জামালউদ্দিন বারী
গত সাত বছরে গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণের বেশি বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর আগে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে উপস্থিত বক্তাদের প্রায় সবাই ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। গত বছর একই সাথে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় দেশের ভোক্তাদের পাশাপাশি সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিকেও পুনর্বার মূল্যবৃদ্ধিকে অযৌক্তিক আখ্যায়িত করে ভিন্নমত পোষণ করতে দেখা গেছে। তবে সিন্ডিকেটেড দুর্নীতিতে নিমজ্জিত গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিগুলো এতদিন লোকসান দিলেও মূল্য বাড়ানোর পর এরা লাভজনক কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে মূল্য সমন্বয়ের একটি সরকারি নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সঙ্গতি রেখে মূল্য সমন্বয়ের উদাহরণ নেই বললেই চলে। গত কয়েক বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমতে কমতে তিন ভাগের একভাগে নেমে এলেও এ সময়েও বাংলাদেশে বার বার জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। দর পতনের পর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় জনগণের দাবির মুখে সরকার অবশেষে মূল্য কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির ফলে গত কয়েক বছরে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ব্যয়ও কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। এবার জ্বালানি তেলের যৎসামান্য মূল্যহ্রাসের পর পরিবহন সেক্টরে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা ছিল। কিন্তু জ্বালানির মূল্য লিটারপ্রতি কয়েক টাকা কমানোর পর দূরপাল্লার পরিবহনগুলো প্রতি কিলোমিটারে ৩ পয়সা ভাড়া কমানোর একটি কাগুজে সিদ্ধান্ত প্রকাশ করলে এ নিয়ে নাগরিক সমাজে এবং গণমাধ্যমে বেশ ব্যঙ্গ-কৌতুকের অবতারনা হয়।
এক সময় শোনা গিয়েছিল অফুরন্ত গ্যাসের ওপর ভাসছে বাংলাদেশ। শত শত টিসিএফ গ্যাসের অনাহরিত মজুদ বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে ইত্যাদি। সে সময় দেশের কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্রে বিদেশি গ্যাস কোম্পানিগুলোর ভুলে দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস নষ্ট হয়ে যায়। বিদেশি কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অদক্ষতা বা অবহেলার কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনায় হাজার হাজার কোটি টাকার মূল্যবান গ্যাস সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ক্ষতিপূরণ আদায়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ও অনাগ্রহের অভিযোগ রয়েছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে পাওনা আদায়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের আগ্রহ না থাকলেও গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিগুলোর হাজার হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও সিন্ডিকেটেড দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ না থাকলেও একদিকে প্রতি বছর গ্যাসের মূল্য বাড়িয়ে সাধারণ ভোক্তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছে, অন্যদিকে নতুন আবাসিক সংযোগ বন্ধ রেখে দেশের আবাসন খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগকে স্থবির ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। এমনকি গত কয়েক বছরে দেশের অনেক স্থানে শিল্প খাতেও গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখে নিটওয়্যারসহ রফতানিমুখী শিল্প খাতকেও ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। দীর্ঘ প্রত্যাশিত সমুদ্রসীমা বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়ার পর বঙ্গোপসাগরের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাব্য বিপুল খনিজ সম্পদ আহরণের মধ্য দিয়ে আগামী দিনের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যে প্রত্যাশা জেগে উঠেছিল বাস্তব ক্ষেত্রে তার কোনো ইতিবাচক ফলাফল দেখা যায়নি। দেশীয় গ্যাস ও কয়লা ক্ষেত্রগুলোর উন্নয়নের বদলে সরকারের মন্ত্রীদের আমদানিকৃত জ্বালানিনির্ভর (গ্যাস, কয়লা) তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। নতুন নতুন গ্যাসকূপ অনুসন্ধান ও উন্নয়নে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও বাজেট বরাদ্দ না রাখলেও এখন বিদেশি কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক বিনিয়োগে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগে বেশ তোড়জোড় শুরু হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্সকে আরো শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে দেশের জ্বালানি সম্পদকে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো অনেক বেশি সহজ ও লাভজনক। বাংলাদেশে কর্মরত বিশ্বখ্যাত বিদেশি কোম্পানিগুলো একাধিকবার বড় বড় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী হলেও গত ৬০ বছরেও বাপেক্সের এ ধরনের দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়ার কোনো নজির নেই। একেকটি বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে পেট্রোবাংলা যেখানে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস কিনছে গড়ে ২০০ টাকায়, সেখানে বাপেক্সের কাছ থেকে কিনছে এর চারভাগের একভাগেরও কম দামে। এরপরও বাপেক্সের আওতাভুক্ত গ্যাসক্ষেত্রগুলো লাভজনক হিসেবেই পরিচালিত হচ্ছে। নিজস্ব যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তিতে ইতিমধ্যে দেশের গ্যাসকূপগুলোর থ্রি-ডি ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের কাজে বাপেক্স বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। তিরিশ বছরের পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে বাপেক্সের ধারাবাহিক সাফল্য জাতিকে আশার আলো দেখায়। গত বছরও কুমিল্লার ভাঙ্গুরা গ্যাস ক্ষেত্রের লিজপ্রাপ্ত কোম্পানি সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিস এনার্জি নতুন কূপ খননে একটি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করলে রাশিয়া, চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশের বিভিন্ন কোম্পানির সাথে প্রথমবারের মতো প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অংশগ্রহণ করে অন্তত দুটি কূপের খনন ও উন্নয়ন কাজ পায় বাপেক্স। নিজস্ব জনবলের পাশাপাশি উন্নত প্রযুক্তি, সর্বাধুনিক সরঞ্জাম এবং আরো প্রশিক্ষিত জনবল করে বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের উন্নয়নে বাপেক্সকে যে কোনো বিদেশি কোম্পানির চেয়ে সময়োপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব।
মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষ বছর ২০১৩ সালে দেশের গ্যাস সংকট উত্তরণের বহুবিধ উদ্যোগ ও সম্ভাবনার কথা শোনা গিয়েছিল। সে সময় অন্তত ১১টি নতুন কূপ এবং চারটি পুরনো কূপের উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হওয়ার খবর ছাপা হয়েছিল। সে সময় প্রতিদিন গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ অর্ধশত কোটি ঘনফুট বেড়ে ২৬৫ ছাড়িয়েছিল। এরপরও গ্যাসের সংকট বেড়ে যাওয়ায় একটি দৈনিক পত্রিকা (ইত্তেফাক : ১৫-৮-১৩) ‘এত গ্যাস গেল কোথায়?’ শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সে সময় ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি ছাড়াও টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ডের দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ আদায়ে দেশীয় আদালতের রায় বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতাও দূর হয়েছিল একটি আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে। টেংরাটিলা গ্যাস বিস্ফোরণে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর দায় প্রমাণিত হওয়ার পর দেশীয় একটি আদালত ৭৪৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দিয়েছিল। সেই রায়ের বিরুদ্ধে নাইকো ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সংক্রান্ত সালিশি আদালতে আপিল করলে সে আদালত তা খারিজ করে দেয় এবং নাইকোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশর জয় নিশ্চিত হয়। তবে নাইকোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা ও সদিচ্ছা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। নাইকোর মামলাটি শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আদালতে নিষ্পত্তি হলেও মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ডে বিস্ফোরণে ২০০ বিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া ২৮টি চা বাগান, লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্টসহ শত শত একর বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যায়। সে সময় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের কাছে ৬০৯ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করলেও সম্পদ ও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। ১৯৯৭ সালের জুন মাসে সংঘটিত সেই দুর্ঘটনার পর প্রায় দুই দশক অতিক্রান্ত হতে চললেও দুর্ঘটনার সেই ক্ষতিপূরণ এখনো আদায় করতে পারেনি সরকার। এসব পুরনো ও অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে যেন সরকারের সংশ্লিষ্টদের কোনো মাথাব্যথা নেই। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট ডিগ্রিধারী জ্বালানি উপদেষ্টারা জ্বালানি সেক্টরে নিয়োগ দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ থাকলেও তার প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। নতুন নতুন গ্যাসকূপ উন্নয়ন, শত শত মিলিয়ন ঘনফুট নতুন গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হওয়ার পর দেশে গ্যাসের সংকট আরো তীব্রতর হওয়া, অতঃপর সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবসায় সম্প্রসারণ, গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা এবং এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের বাণিজ্যিক তোড়জোড় শুরু হওয়ার পেছনের খেলা সম্পর্কে ভোক্তা জনসাধারণ শুধু কানাঘুষা করেই মনের ক্ষোভ মিটায়। বছরের পর বছর ধরে আবাসিক খাতের গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেও সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবসায় প্রত্যাশিত সাফল্য না আসায় সরকার এবার ইতোমধ্যে দ্বিগুণ বর্ধিত গ্যাসের মূল্য আবারো শতভাগ বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এবারও আগের মতোই লোক দেখানো গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছিল। গত ৭ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া গণশুনানিতে ভোক্তাসাধারণ, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়ে পুনরায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নানাবিধ দুর্নীতি, অপচয়, অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই শুধুমাত্র মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যেই গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিগুলো লাভজনক কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। এরপরও মাত্র এক বছরের মাথায় পুনরায় শতভাগ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের কোনো যৌক্তিকতা নেই। তবে যে যত কথাই বলুন, যত যুক্তিই দেখান, সরকার গ্যাসের মূল্য বাড়াতে বদ্ধ পরিকর। সর্বশেষ সরকারের প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এমনটাই আঁচ করা যায়।
গ্যাসের দাম যখন কমানো উচিত সরকার তখন আরেক দফা বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। সরকারের এহেন তৎপরতা বন্ধ না হলে বাম রাজনৈতিক দলগুলো হরতালসহ নানা কর্মসূচির ডাক দেবে বলে জানিয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সরকার গরিব ও নি¤œবিত্ত মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, এমন দাবি করে দলটি গ্যাসের মূল্য কমানোর পক্ষে গণশুনানির দাবি জানিয়েছেন। এটি শুধু কমিউনিস্ট পার্টির দাবি নয়, সারা দেশের প্রায় সব মানুষের দাবি। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ইতোমধ্যেই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আন্দোলন বা চিৎকার করে কোনো লাভ হবে না। তিনি এখানেই থেমে থাকেননি, বাসাবাড়িতে গ্যাসের চুলায় ডালভাত রান্নাকে তিনি গ্যাসের অপচয় বলে মন্তব্য করেছেন। তার ভাষায় ‘গ্যাসটা এত মূল্যবান সম্পদ যে, এটা দিয়ে ভাত তরকারি রান্নার কোনো মানে হয় না’। গ্যাস যে একটা মূল্যবান সম্পদ তাতে কোনো সন্দেহ নেই, গ্যাসের অপচয় রোধ করার ব্যাপারেও কারো দ্বিমত নেই। তবে দেশের গ্যাস জনগণেরই সম্পদ। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগই সরবরাহ করা হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানাসহ বড় বড় শিল্প-কারখানায়। এর অর্থ হচ্ছে, সারাদেশে আবাসিক খাতে গ্যাস সরবরাহের হার শতকরা ১০-১২ ভাগের বেশি নয়। দেশে পর্যাপ্ত গ্যাসের মজুদ আছে এই বিবেচনা থেকেই সারাদেশে আবাসিক খাতে পাইপলাইনে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছিল। গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে তা অব্যাহত আছে। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলন শুরু হলে এক সময় হয়তো জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। সেই সাথে দেশীয় কয়লা, প্রস্তাবিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির নানা রকম বিকল্প উদ্যোগেরও সম্ভাবনা রয়েছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের স্বার্থে শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করা যেমন গুরুত্ববহ, তেমনি গ্যাসের চুলায় শ্রমজীবী মানুষকে দিনান্তে ডালভাত রান্না করে খাওয়ার সুযোগ অবারিত রাখার বিষয়টিকে তুচ্ছ করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। সরকারের মন্ত্রী, কমিশন বাণিজ্য ও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাওয়া আমলা, রাজনৈতিক নেতা অথবা সমাজের বিত্তবান এলিট শ্রেণির কাছে ঘরে রান্না করা ডাল-ভাত খাওয়ার বিকল্প থাকতে পারে। শহরের সাধারণ মানুষের কাছে ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানির গ্যাসের বিকল্প হতে পারে অনেক বিড়ম্বনার এলপিজি, কাঠের লাকড়ি, কয়লা অথবা কেরোসিন স্টোভ। বিদেশ থেকে সিলিন্ডার আমদানি করে, তাতে আমদানিকৃত এলএনজি ভরে গৃহস্থালিতে ব্যবহার অথবা বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে দেশীয় উৎপাদন থেকে একটি অংশ সরাসরি পাইপলাইনে সরবরাহের ব্যবস্থার মধ্যে কোনটা বেশি মূল্য সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব? তবে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের কারণে অপচয় বৃদ্ধির যে অভিযোগ আছে তা অমূলক নয়। ম্যাচের কাঠি বাঁচাতে অথবা ভেজা কাপড় শুকাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখার বদভ্যাস আমাদের অনেকেরই আছে। সেই সাথে গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেটেড দুর্নীতি, হাজার হাজার অবৈধ সংযোগের কারণে কথিত অপচয় অনেক বেশি। এসব দুর্নীতি অপচয়, অবৈধ সংযোগ বন্ধ করার পাশাপাশি প্রয়োজনে আবাসন খাতের গ্যাস সংযোগেও মিটার স্থাপন করা যেতে পারে। অপচয় দুর্নীতি বন্ধের উদ্যোগ না নিয়ে রান্নায় দেশীয় গ্যাস ব্যবহারকে অপচয় মনে করলেও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আমদানি করা গ্যাস ব্যবহারকে যথার্থ মনে করছেন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা।
আবাসিক পাইপ লাইনে ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানির গ্যাসের বদলে এলএনজি সিলিন্ডারের ব্যবহার বাড়াতে চায় সরকার। এখানে নানাবিধ বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে। প্রথমত, আমদানিকৃত গ্যাসকে লিকুইডিফাইড করতে ইতোমধ্যেই বিদেশি কোম্পানির সাথে হাজার হাজার কোটি টাকার এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের চুক্তি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সিলিন্ডার আমদানি ও বিক্রির সুযোগ নিয়ে সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী একটি ব্যবসায়ী শ্রেণি এরই মধ্যে মনোপলি বাণিজ্য শুরু করেছেন, সাম্প্রতিক বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী নিজেও তা বলেছেন। এরপরও তিনি সাধারণ জনগণকে দেশীয় গ্যাস সম্পদের সামান্য ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করে সবার হাতে আমদানিকৃত এলপিজি ধরিয়ে দিতে চান। এটা করতে গ্যাসের বর্তমান মূল্যকে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। গ্যাসের মূল্য না বাড়িয়ে এলপিজি সিলিন্ডারের মূল্য কমিয়ে সরবরাহ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করলে হয়তো আরো বেশি সংখ্যক সাধারণ মানুষ নতুন গ্যাস সংযোগের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা না করে এলপিজি গ্যাস ব্যবহারে অভ্যস্ত হতো।
কয়েক বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সাম্প্রতিক হুমকিতে আমাদের অর্থনীতিসহ সামগ্রিক জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। রফতানিমুখী শিল্প খাতে এক অজানা আশঙ্কা বিরাজ করছে। কর্মসংস্থান স্তিমিত হওয়ার সাথে সাথে মূল্যস্ফীতি বা জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে চলেছে। এভাবেই দেশে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বেড়ে যায়। আবাসিক গ্রাহকদের জন্য গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণ বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় তা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। আমাদের প্রবীণ, অভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রীর কাছে সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্কের ৪ হাজার কোটি টাকা তেমন কিছুই না। বড় বড় অর্থ কেলেঙ্কারি, ব্যাংক জালিয়াতি, শেয়ারবাজার লুটপাট, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত অথবা নিরাপত্তাহীনতার কারণে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার বিষয়ে তিনি তেমন কিছু করতে না পারলেও ডাল-ভাত রান্নায় গ্যাসের অপচয় রোধে জনগণের কোনো কথাই শুনতে নারাজ। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘পেনি ওয়াইজ পাউন্ড ফুলিশ’ অর্থাৎ বড় বড় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে মাতামাতি। এ ক্ষেত্রে সেই বাগধারাটিও স্মরণ করা যেতে পারে, যাকে বলা হয় ‘তুঘলকি কা-’। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে দিল্লির তুঘলক সুলতানদের মধ্যে মুহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র এবং অনেকগুলো ভাষার প-িত। তবে তার অদ্ভুত আচরণে তার পিতা সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলক প্রতিষ্ঠিত দিল্লি সালতানাতকে অনেকটা দুর্বল ও খ-িত করেছিল। তিনি যুগের অগ্রবর্তী অনেক অবাস্তব সিদ্ধান্ত দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিতেন, যা মানুষ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি বলেই তা সুফল দেয়নি। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি, লুটপাট, শিল্প খাতে প্রতি মাসে শত শত কোটি ঘনফুট গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে সরকার ডালভাত রান্নায় গ্যাসের ব্যবহারকে অপচয় বলে গণ্য করছে। পক্ষান্তরে বিদেশ থেকে আমদানি করা এলপিজি গ্যাস ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে এবং গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর জেদ প্রদর্শন দেশের মানুষ একে তুঘলকি কা- বলেই বিবেচনা করছে। সার্বিক বিবেচনায় সরকার এ মুহূর্তে এ ধরনের সিদ্ধান্ত পরিহার করবে, এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন