপাশি মায়ের পুষ্টিহীনতা দূও হোক গড়ে উঠুক সুস্থ, সবল ও মেধাবী প্রজন্ম। এ প্রত্যাশাই আমাদের সকলের।
ষ লেখক : সহকারী প্রধান শিক্ষক, ফুলসাইন্দ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, গোলাপগঞ্জ, সিলেট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন