সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার মাছে ভাতে ভান্ডারী নামে খ্যাত চাউলধনী হাওরে পানির অভাবে ইরি-বোরো ফসল চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। চাউলধনী হাওরের চার পারের ৩০ থেকে ৩৫টি গ্রামের প্রায় ২৫ হাজার কৃষকের এখন মাথায় হাত। তাদের কান্না কেউ শোনছে না। একটি মৎসজীবি সমবায় সমিতির নামে অমৎসজীবি ইজারাদারের অতি লোভের কারনে প্রায় শত কোটি টাকার ধান উৎপাদন বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। পানি প্রত্যাহারের কারনে কৃষকরা দলবদ্ধভাবে লীজ বাতিল ও লীজ গৃহীতার শাস্তির দাবিতে হাওরে প্রতিবাদ সমাবেশ করছেন। কথিত আছে যে, চৈত্র-বৈশাখ মাসে উৎপাদিত চাউলধনী হাওরের ধানে সমগ্র বাংলাদেশের আড়াই দিনের খাদ্য উৎপাদন হয়। সেই চাউলধনী হাওরে এখন পানি নেই।
স্থানীয় জন সাধারণের অভিযোগ, দশ ঘর গ্রামের একটি মৎসজীবি সমবায় সমিতির নামে চাউলধনী হাওরের সরকারি জলাভুমি থেকে মাছ আহরণের জন্য ইজারা দেয়া হয়। ইজারাকালীণ সময়ে কৃষকের ফসল উৎপাদনে কোন ক্ষতি না করার বিভিন্ন শর্তারোপ করা হয়। কিন্তু ইজারাদার সকল শর্ত ভঙ্গ করে মাছ ধরার লোভে হাওরের বাঁধ কেটে পানি ছেড়ে দেয়। এতে শতাধিক একর চারা জমি ও চার হাজার একরের মত বোরো জমির পানি শুকিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। হাওরে ১৬ টি বিল ও ৩০টি খালসহ শতাধিক পুকুর ব্যক্তি মালিকানাধিন রয়েছে। সরকারি জলাশয়ে সীমানা নির্ধারণ না থাকায় ইজারাদার ও সাবলীজ গ্রহীতা গরিব কৃষকের জমি, পুকুর দখল করে সেচ দিয়ে পানি প্রত্যহাতার করে মাছ ধরে নিচ্ছে। ইজারাদারদের সাথে প্রভাবশালি মহল ও প্রশাসনের ক্ষতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা নেপথ্যে থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
২০১৭ সালে ১০ লাখ ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ৫ বছরের জন্য চাউলধনি হাওরের ১৭৮ একর জলমহাল জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা দেয়া হয়। কিন্তু এ হাওরে প্রায় ৬ হাজার একর জমি রয়েছে। ১৯৭৭ সালে জাতীয় একটি দৈনিকে বিশাল এই হাওরে সুইস গেইট নির্মাণের জন্য সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এডিবির একটি প্রতিনিধি দলও হাওরটি সরেজমিন ঘুরে গেইট নির্মানের প্রস্তাবও করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে গেইট নির্মাণ করা হয়নি। এভাবে লীজের নামে ক্ষতিপয় প্রভাবশালি অমৎজীবিরা ভুয়া সমিতি গঠন করে হাওরের ফসল উৎপাদনে বাঁধার সৃষ্টি করে নিজে লাখ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করছে। এই অঞ্চলের কৃষক একমাত্র বোরো ফসলের উপর নির্ভরশীল। চলতি বছর অতি বৃষ্টি ও বন্যার কারনে অগ্রাহায়ন মাসের ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কৃষকরা বিভিন্নভাবে অগ্রিম ঋণ নিয়ে ফসল উৎপাদনের জন্য বীজ তলায় বীজ বপন করেছিলেন। কিন্তু ইজারাদার রাতের আধারে বাঁধ কেটে দিয়ে হাওরের পানি শুকিয়ে দেয়ায় বীজ তলা ও ফসলের ভুমি রুদ্রে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। যেকারনে অঞ্চলে চৈত্র ও বৈশাখ মাসে খাদ্য সংকট চরমভাবে দেখা দিবে।
বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান জানান, এ অঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে, চাউলধনী হাওর। কিন্তু ইজারাদার পানি ছেড়ে দিয়ে ২শ কোটি টাকা ধানের ক্ষতি করেছে। এ ব্যাপারে লীজ বাতিল করে সরাসরি ভুমি মন্ত্রনালয়ের দতন্ত করে কৃষক বাচাঁনোর দাবি করছি এবং স্থানীয় প্রশাসন সরকারি খতিয়ানভুক্ত ভুমির সীমানা নির্ধারণ করে গরিব কৃষকদের দখলকৃত জমি উদ্ধার করে দিতে হবে।
দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমির আলী বলেন, সিলেটের চাউলধনী একটি অন্যতম হাওর। পানির অভাবে হাওরটি ইরি-বোরো ফসল উৎপাদনে চরম ব্যাঘাত ঘটছে। কয়েক হাজার কৃষি পরিবারের লোকজন অভাবের সম্মূখিন হচ্ছেন। তাই কৃষক বাঁচাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।
সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশিষ্ট কলামিষ্ট এ এইচ এম ফিরোজ আলী বলেন, চাউলধনী হাওরের সুনাম সমগ্র বাংলাদেশে রয়েছে। এই হাওরের মিটাপানির মাছ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করা হয়। শত প্রজাতির পাখি শীতকালে এসে হাওরে কিলবিল করে। হাজার হাজার মন ধান উৎপন্ন হয়। কিন্তু দু’এক ব্যক্তির অর্থ লোভের কারনে হাওরটি যেমন তার রূপ বদলেছে, তেমনি জীব বৈচিত্র ধবংস হয়ে যাচ্ছে। এবার হাওরের যে অবস্থা কৃষক সমাজ মারাত্বাকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। অভিলম্বে তদন্তপূর্বক লীজ বাতিল ও সরকারি ভূমির সীমানা নির্ধারণ করা উচিৎ। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমজান আলী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নি¤œাঞ্চলে কিছু পানি থাকলেও বীজতলা ও ফসলি জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন