বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বাস পোড়ানোর ঘটনা নিয়ে ব্লেম গেমের রাজনীতি বন্ধ করা উচিত

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ১৮ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

করোনার আঘাতে দেশের অর্থনীতি এক বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র মানুষ আরো দরিদ্র হচ্ছে। নি¤œ ও মধ্যবিত্তদের অনেকে দরিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে। কোটি কোটি বেকারের সাথে নতুন করে আরো কোটি মানুষ যুক্ত হয়েছে। মানুষের আয় কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছে। অনেকের বেতন কমেছে। সরকার লাখ কোটি টাকার উপরে প্রণোদনামূলক প্যাকেজ ঘোষণা করেও অর্থনীতিকে টেনে তুলতে পারছে না। সরকার ও বিদেশী সংস্থাগুলো দেশের অর্থনীতির সূচকের যতই প্রশংসা করুক না কেন, বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। অভাব-অনটনে পড়ে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। কোনো রকমে খেয়েপরে জীবনযাপন করাও এখন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে করোনার প্রকোপও কমছে না। এক ধরনের ভয় ও আতঙ্ক নিয়েই মানুষকে চলতে হচ্ছে। এই ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার আশঙ্কা। দুঃসময়ের যাঁতাকলে পড়ে মানুষ যখন চিড়েচ্যাপ্টা, তখন করোনার ভয়াবহতার মধ্যেও একের পর এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটে চলেছে। করোনার মতোই দেশজুড়ে ধর্ষণ মহামারি আকার ধারণ করেছে। উঠতি বয়সের কিশোরদের গ্যাং দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে। দেশে রাজনীতি বলতে কিছু নেই। রাজনীতি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের পারস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্যে। তাদের এ বক্তব্য যে দেশে রাজনীতি আছে এটা বোঝানার জন্য, সাধারণ মানুষ তা বোঝে। দুই দলের এই বক্তব্য-বিবৃতিটুকু না থাকলে বোঝার কোনো উপায় থাকত না যে দেশে রাজনীতি আছে। বলা যায়, বিগত প্রায় দুই বছর ধরে রাজনীতি নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিরোধী দল বিভিন্ন ইস্যুতে দুয়েকটি মানববন্ধন, মিছিল-মিটিং করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। এছাড়া দেশে বিরোধী দলের এবং সরকারি দলের রাজনীতি বলতে কিছু নেই। রাজনৈতিক অঙ্গণ পুরোপুরি শীতল। যদিও সরকারি দল এই শীতল অবস্থাকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করছে, তবে এর ভেতরে যে অসন্তোষ রয়েছে, তা সচেতন মানুষমাত্রই বোঝেন।

দেশের রাজনৈতিক এই শীতল বা স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই যেন বিস্ফোরণ ঘটল। ঢাকা-১৮ আসনের নির্বাচনের দিন দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত রাজধানীর ৯টি স্থানে ৯টি বাসে আগুন জ্বলে উঠে। কে বা কারা এই আগুন লাগিয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে তা বোঝা না গেলেও সরকারের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, তা যে বিরোধী দল তথা বিএনপি এ কাজ করেছে, তা বলতে কালবিলম্ব করেনি। আমাদের দেশের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, দেশে কোনো অঘটন ঘটলে তার দায় বিরোধী দলের উপরই চাপানো হয়। বিরোধী দল হয়ে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার গৃহপরিচারক ‘কেষ্টা বেটা’র মতো। যা কিছুই ঘটুক তার সব দায় গিয়ে চাপে তার উপর। বিগত দশ বছর ধরে বিএনপি যেন সরকারের কাছে সেই ‘কেষ্টা বেটা’ই হয়ে আছে। বাস পোড়ানোর ঘটনার পরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করতে কালক্ষেপণ করেনি। স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতাকারী ইশরাক হোসেনসহ বিভিন্ন থানায় ১৫টি মামলায় পাঁচশ’ নেতা-কর্মীকে আসামী করা হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এমন অনেককে আসামী করা হয়েছে যাদের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসাধীন, কেউ সেদিন ঢাকায় ছিলেন না। ইশরাক আগে থেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে রয়েছেন। এছাড়া দলটির অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের যেসব নেতা বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের কেউ কেউ সেদিন ঢাকায় ছিলেন না। আবার পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছে, বাসগুলোর হেলপার-কন্ডাক্টরদেরও তারা সন্দেহের বাইরে রাখছেন না। তারা এ কথাও বলেছেন, সিসিটিভির ফুটেজ দেখে কাউকে কাউকে শনাক্ত করা হয়েছে। ফলে প্রকৃত অর্থে কারা বাসে আগুন দিয়েছে তা এখনও ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে সব দোষ বিএনপির নেতা-কর্মীদের উপরই চাপানো হয়েছে। এ নিয়ে শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ‘বেøম গেম’। বিএনপির নেতৃবৃন্দ বলছেন, এ কাজ করেছে সরকারি এজেন্টরা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বলছেন, এ কাজ বিএনপিই করেছে। এতে রাজনীতির সেই পুরনো ‘বেøম গেইম’ নতুন করে শুরু হয়েছে।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট কোনো অঘটন ঘটলে তা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার পরস্পরবিরোধী দোষারোপের রাজনীতি নতুন কিছু নয়। ঘটনাকে কেন্দ্র করে একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য পরস্পরের উপর দোষ চাপানো হয়। দেশের মানুষ এসব দেখে অভ্যস্ত। তারা এটাও জানে, রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে কিংবা হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি ঘোষণা করা হলে কোনো না কোনো অঘটন ঘটবেই। যানবাহন পোড়ানোসহ ককটেল বিস্ফোরণ, আন্দোলনকারি দল ও সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলবে। পুলিশি অ্যাকশন থাকবে। বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মী গ্রেফতার হবে। এ নিয়ে তাদের এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি থাকে। তবে সাধারণ মানুষ যখন করোনায় বিধ্বস্ত হয়ে অত্যন্ত সংকুচিত, কীভাবে জীবন চলবে এ নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে এবং মহাদুঃশ্চিন্তা নিয়ে জীবনযাপন করছে, তখন আকস্মিকভাবে বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা নিয়ে রাজনীতি উত্তপ্ত হওয়ার ঘটনা কল্পনাও করতে পারেনি। তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। কারণ তারা জানে, এখন রাজনীতি বলতে কিছু নেই, রাজনৈতিক অঙ্গণও স্থিতিশীল এবং রাজনীতি নিয়ে মাথাঘামানোরও সময় নেই। এ অবস্থায় নাশকতামূলক ঘটনা ঘটিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিতে তারা হতভম্ব হয়েছে। তাদের চরম দুঃসময়ে এমন ঘটনা তাদের আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে। তাদের দুঃশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বৃহত্তম দল বিএনপির পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি। বিশ্বাসযোগ্য ও নিরপেক্ষ তদন্তে ঘটনার প্রকৃত দোষীদের শনাক্তের আগেই ঘটনার দায় এক দল আরেক দলের ওপর চাপিয়ে রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। তাদের এই দোষারোপের রাজনীতি যদি চলতে থাকে তবে করোনার মধ্যে যদি রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এর শিকার হবে দেশের সাধারণ মানুষ। করোনার আঘাতে এমনিতেই দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। এর উপর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুরু হলে তাদের দুর্দশার অন্ত থাকবে না। দেশের অর্থনীতি তো ডুববেই, মানুষও ধুকে ধুকে মরবে।

দেশের অর্থনীতি মজবুত আছে কিংবা অর্থনীতির সূচক ঊর্ধ্বগামী বলে সরকার যতই বলুক না কেন বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের মানুষ ভাল নেই। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। অর্থাভাবে তাদের জীবন চলা দায় হয়ে পড়েছে। দরিদ্ররা দরিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে। কোটি কোটি নতুন দরিদ্র সৃষ্টি হয়েছে। তারা বাঁচামরার মতো লড়াইয়ে রয়েছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি যখন বেকার হয়ে যায়, তখন সেই পরিবারের কী অবস্থা হয়, তা কেবল তারাই জানে। এমন পরিবারের সংখ্যা এখন কোটিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ যখন এমন অসহনীয় জীবন সংগ্রামে, তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়া তাদের জন্য ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠেছে। তাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতির নতুন সূচনা তাদের শঙ্কিত করে তুলেছে। সাধারণ মানুষের দুঃসময়ে এ ধরনের রাজনীতি কোনোভাবেই কাম্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। দোষারোপের এই রাজনীতি তাদের বন্ধ করতে হবে। দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে থাকা সাধারণ মানুষকে বেঁচে থাকার জায়গা করে দিতে হবে। রাজনৈতিক দল দুটিকে বুঝতে হবে, তাদের এই দোষারোপের রাজনীতির কারণে প্রকৃত সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে তাদের পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ হবে। এতে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন মানুষ অন্যায্য আচরণের শিকার হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিৎ দোষারোপের রাজনীতি না করে ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত নিয়ে কথা বলা। যতক্ষণ না সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী শনাক্ত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ নিয়ে ‘বেøম গেম’ না করা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন