দীপন বিশ্বাস, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে
সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও দেখা মেলেনি সরকারি কোনো ডাক্তারের। সরকারি সরবরাহের কোনো ওষুধ নেই এখানে ৬ মাস পর্যন্ত। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা উখিয়ার রাজাপালং এলাকার দরিদ্র মো. হোসেন ও ছেনুয়ারা বেগমসহ একাধিক রোগী একথা জানালেন। ইনডোরে ভর্তিকৃত ৪৬ জন রোগীও এ সময় পর্যন্ত কোনো ডাক্তার দেখেননি ওয়ার্ডে এমনটি জানালেন। আউটডোরে দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসাসেবার আশায় শত শত রোগী আসলেও বিনা চিকিৎসায় ফেরত যেতে দেখা গেছে অনেককে। কার্যত উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বলতে গেলে নেই বললেই চলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী জানালেন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এখানে চরম আকার ধারণ করেছে। যা ঊর্ধŸতন কর্তৃপক্ষও অনেকটা অবগত আছেন। উখিয়ার বিভিন্ন রোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় আউটডোরের টিকেট হাতে শত শত রোগী হাসপাতাল করিডোরে অপেক্ষা করছেন ডাক্তারের আশায়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসময় আউটডোরে রোগী দেখার কথা সরকারি বেতনভুক্ত ডাক্তার আরিফা মেহের রুমি, ডাক্তার মোছাম্মৎ কমলিকা ও ডাক্তার সাবরিনা নূর, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বা আইওএম নিয়োজিত ডাক্তার সুমেন বিশ্বাস, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের ডাক্তার এনামুল হক ও এলএলপির ডাক্তার রাজীব বড়–য়া। বাস্তবে সরকারি কোনো ডাক্তার এসময় হাসপাতালে আসেননি। আউটডোরের রোগী দেখছেন সরকারি প্রকল্প এলএলপির ডাক্তার রাজীব বড়–য়া। তিনি সাংবাদিকদের জানালেন, রাতে নাইট করেছি কিন্তু আজ সকালে আবার আউটডোরে রোগী দেখতে হচ্ছে যা খুবই অমানবিক। রেড ক্রিসেন্টের ডাক্তার এনাম জরুরি বিভাগে বসে গুরুতর রোগীদের পাশাপাশি সাধারণ রোগীও দেখছেন। আইওএম ডাক্তারও একই অবস্থা। চিকিৎসার অপেক্ষায় থাকা রোগী আলমাছ খাতুন (৫৫), বাদশা মিয়া (৪৭)সহ অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ফি দিয়ে টিকিট নিয়েছি ডাক্তার দেখাব আশায়। কিন্তু দেখা গেছে, ডাক্তারের স্থলে চিকিৎসা দিচ্ছে ডেন্টাল টেকনেশিয়ান। সরকারি হাসপাতালে এ যদি অবস্থা হয় তাহলে আমরা গরীব লোকরা যাব কোথায়? হাসপাতালে ইনডোরে ডায়রিয়া আক্রান্ত ভর্তিকৃত স্থানীয় সাংবাদিক রতন দে’র স্ত্রী। সাংবাদিক রতন জানালেন, ওষুধ তো নেই, সুঁই, গজ, ব্যান্ডেজ, ট্যাবসহ সবকিছু বাইরে থেকে কিনে এনে দিতে হচ্ছে। ঠিকাদারের মর্জিনির্ভর সরকারি সরবরাহকৃত খাবার নি¤œমানের হওয়ায় অনেক রোগী বাহির থেকে খাবার কিনে এনে খেয়ে থাকেন। একই অভিযোগ ভর্তিকৃত অধিকাংশ রোগীর। মহিলা ওয়ার্ডের রোগী মরিয়ম খাতুন (২৮) শিশু ওয়ার্ডের নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু ফরহাদের মা কুলসুমা জানান, বুধবার রাতে ডাক্তার এসে খোঁজ নেওয়ার পর বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত কোনো রোগীকে দেখতে কোনো ডাক্তার আসেননি। যদিও হাসপাতালের দেয়ালে ভর্তিকৃত রোগীদের দৈনিক ৩ বার পালাক্রমে আবাসিক মেডিকেল অফিসার বা আরএমও নিয়মিত চেকআপ বা ফলোআপ করার কথা। ভর্তিকৃত রোগী ইমাম শরীফ জানান, মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পরও আরএমও না থাকায় ছাড়পত্র নিতে পারছি না। খেঁাঁজ নিয়ে জানা গেছে, জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসের স্টোর থেকে সর্বশেষ ওষুধসামগ্রী আনা হলেও উখিয়া হাসপাতালের স্টোর কিপার ব্যয় বিল না পাওয়ায় তিনি ওষুধ সরবরাহ আনছেন না। স্টোর কিপার মোহাম্মদ আলী বলেন, কক্সবাজার থেকে ওষুধসামগ্রী আনার পরিবহন, শ্রমিক, ভ্যাট ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয়ের অতীত ৬ মাসের প্রায় ২৪ হাজার টাকা বিল দাখিল করলেও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তা কেটে ৬ হাজার টাকা অনুমোদন দেন। তিনি বলেন, নিজের বেতনের টাকা খরচ করে সরকারি অফিসের জন্য ব্যয় করতে পারি না। তারপরও সিভিল সার্জনের নির্দেশে বৃহস্পতিবার ওষুধসামগ্রী আনতে কক্সবাজার গেছেন বলে তিনি জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক অনেক কর্মচারী জানান, আমাদের বলার থাকলেও তা সম্ভব হয় না। এখানে ডাক্তারদের ডিউটি কার্যতালিকা থাকলেও তা কেউ মানতে চায় না। সব ডাক্তার নিজেদের সুবিধা মতো ডিউটি করতে চাওয়ায় কার্যত কার্যতালিকা অকার্যকর। উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প. কর্মকর্তা ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার বৃহস্পতিবার উল্লিখিত সময় পর্যন্ত অফিসে আসেননি। গুরুত্বপূর্ণ দুই কর্মকর্তা যেখানে নিয়মিত আসেন না সেখানে অন্যান্য মেডিকেল অফিসারও কর্মচারীরা কোন ধরনের অফিস করেন তা ভেবে দেখার দাবি সচেতন মহলের। গতকাল আরএমও ডাক্তার রবিউর রহমান রবির মোবাইল ফোনে চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। একই অবস্থা উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প. কর্মকর্তা ডাক্তার আব্দুল মাবুদের। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাঈন উদ্দিন জানান, উখিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য বিষয়ে লোকজনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আমরা নিজেরা এব্যাপারে বিব্রত। ভোক্তভোগী উখিয়ার প্রায় আড়াই লাখ জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসাস্থল এ হাসপাতালের প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা শৃঙ্খলা বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই বলে সচেতন মহলের অভিযোগ। এব্যাপারে তারা সরকারের নিকট জরুরি হস্তক্ষেপ ও সরকারি আইন অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানান। তাদের মতে, ভাগ্যিস রেড ক্রিসেন্ট, এলএলপি ও আইওএম-এর অতিথি ডাক্তারগণ না থাকলে হয়তো এখানে কোনো চিকিৎসাই পাওয়া যেত না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন