শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

৭৭ ভাগ শ্রমিক খাদ্য সঙ্কটে-টিআইবি

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৫ এএম

করোনা মহামারিতে সৃষ্ট সঙ্কটে তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত প্রায় ৭৭ ভাগ শ্রমিক তাদের পরিবারের সব সদস্যের খাদ্য চাহিদা প‚রণ করতে পারছেন না বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ সংস্থাটির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রম আইনের দুটি ধারার কারণে করোনা মহামারির সময় পোশাক কারখানার মালিকরা একতরফাভাবে কর্মী ছাঁটাই করতে পেরেছে। ছাঁটাই আতঙ্ক সৃষ্টি করে শ্রমিকদের বেতন কমিয়ে দিয়েছেন তৈরি পোশাক মালিকরা। তারা সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করে প্রণোদনা আদায় করতে পারলেও শ্রমিকের নিরাপত্তায় প্রধান্য দিতে পারেনি।
গতকাল ‘তৈরি পোশাক খাতে করোনাভাইরাস উদ্ভ‚ত সংকট: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এই তথ্য প্রকাশ করেছে টিআইবি।

টিআইবি বলছে, করোনা সংকটকালে প্রণোদনার অর্থ প্রাপ্তিতে জটিলতা, কার্যাদেশ না থাকা ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বকেয়া পরিশোধে বিলম্ব করায় এপ্রিল মাস থেকে অধিকাংশ কারখানা নিয়মিত মজুরি দিতে পারেনি। উদ্ভ‚ত সংকট মোকাবিলায় কিছু কারখানা শ্রমিক ছাঁটাই করে। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে ছাঁটাই আতঙ্ক সৃষ্টি করে কর্মরত শ্রমিকদের দিয়ে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কাজ করালেও অতিরিক্ত কাজের বেতন-ভাতা পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে।

টিআইবি বলছে, মালিকপক্ষ লে-অফ করা কারখানার শ্রমিকদেরও এপ্রিল মাসে ৬৫ শতাংশ বেতন প্রদানের অঙ্গীকার করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ অঙ্গীকার মানা হয়নি। লে-অফ ঘোষণার কারণে এক বছরের কম সময় কর্মরত অনেক শ্রমিক কোনও সুবিধা ছাড়া চাকরি হারায়। ফলে কিছু কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ, বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। আবার অনেক কারখানা ঈদ পরবর্তী ছয় মাসেও ঈদ বোনাসের বাকি অর্ধেক পরিশোধ করেনি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে কিছু কারখানা অগ্রিম নোটিশ প্রদান না করে অর্ডার বাতিল করার অজুহাতে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব কারখানায় শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি। ফলে করোনা উদ্ভ‚ত সংকটে শ্রমিকরাই আর্থিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বেতন এবং ঈদ বোনাসের ক্ষেত্রে প্রাক্কলিত ‘ওয়েজ গ্যাপ’ হয় যথাক্রমে ৩০ ও ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ তৈরি পোশাক খাতে মোট কর্মরত শ্রমিক তাদের নিয়মিত বেতন ও ঈদ বোনাসের যথাক্রমে ৩০ ও ৪০ শতাংশ কম পেয়েছে। অপর একটি গবেষণায় দেখা যায়, করোনাভাইরাস উদ্ভ‚ত সংকটে তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত প্রায় ৭৭ শতাংশ শ্রমিক তাদের পরিবারের সব সদস্যের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না।

টিআইবি বলেছে, শ্রম আইন, ২০০৬ এর ধারা ১৬(১) এ লে-অফ ঘোষিত কারখানায় এক বছরের কম কাজ করা শ্রমিকদের কোনো ক্ষতিপূরণ না দেওয়া এবং ৪৫ দিনের বেশি লে-অফ হলে ধারা-২০ এর আওতায় ছাঁটাই করার বিধান থাকায় মালিকপক্ষ একতরফা সুবিধা ভোগ করে। মহামারিকালে মালিকপক্ষের ব্যবসায়িক স্বার্থ নিশ্চিতে কারখানা লে-অফ করার প্রবণতা বেড়েছে এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শ্রমিকরা। উল্লেখিত দুটি ধারার কারণে করোনাভাইরাস সংকটকালেও একবছরের কম সময় কাজ করা প্রায় ২০ শতাংশ পোশাক শ্রমিক কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ১৬ এপ্রিল সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধ আইন, ২০১৮ এর ধারা ১১(১) ক্ষমতাবলে জনগণকে বাইরে বের হতে নিষেধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবে কারখানার শ্রমিকদের জন্য এক্ষেত্রে করণীয় শ্রম মন্ত্রণালয় সম্পূরক কোনো নির্দেশনা জারি করেনি।
টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের অ্যাসিসট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম মিল্টন গবেষণা পরিচালনা করেন। করোনাভাইরাস সংকটের সময়ে এই খাতে কী ধরনের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ছিল তা দেখা হয়েছে গবেষণায়। মে থেকে নভেম্বর মাসে সময়ের মধ্যে এই গবেষণা চালানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের নির্বাহী আদেশে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলেও কারখানার ক্ষেত্রে তা কিভাবে প্রতিপালিত হবে স্পষ্ট করা হয়নি। ফলে উদ্ভুত সংকটে মালিক একতরফাভাবে কারখানা লে-অফ ঘোষণা এবং শ্রমিকদের অধিকার উপেক্ষা করা হয়। লকডাউন ঘোষণার ক্ষেত্রে ভারতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৫ এবং পাকিস্তানে মহামারি রোগ সংক্রান্ত আইন, ২০১৪ প্রয়োগ করা হয়েছে। আইন প্রয়োগ করে দেশ দুটির সরকার কারখানা লে-অফ করতে পারবে না এমন স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়।

গবেষণায় বলা হয়, মহামারি শুরু হওয়ার পর বিদেশি ক্রেতারা একের পর এক ক্রয়াদেশে বাতিল করতে শুরু করায় কারাখানাগুলো চাপে পড়ে। একদিকে তারা সরকারের কাছে প্রণোদনার দাবি জানায় অন্যদিকে কারখানায় লে-অফ ও ছাঁটাই শুরু করে। অগাস্ট পর্যন্ত বাতিল ক্রয়াদেশের মধ্যে ৯০ শতাংশ পুনর্বহাল হয় এবং প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের নতুন কার্যাদেশ বাংলাদেশে এসেছে।

তবে সরকার ও মালিকপক্ষের নানা উদ্যোগের পরেও অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১০ শতাংশ (প্রায় ৩১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২,৬৯৩ কোটি টাকা) বাতিল হওয়া ক্রয়াদেশের উৎপাদিত পণ্য কারখানার মালিক শিপমেন্ট করতে পারেনি। অধিকাংশ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান উদ্ভ‚ত পরিস্থিাতির সুযোগ নিয়েছে।

সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের এপ্রিল-জুলাই মাসের বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য মোট ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার স্বল্প সুদে ঋণ ‘প্রণোদনা প্যাকেজ’ ঘোষণা করে। বিজিএমইএর এক হাজার ৩৭০টি এবং বিকেএমইএর ৪২০টি কারখানাসহ মোট দুই হাজার ৪৪টি প্রতিষ্ঠান এই প্রণোদনা পায়। কিছু কারখানা লে-অফ ঘোষণা এবং সংকটের শুরুতে কর্মী ছাঁটাই হওয়ার কারণে প্রণোদনা প্রাপ্ত ৬৪ কারখানার ২১ হাজার শ্রমিকের বেতন-ভাতা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ পরিস্থিাতিতে সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানাগুলোর জন্য কোনো নির্দেশনা না থাকায় সংশ্লিষ্ট তিন হাজার কারখানার প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিকের বেতন-ভাতা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

টিআইবি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নূরে আলম মিল্টন বলেন, ‘টিআইবির হিসাবে ৬৪টি কারখানায় ২১ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন। এর বাইরেও অনেক শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন যার হিসাব আমরা পাইনি। জুন পর্যন্ত শিল্প পুলিশের কিছু তথ্য পেয়েছি।
এপ্রিলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর করোনাভাইরাস সংক্রমিত কারখানার শ্রমিকদের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে ২৩টি কার্যালয়ে রেজিস্টার চালু করে। একই সময়ে শিল্প পুলিশও করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং শ্রমিক ছাঁটাইয়ের তথ্য প্রকাশের উদ্যোগ নেয়।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর রেজিস্টার চালু করা হলেও সংক্রমিত রোগীর হালনাগাদ কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। জুলাই পর্যন্ত শিল্প পুলিশ সংক্রমিত কারখানা ও শ্রমিকের তথ্য প্রকাশ করে তবে অগাস্ট মাস থেকে আর পাওয়া যায়নি।
মহামারির ফলে উদ্ভুত সংকটের শুরুতে বিজিএমইএ কার্যাদেশ বাতিলের পরিমাণ, ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা ও শ্রমিকের সংখ্যা এবং করোনা আক্রান্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সরকারের প্রকাশিত তথ্যের তুলনায় বিজিএমইএ-প্রকাশিত তালিকায় শ্রমিক ছাঁটাই ও আক্রান্ত শ্রমিকের সংখ্যা কম দেখানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিজিএমইএর ৩৪৮টিসহ মোট ১,৯০৪টি কারখানা লে-অফ ও বন্ধ ঘোষণা করে এবং প্রায় ৬০-৬৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হন।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প চীনের ওপর নির্ভরশীল। চীনের অর্থনীতিতে আঘাত আসার কারণে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। সরকারি প্রণোদনার ওপর নির্ভর হয়ে থাকার চার বছরের যে অভ্যাস সেটাই এবার মহামারির সময় প্রতিফলিত হয়েছে। মালিকপক্ষের আচরণে মনে হয়েছে যেন তারাই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সরকারি প্রণোদনার সিংহভাগই তারা নিয়েছে। সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করে প্রণোদনা আদায় করতে পারলেও শ্রমিকের নিরাপত্তায় প্রধান্য দিতে পারেনি। কোনো কোনো মালিক ব্যাপকভাবে লে-অফ করেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন