শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

জঙ্গিবাদ রুখতে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন

প্রকাশের সময় : ২৪ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি
একাত্তরে এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদারদের কাছ থেকে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ’৭২-এর সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এ চারটি মূলনীতি প্রণয়ন করেন। ’৭৫-এর পরবর্তী সময়ে সংবিধান বারবার পরিবর্তন করা হয়। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা শুরু হয়। ধর্মীয় উগ্রতার বীজ এভাবেই রোপিত হয়। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জননেত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, সরকারের মদদে শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের উত্থান, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি কর্তৃক সারা দেশে ৫০০ সিরিজ বোমা হামলাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এদেশে জঙ্গিবাদের বিকাশ ঘটে। সম্প্রতি ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করেছে।
জঙ্গিবাদ এখন এশটি বৈশ্বিক সমস্যা। গত ছয় মাসে বাংলাদেশ, ফ্রান্স, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, পাকিস্তান, ইরাক, আফগানিস্তান, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এসব হামলার দায় স্বীকার করেছে বর্তমানে আলোচিত-সমালোচিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আইএস’। বিশ্বব্যাপী আইএসের উত্থান বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য কতটা হুমকি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ যখন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, এদেশের প্রবৃদ্ধি যখন বিগত কয়েক বছর যাবৎ ছয় শতাংশের উপরে, সবশেষে অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশ নিম্নআয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যোগাযোগ খাতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সরকার আশা করছে আগামী ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছরে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে এই ধরনের জঙ্গি হামলা অগ্রগতির ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লে­খযোগ্য বিষয় হলো হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও মেট্রোরেলের কাজে তদারকি করতে আসা বিদেশিরা। এতে বোঝা যায়, এ হামলা দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার একটা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। বাংলাদেশের জঙ্গি তৎপরতায় আইএসের নাম ব্যবহার করা হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এদেশে তাদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা জেএমবি, আনসার আল ইসলাম আইএসের ন্যায় উগ্র সালাফীবাদী। তারা একই মতাদর্শের অনুসারী। আইএসের ম্যাগাজিন ‘দাবিকে’ও জেএমবিকে বাংলাদেশে আইএসের শাখা বলে অবহিত করা হয়েছে। তাই এক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে, আইএস নয় বরং দেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোই এসব কর্মকা-ের জন্য দায়ী। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় সমাজের উচ্চস্তরেও জঙ্গিবাদের প্রসারতা পাচ্ছে। গুলশান, শোলাকিয়া সর্বশেষ কল্যাণপুরের ঘটনায় নিহত ১১ জনের ৭ জন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
গুলশান হামলায় মাদরাসা ও ইংরেজি মাধ্যম দুটি বিপরীতধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উঠে আসারাই হামলা চালায়। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো ধর্মের নামে এসব তরুণের মগজ ধোলাই করে। ইসলামের অপব্যাখ্যা করে। অথচ সহিষ্ণুতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি মক্কা বিজয়ের পর বিরুদ্ধবাদীদের ক্ষমা করে এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
আশার কথা হলো, জননেত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। জঙ্গিবাদ দমনে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও গুলশান, শোলাকিয়া এবং কল্যাণপুরের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতাকে তুলে ধরেছে। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলো জিম্মি সংকট নিরসনে অপারেশন পরিচালনায় যে সময় নিয়েছে সেখানে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা এবং সশস্ত্র বাহিনী সময় নিয়েছে তার চেয়ে অনেক কম। তাদের ত্বরিত পদক্ষেপ বিশ্বের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র জঙ্গি দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে যা সত্যিই ইতিবাচক। এ ছাড়া জঙ্গি দমনে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় তুলে ধরা প্রয়োজন, অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের ধারণা সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ দমনে আঞ্চলিক জোট অধিক কার্যকর। কোনো ছাত্র ১০ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে সংশ্লিষ্ট ছাত্রের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানানোর বিষয়ে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি বিভাগে পঠিত কোর্সের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ বিষয়ক একটি কোর্সও অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।
সরকার জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। দেশব্যাপী জঙ্গি দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি র‌্যাব একটি মোবাইল অ্যাপ ‘রিপোর্ট ২ র‌্যাব’ চালু করেছে যা তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় গোপন রেখে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। মসজিদগুলোকে জুমার নামাজে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে খুতবা পাঠে অনুরোধ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ মহল থেকে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ও শিক্ষাব্যবস্থাকে একমুখী করার দাবি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে বলতে চাই, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে কুদরত-ই-খুদা কমিশন বাস্তবায়নে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। ভালো দিকটি হচ্ছে এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ জঙ্গিবাদের বিপক্ষে। সম্প্রীতির এই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে কোনো দিনই উঠতে পারেনি আর পারবে না বলে বিশ্বাস করি। তবে এক্ষেত্রে সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের মানুষকে সপ্রণোদিত হয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। তাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জঙ্গিবাদের হুমকি এড়িয়ে দেশ এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করি।
ষ লেখক : আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক মন্ত্রী বাণিজ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন