রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

সৈয়দপুরের তৈরি পাটপণ্য যাচ্ছে বিদেশের বাজারে

প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নজির হোসেন নজু, সৈয়দপুর (নীলফামারী) থেকে

এখানকার সবাই নারী। হোক তিনি উদ্যোক্তা কিংবা শ্রমিক। সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তৈরি করছে রকমারি চটের ব্যাগ আর কার্ড। এতে যেমন লাভবান হচ্ছেন তারা, সংসারে আনছেন সচ্ছলতা তেমনি দেশের রপ্তানি আয় বাড়াচ্ছে তাদের কর্মঠ হাতগুলো। শপিং ব্যাগ, টিফিন ক্যারিয়ার ব্যাগ, স্কুলব্যাগ, ডলব্যাগ, ট্রাভেলব্যাগ, মহিলাদের পার্টসসহ পাটজাতদ্রব্য বিদেশে রফতানি করছে প্রতিষ্ঠানের নারী উদ্যোক্তা ও শ্রমিকরা। এতে করে বছরে প্রায় ২ কোটি টাকা আয় করছে। তৈরি এসব পণ্য মানে ও গুণে বিদেশিদের কাছে চাহিদা থাকায় বাড়ছে চটের ব্যাগের ও হাতে তৈরি কার্ডের চাহিদা। নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের গোলাহাট চিনি মসজিদ সংলগ্ন ‘সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজ’ নামে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন সমাজের অবহেলিত, পিছিয়েপড়া নারীরা। এই প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। এর আগে নারীরা এমসিসির অধীনে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে চটের ব্যাগ ও কার্ড তৈরির কাজ শুরু করেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯১ সাল ওই প্রতিষ্ঠানের শুধু শ্রমিক হিসাবে কাজ করে মজুরি পেতেন নারীরা। প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে নারীরা বেকার হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে তারা সকলেই মিলে সঞ্চয়ের টাকায় গড়ে তোলেন ‘সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি সংস্থা। ১৬ শতক জমির ৬ তলার ভিত্তি দিয়ে ৪ তলার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়। সেখানে প্রায় ১১০ জন নারী উদ্যোক্তা শ্রমিক ও ১৫ জন কর্মকর্তা নিরলসভাবে তৈরি করছেন চটের রকমারি ব্যাগ ও হাতে বানানো কার্ড। এসব পণ্য আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করে কোটি কোটি টাকা আয় করছে। এখানে কাজ করে অবহেলিত ও সমাজে পিছিয়েপড়া নারীরা এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তাদের সকলের পরনির্ভরশীলতা কমে এসেছে। সংসারে অভাব-অনটন দূর করে সচ্ছলতা এনেছেন। এখানে কর্মরত নাজমা বেগম (৪২)। স্বামী শফি আলম নাপিতের কাজ করে সংসার চালাতেন। থাকেন গোলাহাটের অবাঙালি ক্যাম্পে। তিনি জানান, আগে সংসারে অভাব-অনটন লেগেই ছিল। কিন্ত এখানে কাজ করার পর থেকে প্রতি মাসে সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পেয়ে সংসার ভালোই চলছে। এই টাকায় বসতভিটায় পাকা বাড়ি তৈরি করেছেন আর মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। সেইসাথে বড় মেয়েকে পাত্রস্থ করেছেন বলে জানান তিনি। শহরের নতুনবাপাড়ার সাদ্দাম মোড়ের বিলকিছ বানু (৪০) কাজ করেন এই ব্যাগ তৈরির কারখানায়। তার স্বামী আবু তালেব মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। প্রায় ১৮ বছর ধরে কাজ করছেন ২ ছেলে ও ১ মেয়ের জননী বিলকিছ। তিনি জানান, তার সংসারে অভাব বলে বর্তমানে কিছু নেই। এখানে কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে এবং আয়ের টাকায় বসতভিটাও কিনেছেন তিনি। এখানকার নারীদের সফলতার গল্প প্রায় একই রকম। পাটপণ্য প্রদর্শনী’২০১৬ অংশ নিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা হিসাবে ‘সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজ’ জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) ও নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সম্মাননা স্মারক লাভ করেছে। এখানে দিন হাজিরা ও কাজের উপর নির্ভর করে পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়। ফলে একজন নারী কাজ করে কম করে হলেও চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। আর বছর শেষে লাভের অংশ সকল নারীদের মাঝে বিতরণ করা হয়। নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা থেকে উৎকৃষ্ট মানের পাট ও চট সংগ্রহ করা হয়। তারপর মেশিনে কাটিংয়ের পর সেলাই করে তৈরি করা হয় উন্নতমানের এসব চটের ব্যাগ। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী স্ক্রিন প্রিন্ট ও অন্যান্য কাজ করা হয়। ফলে এসব ব্যাগ খুবই টেকসই ও মজবুত হয়। এখানে পুরনো কাপড় থেকেও নারীরা ব্যাগ তৈরি করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ফলে প্রতিনিয়ত বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা বেড়েই চলেছে। ‘সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজ’র প্রতিষ্ঠার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন গিয়াসউদ্দিন (৫৫)। তিনি সকলের কাছে সৎ, কর্মঠ ও পরিশ্রমী মানুষ হিসেবে পরিচিত। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। কথা হয় তাঁর সাথে। তিনি বলেন, অনলাইন ও বিভিন্ন মাধ্যমে পণ্যের ডিজাইন দেখিয়ে অর্ডার গ্রহণ করা হয়। আমাদের সব ক্রেতাই যেহেতু বিদেশি সে কারণে তাদের ইচ্ছানুযায়ী চটের ব্যাগ ও কার্ড তৈরি করে সরবরাহ করে থাকি। এখানে যারা কাজ করেন সকল নারীই উদ্যোক্তা ও শ্রমিক। ফলে কেউ কাজে ফাঁকি দেন না। তিনি বলেন, পারিশ্রমিক ও লাভের অংশ ভাগ-বাটোয়ার পর প্রতি বছর ৫/৬শ’ প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মাঝে স্কুলের ইউনিফর্ম বিতরণ করা হয়। গরিব ও মেধাবী এসব শিক্ষার্থীর মাঝে এসব ইউনিফর্ম বিতরণ করতে পেরে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে করেন তিনি। ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানটিতে ট্রেনিং সেন্টার খোলার ইচ্ছে পোষণ করে বলেন, এতে করে গরিব, অভাবি নারীরা কাজ করার আগ্রহ ও মানসিকতা সৃষ্টি হবে এবং নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন