বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বিজয়ের বাকি মাত্র একদিন

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিজয়ের আর মাত্র একদিন বাকি ছিল। আজকের দিনে মুক্তিযুদ্ধে চুড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের নতুন জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হওয়াটা শুধু কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র। চারদিক থেকে পরাজিত হতে হতে পাকবাহিনী বুঝে ফেলে যুদ্ধে তাদের পরাজয় নিশ্চিত।

একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর দেশের অধিকাংশ রণাঙ্গনে চলছিল মুক্তিকামী জনতার বিজয়োল্লাস। বস্তুত যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে যায়। পরাজয় মেনে নেয়া এবং বিজয়ের ঘোষণা দেয়ার আনুষ্ঠানিকতা বাকি থাকে মাত্র। এদিন অসংখ্য নদীনালা খালবিলসহ নানা প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ইতোমধ্যে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলায় অবরুদ্ধ ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জে. আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠান একাত্তরের এই দিনে। কিন্তু ভারত তা প্রত্যখ্যান করে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের দাবি জানায়। ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে আত্মসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে জরুরি বার্তা পাঠান জেনারেল নিয়াজির কাছে। বার্তায় তিনি বলেন, আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির জন্য ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর ৯টা পর্যন্ত বিমান হামলা বন্ধ রাখা হবে। কিন্তু এর মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে প্রচন্ড বিমান হামলা শুরু করা হবে।

নিয়াজির আত্মসমর্পণের খবরে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক বসে। জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭১ সালের এই দিনে জাতিসঙ্ঘে উত্থাপিত সবক’টি খসড়া প্রস্তাব ছিঁড়ে ফেলে সদলবলে বেরিয়ে যান। বেরিয়ে যাওয়ার আগে তিনি বলেন, এটাই বোধ হয় আমার শেষ বক্তৃতা। এখানে আত্মসমর্পণ করতে আসিনি। জাতিসঙ্ঘকে জালিয়াতি ও ধোঁকাবাজির পীঠস্থান আখ্যায়িত করে ভুট্টো বলেন, ফ্রান্স ও ব্রিটেন স্পষ্টভাবে কোনো পক্ষ না নেয়ায় পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতি বিষয়ে কোনো চুক্তি হতে পারল না। ‘চললাম যুদ্ধ করতে’ এ কথা বলে অধিবেশন থেকে বেরিয়ে যান ভুট্টো।

অন্যদিকে মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে মোকাবিলা করবার জন্য এই দিন বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ভারতীয় নৌবাহিনীর সমর্থনে ১৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান গ্রহণ করে। এরপর মার্কিন রণতরী সপ্তম নৌবহর যুদ্ধে অংশ নেয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে ফেলে। পাকিস্তানের মনে যুদ্ধে সাহায্য পাবার যেটুকু আশা ছিল সেটাও এর সাথে শেষ হয়ে যায়।

পরাজয়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ না করায় মিত্রবাহিনী চূড়ান্ত আঘাতের পরিকল্পনা করে। ১৪ তারিখ রাত ৩টায়ও নবীনগর এলাকায় দুই পক্ষে প্রচন্ড লড়াই চলে। প্রায় দেড় শ’ পাকিস্তানি সৈন্য এ লড়াইয়ে নিহত হয়। রাত ৪টায় পাকিস্তান বাহিনীর সাভার ঘাঁটির পতন হয়। জেনারেল নিয়াজি ভারতীয় সেনাপ্রধান মানেকশর কাছ থেকে বার্তা পাওয়ার পর তা রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদের কাছে পৌঁছে দেন দিনে।

১৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তানের তখনকার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জেনারেল নিয়াজিকে নির্দেশ দেন যে, ‘ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য তা মেনে নেয়া যেতে পারে।’ আত্মসমর্পণের এ নির্দেশ পেয়ে সেনানিবাসে নিজের কক্ষে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন কথিত পরাক্রমশালী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে রাত ২টার মধ্যে বাংলাদেশের সব জায়গায় অবস্থানরত হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে তারবার্তা পাঠান।

এ দিনটি মূলত দখলদার বাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের দিন-ক্ষণ নির্ধারণের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী ভারত ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে বিমান হামলা বন্ধ রাখে। কিছুক্ষণ পরপর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশবাণী থেকে মানেকশর আত্মসমর্পণের আহ্বান প্রচার করা হয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যৌথবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে উপস্থিত হতে লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা এই দিনে সস্ত্রীক ঢাকায় এলে তাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড প্রধান লে. জে. এ এ কে খান নিয়াজি।

একাত্তরের এই দিনে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দির জাহাঙ্গীর শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীর ৭ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। শৃংখলা, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর অচিরেই সকলের শ্রদ্ধা ও বিস্ময় জাগিয়ে তোলেন।

তিনি কোন বিরাম না নিয়ে দিনের বেলা অপারেশনের পরিকল্পনা করতেন এবং প্রতিরাতেই গেরিলাদের সঙ্গে অপারেশনে যেতেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখলের যুদ্ধে তিনি সরাসরি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। মহানন্দা নদী পেরিয়ে তিনি একের পর এক শত্রু বাংকার দখল করে যখন প্রবল বিপদ উপেক্ষা করে এগুচ্ছিলেন তখন হঠাৎ মাথায় গুলি লাগে তার। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন