একাত্তরের এদিন সকালে হানাদার বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতর ঢাকা থেকে প্রথমবারের মতো জেনারেল নিয়াজী স্বীকার করেন জল, স্থল ও আকাশপথে তাদের অবস্থা সংকটপূর্ণ- তাছাড়া আকাশ সম্পূর্ন শত্রুর নিয়ন্ত্রণে। এই বলে রাওয়ালপিন্ডিতে সংকেত বার্তা পাঠান। সবদিকে হানাদাররা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় জেনারেল নিয়াজি রাওয়ালপিন্ডিতে মেসেস পাঠান ‘আরো সাহায্য চাই।’ এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হতে নির্দেশ দেন।
কিন্তু মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেওয়ার সময় নেই- কারণ এই মুহূর্তে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে দেয়ার মতো কিছুই নেই। একাত্তরের এদিন চারিদিকে শুধু পাক হানাদারদের পতনের খবর। ঢাকা থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর বেরোবার সবপথ বন্ধ। বন্ধ হয়ে যায় তাদের ঢাকায় প্রবেশের পথও। সর্বত্র মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ঢাকা দখল। বাংলার মুক্তিপাগল বীর বাঙালির কাছে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে প্রশিক্ষিত পাক সেনারা। মাত্র একদিন আগেই বেতারসহ বিমানে হাজার হাজার লিফলেট ছড়িয়ে পাক হানাদারদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায় মিত্রবাহিনী । মিত্র ও মুক্তিবাহিনী বীরদর্পে দেশের অধিকাংশ জেলায় বিজয় কেতন উড়িয়ে ঢাকা দখলের জন্য মরিয়া। একটাই লক্ষ্য চূড়ান্ত বিজয়। চারিদিক থেকে ঘিরে ঢাকামুখি মিত্রবাহিনী।
৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ দুপুর ১২টার দিকে যশোর-ফরিদপুর সড়কে এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন করিমপুর এলাকায় সেনাবাহিনীর জিপ নিয়ে ঢুকে পড়ে। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সালাউদ্দিন বাহিনীর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা কাজী সালাউদ্দদিন ও তার সহযোদ্ধারা পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, তার হাতের এলএমজি গর্জে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রক্তে ভেসে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেনের জিপটি। এর আধা ঘণ্টা পর যশোর থেকে আগত সেনা সাঁজোয়া বহর এ সংবাদ পেয়ে তিন দিক থেকে সালাউদ্দিন বাহিনীর ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। শুরু হয় তুমুল সম্মুখযুদ্ধ। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি ফুরিয়ে আসতে থাকে, তখন কমান্ডারের নির্দেশ আসে ‘এক পাক আর্মি, এক গুলি’।
এই সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন সালাউদ্দিন বাহিনীর ৬ যোদ্ধা। বাকী সহযোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সাহসী এই বীর যোদ্ধা এলএমজি দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করতে করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামনাসামনি অবস্থান নেন। তার ব্রাশ ফায়ারের গুলিতে অসংখ্য পাক সেনা রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর পাক সেনারা একত্রিত হয়ে আবার সালাউদ্দিন বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। গুলির মজুদ প্রায় শেষ হয়ে গেলে সালাউদ্দিন এর নির্দেশে সহযোদ্ধারা জীবন বাঁচিয়া নিরাপদ দুরত্বে সরে যান। একা সালাউদ্দিন জীবন বাজি রেখে এলএমজি এর ট্রিগার চাপতে থাকেন। এবারও অসংখ্য পাকসেনা হতাহত হয়। এমন সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটি বুলেটে তাঁর এলএমজি এর ম্যাগজিন উড়ে যায়। আর একটি বুলেট তাঁর পিঠে বিদ্ধ হয়। রক্তাত্ত সালাউদ্দিন ৭শ’ গজ দূরে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেই বাড়িতে ঢুকে বাড়ির সব মানুষদের গুলি করে হত্যা করে এবং বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। শহীদ হন ২২ বছর বয়সী তরুণ যোদ্ধা কাজী সালাউদ্দিন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিজয় এর পর ১৭ ডিসেম্বের ফরিদপুর হানাদার মুক্ত হলে সেই বাড়িতে শহীদ সালাউদ্দিনের কঙ্কাল শনাক্ত করা হয় এবং সেইদিনই তাকে ফরিদপুরের আলিপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-চাঁদপুর মুক্ত হওয়ার পর মিত্র-মুক্তিবাহিনী দাউদকান্দি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থানা মুক্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে মুক্তি-মিত্রবাহিনী একে একে আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোণা মুক্ত করে। এদিকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করতেও মিত্র-মুক্তিবাহিনীর একটি গুলিও খরচ করতে হয়নি এবং কোনো বাধাও আসেনি। মিত্র-মুক্তিবাহিনী এই দিনে গোয়ালন্দ ঘাট, গাইবান্ধা, পাইকগাছা, কুমারখালী, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা ও চট্টগ্রামের নাজিরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে।
মিত্র-মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনারা দলে দলে আত্মসমর্পণ শুরু করে- শুধু কুমিল্লার ময়ানমতিতেই আত্মসমর্পণ করে এক হাজার ১৩৪ জন। আর সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ করে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭ পাকিস্তানি সেনা।#
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন