পেঁয়াজ কাটার সময় পণ্যটির রস মানুষের চোখে ফেলে। কিন্তু বর্তমানে দামের কারণে পণ্যটি সাধারণ মানুষকে কাঁদাচ্ছে। রসুঁই ঘরের গুরুত্বপূর্ণ এই পণ্যটি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পুর্ণ হতে চায় বাংলাদেশ। এজন্য সময় লাগবে চার বছর। পণ্যটি উদপাদনের মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমেই পেঁয়াজের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় কম। এ কারণে আমদানির মাধ্যমে চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ করা হয়। আর পেঁয়াজ আমদানি মূলত ভারত নির্ভর। ভারত রফতানি বন্ধ করে দিলে অস্থির হয়ে ওঠে বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার। এই প্রেক্ষিতে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক গত ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কেন্দ্রীয় গবেষণা পর্যালোচনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
বিদেশ থেকে যে পরিমান পেঁয়াজ প্রতিবছর আমদানী করা হয় তার বেশির ভাগ আসে ভারত থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনআরবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৯৫ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শতভাগ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শতভাগ পেঁয়াজ এসেছে ভারত থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোডম্যাপ অনুযায়ী উৎপাদন বাড়ানো হলে ভারতের ওপর নির্ভর করতে হবে না।
পেঁয়াজ উৎপাদনের রোডম্যাপ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) ২৫ লাখ ৯৬ হাজার টন নিট চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২৫ শতাংশ ক্ষতিসহ পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৪ লাখ ৬১ হাজার টন। উৎপাদনশীলতা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদন বাড়বে ৬ লাখ ২৫ হাজার টন। ২ লাখ ৭০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির মাধ্যমে চাহিদা প‚রণ করা হবে।
এরপর পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য একটি রোডম্যাপের খসড়া প্রণয়ন করে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতর। প্রথম খসড়াটি তিন বছর মেয়াদি। এটি উপস্থাপন করা হলে কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে ডিএইকে পরিমার্জনের নির্দেশনা দেয়। সে অনুযায়ী ডিএই চার বছরের রোডম্যাপ প্রণয়ন করে। গত ২৩ নভেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয়ে এক সভায় রোডম্যাপটি উপস্থাপন করা হয়।
জানতে চাইলে কৃষি সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম বলেন, পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে একটি পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এটি এখনও আমরা চূড়ান্ত করতে পারিনি। এ নিয়ে কাজ করছি। আমরা চার বছরের মধ্যে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্প‚র্ণ হতে চাচ্ছি। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আসাদুল্লাহ বলেন, আগামী চার বছরের মধ্যে আমরা পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবো ইনশাআল্লাহ। আমরা পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াব। রোডম্যাপের অংশ হিসেবে পেঁয়াজে স্বংয়ংসম্পূর্ণতা আনতে বিভিন্ন কৌশল নেয়া হবে। আমরা চাষিদের পেঁয়াজ সংরক্ষণের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেব। হাইটেক পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু হবে। রোডম্যাপ অনুযায়ী এবার পেঁয়াজের ফলন ২ লাখ টন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হবে জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, পরের বছর (২০২১-২২) ৩ লাখ ২২ হাজার টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক লাখ টন পেঁয়াজ অতিরিক্ত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। সব ঠিকঠাক হলে ৪ বছর পর এখনকার তুলনায় পেঁয়াজের উৎপাদন ১০ লাখ টন বেশি হবে।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইং ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে পেঁয়াজ চাষের আওতায় জমির পরিমাণ ২ লাখ ৩৭ হাজার হেক্টর। এসব জমিতে মোট পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ২৫ লাখ ৬৬ হাজার টন। উৎপাদিত পেঁয়াজের মধ্যে রবি ৮১ দশমিক ৫৬ শতাংশ, মুড়িকাটা ১৮ দশমিক ১৯ শতাংশ ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ০ দশমিক ১১ শতাংশ। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১০ দশমিক ৮২ টন।
দেশের কৃষকরা ২৫ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন করলেও এর মধ্যে সংরক্ষণের অভাবে প্রায় ২৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। তাই উৎপাদন ১৯ লাখ টনের মধ্যে থাকে। বীজ ও অপচয় বাদে মোট চাহিদা ২৫ লাখ ৯৬ হাজার টন। ২৫ শতাংশ সংগ্রহোত্তর ক্ষতি বিবেচনায় উৎপাদন দরকার ৩৪ লাখ ৬১ হাজার টন। সে অনুযায়ী পেঁয়াজের ঘাটতি ৮ লাখ ৯৫ হাজার টন। প্রতি বছর মোটামুটি ১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়।
ডিএইর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৯০ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি হয় ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৯২০ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০ লাখ ৬৪ হাজার ৩৪০ টন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি করা হয় ১০ লাখ ৯১ হাজার টন। গত অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৭ হাজার ২২০ টন। আমদানি করা পেঁয়াজের প্রায় পুরোটাই ভারত থেকে এসেছে। আর সামান্য পরিমাণ এসেছে চীন, মিশর, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনআরবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৯৫ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শতভাগ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শতভাগ পেঁয়াজ এসেছে ভারত থেকে।
রোডম্যাপ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) ২৫ লাখ ৯৬ হাজার টন নিট চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২৫ শতাংশ ক্ষতিসহ পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৪ লাখ ৬১ হাজার টন। উৎপাদনশীলতা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদন বাড়বে ৬ লাখ ২৫ হাজার টন। ২ লাখ ৭০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির মাধ্যমে চাহিদা প‚রণ করা হবে।
পরের বছর (২০২০-২১) চাহিদা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ২৫ হাজার টন। ক্ষতিসহ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৮ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এভাবে চতুর্থ বছরে কোনো পেঁয়াজ আমদানির প্রয়োজন হবে না। বরং পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত থাকবে।
পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন কৌশল নেয়া হবে জানিয়ে ডিএই’র মহাপরিচালক জানান, উচ্চ ফলনশীল জাত এবং উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হবে। এজন্য প্রচলিত জাতের তুলনায় হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বাড়ানো হবে। পেঁয়াজ চাষের এলাকা বাড়িয়ে বা ফসল প্রতিস্থাপন করে আবাদ স¤প্রসারণ করা হবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে অনাবাদি এলাকা ও চরের জমি অন্তর্ভুক্ত করে সম্ভাব্য ১২ হাজার ১২ হেক্টর বর্ধিত জমি থেকে উৎপাদন বাড়বে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন