আলী এরশাদ হোসেন আজাদ
দৈহিক-আর্থিক সামর্থ্য এবং স্থান ও সময়গত সামঞ্জস্যতার জন্য বিশ্বজনীন ইবাদত হজ। ‘হজ’ নামে পবিত্র কুরআনে একটি স্বতন্ত্র সুরা রয়েছে। কর্মতৎপরতায় হজ লক্ষ জনতার চলমান মহাসমাবেশ। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের অগণন বনী আদম এখানে সমবেত হন, যাদের পরনের কাপড় এক, কামনা এক, মনে-মুখে ধ্বনিত হয় একই ভাষার একই উচ্চারণÑ“লাব্বাইক! আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! (উপস্থিত! হে প্রভু আমি উপস্থিত!!) আরাফাত, মুজ্দালিফা, মিনা প্রভৃতি স্থানে যথা সময়ে সুশৃঙ্খল কর্ম সম্পাদনের এক মহা প্রশিক্ষণ হজ।
হজের ফরজ তিনটি। যথাÑ ইহরাম বাঁধা, তাওয়াফ এ জিয়ারত এবং আরাফাতের ময়দানে উপস্থিতি। এ ফরজগুলোর একটিও ছুটে গেলে হজ নষ্ট হয়ে যাবে এবং পরবর্তী সময়ে তা কাযা করাও ফরজ। তাই যথাযথভাবে হজের ফরজগুলো সুসম্পন্ন করবার সার্বিক প্রস্তুতি জরুরি।
হজ একটি পুণ্যময় ইবাদত। যা ত্রুটি মুক্তভাবে সম্পন্ন করতে সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া একান্ত জরুরি। কেননা, প্রিয়নবী (স.) বলেন, “কবুল হজের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়” (বুখারি)। কাজেই, মহান আল্লাহ্র ঘরের মেহমান হাজি সাহেবানকে নিচের বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ যতœবান হতে হবেÑ ১. হজের উদ্দেশ্য হবে একমাত্র মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি। ২. তাওবার মাধ্যমে মানসিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। ৩. আর্থিক প্রস্তুতি হতে হবে পবিত্র ও পাপ মুক্ত। ৪. দৃঢ় মনোবল ও সুস্থ থাকতে হবে। ৫. নিয়ম কানুন দোয়া-কালাম শিখে ও লিখে নিতে হবে, ‘ক্ষুদ্র পুস্তিকা’ সঙ্গে রাখতে হবে। ৬. নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী হালকা ও পরিমিত পরিমাণ হওয়া। ৭. রোগকে অবহেলা ও আড়াল না করা। ৮. নিজে ও সব কিছু হারালেও মনোবল না হারানো। ৯. শরীর, সময় ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ইবাদত করা। ১০. হজের ফরজ ও ওয়াজিব পালনে বিশেষ যতœবান হওয়া। ১১. ঝধভঃু ভরৎংঃ এবং অন্যের সুবিধা বিবেচনায় রাখা। ১২. অন্যকে কষ্ট না দেওয়া কেননা, তা হারাম। ১৩. ইহরাম না বেঁধে ‘মিকাত’ বা সীমা অতিক্রম না করা। ১৪. হাজরে আসওয়াদ চুম্বনে ভিড়, ধৈর্যচ্যুতি ও ধাক্কাধাক্কি পরিহার করা। এবং ১৫. আরাফাতের সীমানার বাইরে না থেকে গ-ির মধ্যে অবশ্যই সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা।
মহান আল্লাহ্র ঘরের মেহমানগণের সৌভাগ্য যে, তাঁরা মক্কা মদিনার পবিত্র স্থানগুলো দেখার সুযোগ পাবেন। এ প্রসঙ্গে কিছুটা আলোকপাত করবো। মক্কা মদিনায় দর্শনীয় পবিত্র স্থানগুলো প্রিয়নবীর (স.) স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আজো সুসংরক্ষিত এবং তাঁর (স.) চলমান মু’জিজা। যেমন মসজিদুল হারামের আনুমানিক ৫০ মিটার দূরে ‘সুক-আল-লাইল্’ মহল্লার ‘আব্দুল মুত্তালিবে’র বাড়ি যেখানে দু’জাহানের বাদশাহ্ জন্ম গ্রহণ করেছিলেনÑ তা একটি দর্শনীয় স্থান।
‘হালিমা সা’দিয়ার (রা.) বাড়ি’ বনু সা’আদ গোত্রের একটি সাধারণ বাড়ি ও এর কাছের একটি কূপ প্রিয়নবীর (স.) স্মৃতিধন্য। কেননা, সেখানে দুধবোন সায়মার সেবায় তাঁর কেটে ছিল ছয়টি বছর। হালিমা সা’দিয়ার (রা.) সৌভাগ্য যে তিনি বিশ্বনবীকে (স.) স্তন্নদান করেছিলেন। আর ‘রাহ্মাতুল লিল্ আ’লামিনে’র শুভাগমনে ধূসর ও মৃতপ্রায় খেজুর বাগানে জেগেছিল সবুজের সমারোহ।
মক্কার কাবা ঘরের অদূরে অবস্থিত ‘জাবালে নুর’ যা হেরা পর্বত হিসেবে খ্যাতÑ এখানেই পবিত্র কুরআন নাযিলের শুভ সূচনা হয়। সর্বপ্রথম সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয় এখানেইÑ “পাঠ কর তোমার প্রভুর নামে...” ( আয়াত: ০১)।
পবিত্র মক্কার ৯৫ কি.মি. উল্টর-পূর্বে অবস্থিত ‘তায়েফ প্রান্তর’। নবুওয়াতের দশম বর্ষে প্রিয়নবী (স.) এখানে ইসলাম প্রচারের জন্য এসে লাঞ্ছিত ও রক্তাক্ত অবস্থায়, ওত্বা ইব্নু রাবিয়াহ্র আঙ্গুর বাগানে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
‘জাবালে সওর’ প্রিয়নবীর (স.) হিজরতের স্মৃতি বিজড়িত স্থান। হিজরতের সময় প্রিয়নবী (স.), আবুবকর (রা.) তিন দিন তিন রাত অবস্থান করেছিলেনÑ তাই সওর পাহাড় বা ‘জাবালে সওর’। এখানেই আবুবকর (রা.) প্রিয়নবীর (স.) নিরাপত্তার জন্য সাপের গর্তের মুখে নিজের পা চেপে ধরেছিলেন এবং সাপের দংশনেও অস্থির হন নি বরং শত্রুর পদধ্বনি শুনে অস্থির হয়েছিলেন। তখন প্রিয়নবী (স.) বলেছিলেন, পবিত্র কুরআনের ভাষায় “তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন: বিষণœ হয়ো না, আল্লাহ্ আমাদের সঙ্গেই আছেন...” (তওবা: ৪০)।
প্রিয়নবীর (স.) স্মৃতিবিজড়িত অনেক মসজিদ রয়েছে- মসজিদে কোবা, মসজিদে নব্বী, মসজিদে কিবলাতাইন, মসজিদে জুম’আ, মসজিদে জ্বীন, ইত্যাদি।
মদিনা থেকে তিন মাইল দূরের আলিয়া বা কোবায় প্রিয়নবীকে (স.) স্বাগত জানান আমর ইবনু আউফ গোত্রের প্রধান কুলসুম ইবনু হাদাম (রা.)। মদিনায় প্রবেশের আগে প্রিয়নবী (স.) এখানে চৌদ্দ দিন অবস্থান করেছিলেন। এখানে প্রিয়নবী (স.) একটি মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। এই ‘মসজিদে কোবা’ হলো প্রিয়নবীর (স.) তৈরি প্রথম মসজিদ। এই মসজিদের প্রশংসায় মহান আল্লাহ্ বলেন “যে মসজিদের ভিত্তি রাখা হয়েছে তাকওয়ার (ধর্মভীরুতা) ওপর...”(তওবা: ১০৮)।
‘মসজিদে জুম’আ’ কোবায় দু’সপ্তাহ অবস্থানের পর প্রিয়নবী (স.) মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন, পথিমধ্যে তাঁর উট বনি সালাম গোত্রের এলাকায় থামলোÑ সেখানে প্রিয়নবীর (স.) খুৎবা ও ইমামতিতে সর্বপ্রথম জুম’আর নামায আদায় করা হয়। প্রিয়নবীর (স.) স্মৃতিচিহ্ন এ স্থানেই নির্মিত হয় মসজিদে জুম’আ।
‘মসজিদে নব্বী’ যে মসজিদকে প্রিয়নবী (স.) সব সময় বলতেন ‘আমার মসজিদ’। হিজরতের পর টানা ১০ বছরের অধিকাংশ সময় প্রিয়নবী (স.) এখানেই অবস্থান করেছিলেন। হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর (রা.) বাড়ি সংলগ্ন একটি পড়ো জমির মালিক সহল ও সুহাইল বালকদ্বয়। এখানেই নির্মিত হয় ‘মসজিদে নব্বী’। এ মসজিদটি ছিল ‘রাহমাতুল লিল আ’লামিনে’র আবাসস্থল, প্রশাসনিক কেন্দ্র ও জীবনের সর্বশেষ বিশ্রামস্থলÑ যার সৌন্দর্য ছিল ঈমান, ইনসাফ ও আধ্যাত্মিকতা।
পবিত্র কুরআনে আছে “হে নবী, আপনি নিজের মুখ মসজিদে হারামের (কাবা) দিকে ফেরান...” (বাকারা: ৪৯)। কেননা, তিনি (স.) ২য় হিজরি সালের শাবান মাস পর্যন্ত ‘বায়তুল মুকাদ্দাসে’র দিকে ফিরে নামায আদায় করতেন। আর বিশর বিন বারার (রা.) আমন্ত্রণে বনী সালমায় পৌঁছলে প্রিয়নবীর (স.) ইমামতিতে নামাযরত অবস্থায় ‘কিবলা পরিবর্তনে’র নির্দেশ নাযিল হয়। একারণে একই নামাযে প্রিয়নবী (স.) ও সাহাবিগণ প্রথম দু’রাকাআত বায়তুল মুকাদ্দাস ও শেষ দু’রাকাআত কাবা ঘরের দিকে ফিরে আদায় করেছিলেন। প্রিয়নবীর (স.) স্মৃতিধন্য এ মসজিদকে দু’কিবলা বিশিষ্ট মসজিদ বা ‘মসজিদে কিবলাতাইন’ বলে।
‘মসজিদে জ্বীন’ এখানেই জ্বীনরা প্রিয়নবীর (স.) কণ্ঠে পবিত্র কুরআন শুনে, ঈমান আনে। মদিনায় বৃষ্টির জন্য ‘ইস্তেস্কা’ আদায় করবার কারণে প্রিয়নবীর (স.) স্মৃতিধন্য ঐতিহাসিক মসজিদের নাম ‘মসজিদে গিমামাহ্ (গামামাহ্)’।
প্রিয়নবীর (স.) শ্রেষ্ঠতম স্মৃতিচিহ্ন তাঁর ‘রওজাতুল আতহার’ বা ‘পবিত্র সমাধি’। উম্মতে মুহাম্মদীর সর্বকালীন সর্বাত্মক ঐক্যমত হলো ‘বায়তুল্লাহ’্র পর দুনিয়ার বুকে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ স্থান হলো ‘রওজাতুল আতহার’ বা ‘পবিত্র সমাধি’। ভক্তিবাদী মানুষের আকাক্সক্ষায় থাকে জীবনে একটিবারের জন্য হলেও যেন ‘রওজা শরিফ’ জিয়ারতে বলতে পারেন: ‘আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ’্। কারণ, প্রিয়নবী (স.) নিজে বলেছেন “যে আমার কবর জিয়ারত করবে তার জন্য শাফাআ’ত করা আমার কর্তব্য হয়ে যায়”।
পরিশেষে মুনাজাত, মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে মক্কা মদিনার পবিত্র দর্শনীয় স্থান জীবনে একবার হলেও দেখবার তাওফিক দান করুন। মহান আল্লাহ্ হাজী সাহেবানকে নিরাপদ ও সুস্থ রাখুন সবাইকে হজ করবার সামর্থ্য ও সদিচ্ছা দান করুন । আমিন।
ষ লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন