আবু তাহের
দেশ-বিদেশ ঘুরতে সবার ভালো লাগে। আগের জামানায় উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকেরা বিলেত যেত। পয়সা খরচ করে ব্যারিস্টারি পাস করত। এটা অবশ্য একটা ভালো দিক ছিল। লেখাপড়া শিখে বড় হওয়া। তারপর দেশে ফিরে মানুষের সেবা করা। এখন অবশ্য যুগ বদলেছে, মানুষেরও পয়সা হয়েছে ঢের। সুযোগ পেলেই বিদেশ ঘুরতে ভুলে না। আর যদি সে ঘোরাঘুরিতে নিজের ঘাটের পয়সা খরচ করে না করতে হয় তবে তো সোনায় সোহাগা। তাই হয়তো কিছু লোক প্রধানমন্ত্রীকেও দু’হাত দেখে নেয়ার মতো স্পর্দা করে বসল।
সম্প্রতি অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প আমার নিজস্ব আইডিয়া ছিল। প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করে যখন আমার কাছে দেখাতে আসে, তখন দেখি সেখানে বিদেশ সফরের ব্যবস্থা রাখা আছে। আমি সেই বিদেশ সফর ও বরাদ্দকৃত টাকা কেটে দিলাম। পরে দেখি প্রকল্পটি আর একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য ওঠে না। কেন প্রকল্পটি আসে না খবর নিয়ে জানতে পারলাম, প্রকল্পে বিদেশ সফর না থাকার কারণে অনুমোদনের জন্য আনা হচ্ছে না। পুনরায় বিদেশ সফরের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দেওয়ার পর প্রকল্পটি একনেক সভায় আনা হয়। বিদেশ সফর না থাকলে আমার প্রকল্প পর্যন্ত অনুমোদন হয় না।”
বিষয়টি আসলেই অবাক করার মতো। অহেতুক বিদেশ সফর করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ও অনুমোদিত হয় না। এমন কি প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিজেও অতিষ্ঠ। যথেষ্ট আক্ষেপ ও বিরক্তি নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বিদেশে যেতে আমার কাছে যে হারে তদবির আসে, দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাইল অনুমোদনের জন্য সে রকম তদবির আসে না। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।’
রাষ্ট্রের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় করে বিদেশ ভ্রমণ কতটুকু সুফল বয়ে আনে? বাস্তবতার নিরিখে ফলাফল প্রায়ই শূন্য। যেমন রেলওয়ের সংস্কার প্রকল্পের কাজ। এই সংস্কারের নামে অভিজ্ঞতা অর্জনে চলছে বিদেশ সফর। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন ও মালয়েশিয়ার সফর হয়ে গেছে। অনেকেই এই বিদেশ সফরকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন। কারণ অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন ও মালয়েশিয়ার রেল ব্যবস্থাপনার সাথে বাংলাদেশ রেলওয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই। ইতোমধ্যে এই সফরগুলোতে কোটি টাকার উপর ব্যয় হয়ে গেছে। কর্মকর্তাদের এই মানসিক চিন্তাধারা আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পরিবর্তে কতটুকু পিছিয়ে দিচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর যতই দিন যাচ্ছে এই প্রতিযোগিতা যেন বেড়েই চলছে।
সম্প্রতি, চট্টগ্রাম নগরীর থিয়েটার ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে মেয়র নাছির বলেন, ‘যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা চট্টগ্রামে এসেছিলেন। তিনি একটি নতুন পাজেরো জিপ চাইলেন। সেটি দিলে নাকি চসিকের প্রকল্প অনুমোদন বা পাসে কোনো সমস্যা হবে না।’ ওই অনুষ্ঠানে মেয়র আরও বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তাকে ৫ শতাংশ করে দিতে রাজি না হওয়ায় কর্পোরেশনের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাইনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে থোক হিসেবে ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলো। ৫ শতাংশ হিসাবে ছেড়ে দিলে ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকা আনতে পারতাম।’
এজন্য মেয়র সাহেবের কাছে জবাবও চাওয়া হয়েছে। তিনিও জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়েছেন। ক’দিন পর হয়তো মূল বিষয় জানা যাবে। যদি সত্যিই মেয়র নাছির তার স্বপক্ষে প্রমাণ পেশ করতে পারেন তবে বিষয়টি কতটুকু উদ্বেগের। দেশটাকে যেন হরিলুটের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যে যার মতো করে খুবলে খাচ্ছে। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের এমন মানসিকতা দেশের অবনতি ছাড়া আর কিছুই নয়। একনেক ঐ সভায় বিদেশ সফরের বিষয়টি উত্থাপন করেন একজন জ্যেষ্ঠ সচিব। ৫০ জেলায় ১৫ হাজার কৃষককে ফসল সংগ্রহ-পরবর্তী সময়ে কম সুদে ঋণ দেওয়ার একটি প্রকল্প সভায় উত্থাপন করা হলে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এ ধরনের একটি মহৎ ও ভালো প্রকল্পেও বিদেশ সফরের জন্য ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৪ জন কর্মকর্তা বিদেশে যাবেন।’ অবাক করা বিষয় হলো এই প্রকল্পেও বিদেশ সফর হয়! কারণ হিসাবে জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, বাংলাদেশকে বলা হয় ক্ষুদ্রঋণের বিশ্ববিদ্যালয়। ক্ষুদ্রঋণের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা এ দেশে আসেন ক্ষুদ্রঋণের পদ্ধতি দেখার জন্য। অথচ দেশ থেকে কর্মকর্তারা বিদেশে যেতে চাচ্ছেন!
গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ‘কর্মকর্তারা সরকারি অর্থায়নের প্রকল্পের সূত্রে বিদেশ যেতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু উন্নয়ন সহযোগী কোনো দেশ বা সংস্থা যদি কোনো কর্মকর্তাকে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়, তখন তাঁরা যেতে আগ্রহী হন না।’ কারণ হিসাবে, সরকারি টাকায় বিদেশ গেলে খরচ কমিয়ে কিছু টাকা বাঁচানো যায়। কিন্তু উন্নয়ন সহযোগী দেশ বা সংস্থা নিয়ে গেলে তারাই সব ব্যবস্থা করে। সেখান থেকে টাকা বাঁচানোর সুযোগ থাকে না।
রাষ্ট্রের এই হর্তাকর্তারা দেশটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানা নেই। এর পূর্বে বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় নির্বাচন কমিশনে বিদেশ ভ্রমণের হিড়িক পড়েছিল। তারা একে একে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ড সফর করেছিলেন। পরিচয়পত্র তৈরির জন্য টেকনিক্যাল কর্মকর্তার তুলনায় কমিশন সদস্য এবং সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা কেন প্রয়োজন ছিল তা বোধগম্য নয়। এরকম অনেক উদাহরণ পেশ করা যাবে। কিন্তু আমাদের চিন্তা-ভাবনার দৌড় কোন পর্যন্ত? প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ব্যক্তিস্বার্থ সবার আগে দেখা হয়। দেশেকে নিয়ে একটু ভাবতে হবে। ভাবতে হবে দেশের মানুষকে নিয়ে। দেশের বন্যা পরিস্থিতি খুবই নাজুক অবস্থায়। লাখ লাখ মানুষ অনাহারে খোলা আকাশের নিচে মানবেতরভাবে জীবনযাপন করছে। একমুঠো খাবারের জন্য প্রতিক্ষণ তাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা ব্যক্তিগত বিনোদনের জন্য বিদেশ সফরের জন্য উঠে পড়ে লেগেছি। দেশের মানুষের জন্য একটু ভাবুন। এরপরও যদি না হয় তবে আমি বিদেশ সফরের একটা শর্টকাট ফর্মুলা বাতলে দিতে পারি। আর তা হলো পঞ্চাশ টাকায় বিদেশ সফর। জনগণের পয়সা না ভেঙ্গে নিজের পকেটের মাত্র পঞ্চাশ টাকা খরচ করেই আপনি বিদেশ ভ্রমণ করে আসতে পারেন।
দু’টো আলাদা স্বাধীন দেশ। কিন্তু এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রবেশে লাগবে না কোনো পাসপোর্ট। শুধু নিজ দেশের ইমিগ্রেশন দপ্তর থেকে দেওয়া বর্ডার পাসটা দেখালেই হবে। ওই দেশে প্রবেশে আর কোনো বাধা নেই। আর এই এক দেশ থেকে আরেক দেশ সফরের অনুমতি পেতে খরচ করতে হবে মাত্র ৫০ টাকা! এক্ষেত্রে দুই দেশের মানুষ বাংলাদেশের টেকনাফ স্থল বন্দরের ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ও মিয়ানমারের মংডু ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের নাগরিকদের মিয়ানমার যেতে ওদের মুদ্রায় ৮০০ কিয়াট (১৬ কিয়াট সমমান বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ টাকা) জমা দিতে হয়। বাঙালি মুসলিম সেদেশে গিয়ে তিনদিনের বেশি থাকতে পারেন না। শুধু মংডু শহরেই থাকতে পারবেন এ তিনদিন।
বিদেশ সফরের এর থেকে হয়তো ভালো ব্যবস্থা আর নেই। তারপরও অনুরোধ, আরেকবার ভাবুন। দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবুন। দেশকে আরও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেত আমরাও শামিল হতে পারি। প্রয়োজন শুধুমাত্র একটু সদিচ্ছা।
ষ লেখক : লেখক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন