মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

আরব রিভল্টের শত বছর এবং হারিয়ে যাওয়া শিশুরা

প্রকাশের সময় : ২৪ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী

ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোর সা¤্রাজ্যবাদী প্রতিযোগিতা থেকেই প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সংঘটিত হলেও এসব যুদ্ধে মূলত বহুধাবিভক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলমানরা। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে শুরু হওয়া মুসলমানদের বিশ্ববিজয়ের সর্বশেষ কেন্দ্রীয় শক্তি ওসমানীয় সা¤্রাজ্যকে ভেঙে দুর্বল করা এবং এর বিভিন্ন ভগ্নাংশকে বৃটিশ, ফরাসি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এসব মহাযুদ্ধ শেষ হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে আরব মুসলমানদের ভাগ্য নির্ধারণে ১৯১৬ সালের আরব বিদ্রোহ অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। উসমানীয় খেলাফতের মাধ্যমে আরব মুসলমানদের শত শত বছরের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঐক্যসূত্র ভেঙে দিতে প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের মধ্যে আরব জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করা এবং তুর্কি তরুণদের (ইয়ং তুর্ক) পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তোলার কাজটি বেশ সাফল্যের সাথেই সংঘটিত করা হয়েছিল। এই কাজের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে তৎকালীন বৃটিশ সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা লরেন্স অব আরাবিয়া নামে খ্যাত টি.ই. (টমাস এডওয়ার্ড) লরেন্স বৃটিশ সামরিক সাফল্যের ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়ে রেখে গেছেন। আরব জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে অটোমান শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তুলতে টিই লরেন্স সৌদি আরবের প্রভাবশালী গোত্রপতিদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলার মাধ্যমে তাদের সম্ভাব্য আরব বিদ্রোহী করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। হেজাজ রেলওয়েতে নাশকতা সৃষ্টি এবং তুর্কি সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটিগুলোকে ধ্বংস করে অটোমান আর্মির পতন নিশ্চিত করতে বৃটিশ সেনাবাহিনীর এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা অসাধ্য সাধন করেছিলেন। শত শত বছরে গড়ে ওঠা বিশাল অটোমান সা¤্রাজ্য থেকে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, জর্ডান, লেবানন, প্যালেস্টাইন, সিরিয়াকে, ইয়েমেন, তিউনিশিয়া ও মিসরকে আলাদা করে নিজেদের অনুগত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ প্রথম ইউনিপোলার পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের সূচনা করেছিল। শত শত ট্যাংক, হাজার হাজার সৈনিকের জীবনের বিনিময়েও যা সম্ভব ছিল না ঐতিহ্যবাহী আরব বেশধারী একজন টি. ই. লরেন্স সেই অসাধ্য কাজটি করতে সক্ষম হন। সামরিক বিজয় ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের বিস্তারে শক্তিশালী ও উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী, সামরিক প্রযুক্তি যুদ্ধবিমান, যুদ্ধাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্রের ক্রমবর্ধমান উন্নতির পাশাপাশি সামরিক গোয়েন্দাবৃত্তি সামরিক ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সাফল্যের পথকে সহজ করেছে। প্রথম মহাযুদ্ধে আরব রিভল্টের (১৯১৬-১৮) মধ্য দিয়ে অটোমান তুর্কিদের পতন, মুসলমানদের বহুধাবিভক্তি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তুরস্কসহ অক্ষশক্তির পতনের মধ্য দিয়ে যে বিশ্বব্যবস্থা বা পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদ গড়ে তোলা হয়েছিল তা মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে মহাযুদ্ধের বিষাক্ত বাই-প্রোডাক্ট, অরাজনৈতিক ও অনৈতিক পন্থায় গড়ে তোলা ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটিকে মেনে নেয়া কোনো মুসলমান জনগোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। গত ৬৮ বছরেও ইসরাইল রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভে ব্যর্থ হওয়ায় ইসরাইল এবং পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা মধ্যপ্রাচ্যে সর্বদা একটি অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিবেশ জিইয়ে রেখেছে। ১৯১৬ সালে যেমন আরব রিভল্টকে পুঁজি করে মুসলমানদের একতা শক্তি-সামর্থ্যকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল, একশ বছর পেরিয়ে এসে ২০১৬ সালেও আরব রিভল্টের সেই বাস্তবতাকেই পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে।
আর্কিওলজিস্টের ছদ্মাবরণে কাজ করা একজন বৃটিশ সামরিক গোয়েন্দা টি. ই. লরেন্স বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদের জন্য যে সাফল্য নিয়ে এসেছিলেন সে সময় পুরো বৃটিশ সামরিক শক্তি দিয়েও তা অর্জন করা সম্ভব ছিল না। অতএব কভার্ট (গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম) অপারেশন সরাসরি সামরিক অপারেশনের চেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এই উপলব্ধি থেকেই গত একশ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের বদলে কভার্ট অপারেশনের ওপর জোর দিচ্ছে পশ্চিমারা। বর্তমানে পশ্চিমা কভার্ট অপারেশন মুসলমানদের বিরুদ্ধে দু’ধারি তলোয়ারের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। একদিকে এই কার্যক্রম মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ বিভক্তি সৃষ্টি করার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখা সম্ভব হচ্ছে। অন্যদিকে শান্তির ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা সমাজে এক ধরনের ভীতি ও ঘৃণার জন্ম দেয়া হচ্ছে, অ্যাকাডেমিসিয়ানরা যাকে ইসলামোফোবিয়া বলে আখ্যায়িত করছেন। আফগান মুজাহিদীন, আল-কায়েদা সৃষ্টি এবং শক্তিশালী করে তোলার পেছনে যেমন মার্কিনিদের অভিন্ন শত্রু সোভিয়েত কমিউনিস্ট লাল ফৌজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার স্বার্থ ছিল, একইভাবে সিরিয়া, লিবিয়ায় রিজিমবিরোধী বিদ্রোহী বাহিনী সৃষ্টি এবং আইএসের মতো একটি বেপরোয়া ও নিষ্ঠুর বাহিনী গড়ে তোলার পেছনেও সরাসরি পশ্চিমা ও ইসরাইলি স্বার্থ নিহিত আছে। মার্কিনি রাজনীতিকদের অনেকে আইএস সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক ব্লেম-গেম হিসেবে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের দায়ী করলেও (জর্জ বুশ, ক্লিনটন এবং বারাক ওবামা) এসব রাজনৈতিক বক্তব্যের বাইরে এখন থলের বিড়ালের মতো প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের আজকের বাস্তবতার জন্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মূল হোতা জর্জবুশ কোনো রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন না হলেও চিরদিন তিনি ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য থাকবেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের অন্যতম পরামর্শক রজার স্টোন আইএস সৃষ্টির জন্য ডেমোক্রেটদের দায়ী করবেন, এটা জানা কথা। সম্প্রতি আইসিএইচ ব্লগে প্রকাশিত রজার স্টোনের একটি নিবন্ধের শিরোনামÑ ‘হাউ উই নো আইসিস ওয়াজ মেইড ইন দি ইউএসএ’। এই নিবন্ধে রজার স্টোন আইএস সৃষ্টির পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের বশংবদ সরকারগুলোর ভূমিকার কিছু প্রামাণ্য তথ্য তুলে ধরেছেন। সেখানে মার্কিন জুডিশিয়াল ওয়াচের আইনানুগ চাহিদাপত্রের ভিত্তিতে ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (ডিআইএ) রিপোর্টের একটি অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, “দ্য ওয়েস্ট, গাল্ফ কান্ট্রিজ, এন্ড তার্কি(হু) সাপোর্ট দ্য (সিরিয়ান) অপজিশন...(সাপোর্ট) এস্টাবলিশিং ডিক্লেয়ার্ড অর আনডিক্লেয়ার্ড সালাফিস্ট প্রিন্সিপালিটি ইন ইস্টার্ন সিরিয়া...ইন অর্ডার টু আইসোলেট সিরিয়ান রিজিম...” স্টোনের মতে, এই রিপোর্টের সত্যতা আরো স্পষ্ট হয়ে যায় জাতিসংঘে রাশিয়ার দেয়া ৫০ পৃষ্ঠায় একটি ডসিয়ারে, যেখানে পশ্চিমাদের প্লান ‘বি’র আওতায় ডিআইএ কর্তৃক আইসিস সৃষ্টির বিবরণ দেয়া হয়েছে। আইএস সৃষ্টি ও পরিচালনায় পশ্চিমাদের ভূমিকা নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যমের নীরবতার প্রসঙ্গ টেনে মি. স্টোন ইরানের ইন্ডিপেনডেন্ট ফার্স নিউজ এবং প্রেস টিভিতে প্রচারিত ২০১৫ সালের কয়েকটি রিপোর্ট তুলে ধরেছেন। সেখানে * ২৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, ইরাকি সেনাবাহিনী দুটি বৃটিশ কার্গো বিমান ভূমিতে নামিয়ে আনার পর দেখা যায়, এসব বিমান অত্যাধুনিক অস্ত্র বোঝাই ছিল যা আইএসের জন্য সরবরাহ করছিল। * ১লা মার্চ ফার্স নিউজে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ইরাকের পপুলার মিলিশিয়া বাহিনী আল হাশাত আল শাবির যোদ্ধাদের গুলিতে ভূপাতিত একটি মার্কিন হেলিকপ্টার আনবার প্রদেশে আইএসআইএলের জন্য অস্ত্র বহন করছিল। * ১০ এপ্রিল প্রেস টিভিতে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়া যখন আইএসআইএলকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছিল, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্সসহ তাদের সহযোগীরা তা নাকচ করে দিয়েছিল। * ১৯ মে লেভান্টরিপোর্টডটকম নামের একটি সংস্থার প্রতিবেদক ব্রাড হুফ ২০১২ সালের একটি ডিআইএ রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘ওয়েস্ট উইল ফেসিলিটেট রাইজ অব ইসলামিক স্টেট, ইন অর্ডার টু আইসোলেইট দ্য সিরিয়ান রিজিম’। ২২ জুন সাবেক সিআইএ কন্ট্রাক্টর স্টিভেন কেলি লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের স্বার্থে আইসিস সৃষ্টি করেছে, মধ্যপ্রাচ্যে অন্তহীন যুদ্ধ (নেভার এন্ডিং ওয়ার) জিইয়ে রাখাই এর উদ্দেশ্য। রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর জন ম্যাককেইনের সাথে আইসিসের স্বঘোষিত খলিফা আবুবকর আল বাগদাদির ছবি মার্কিন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। রজার স্টোন লিখেছেন, ওয়াশিংটনে অনেকেই আইএসকে ‘ম্যাককেইনস আর্মি’ নামে চেনেন। আইএস যে আমেরিকার সৃষ্টি তার ১০টি প্রমাণ উদ্ধৃত করে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন মার্কিন লেখক প্রফেসর জিম ফ্রেজার। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি গানশট ও হত্যাকা-ের ঘটনায় আইএসের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়েছে। তবে সাবেক মার্কিন উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তা ডেভিড স্টিলি সম্প্রতি একটি বোমা ফাটানো তথ্য ফাঁস করেছেন, তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিটি টেররিস্ট অ্যাটাকই ছিল মার্কিন গোয়েন্দা তৎপরতার অংশ বা ফল্স ফ্লাগ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘জার্মানি পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে’ এমন অজুহাত সামনে রেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ম্যানহাটান প্রকল্পের আওতায় তড়িঘড়ি পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছিল এবং পার্ল হার্বারে বোমা হামলার প্রতিশোধ হিসেবে তা জাপানের ওপর প্রয়োগ করেছিল। প্রায় প্রতিটি যুদ্ধ অথবা সামরিক আগ্রাসন শুরুর আগেই পশ্চিমারা এক ধরনের মিথ্যা জুজুর ভয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। সত্যিকার অর্থে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে তেমন কোনো হুমকি না থাকলেও আগ্রাসনকে জায়েজ করতে ফলস ফ্লাগ অপারেশনের মাধ্যমে নিজেরাই তা সৃষ্টি করেছে। হিটলার, স্টালিন থেকে শুরু করে বর্তমানের ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ এই নীতি নিয়েই এগিয়ে চলেছে। কয়েক বছর ধরে ইরান এবং রাশিয়ার কথিত পারমাণবিক হামলার আশঙ্কার ধুয়া তুলে ইসরাইলসহ ইউরোপের দেশগুলোতে এন্টি মিসাইল ডিফেন্স ব্যাটারি স্থাপন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হাজার হাজার কোটি ডলারের সমরাস্ত্র এবং কৌশলগত সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার চুক্তি করেছে। ইরানের সাথে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে মূলত ইউক্রেন সংকটকে সামনে রেখে অব্যাহত রাশিয়ান সামরিক হামলার আশঙ্কা, অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সমরশক্তি বৃদ্ধির অজুহাত তুলে এক ধরনের রণপ্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি একটি মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাশিয়ানরা তাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে পারমাণবিক হামলা মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে ভূ-গর্ভস্থ বাঙ্কার তৈরি করছে। এমনকি রাশিয়া উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বায়োনিক সোলজার তৈরি করছে বলেও তারা অভিযোগ তোলছে। তবে রাশিয়ানদের পক্ষে পাল্টা জবাব দিয়ে বলা হয়েছে, মূলত মার্কিনিরাই নিজেদের অনৈতিক সামরিক প্রকল্পকে মার্কিন জনগণের কাছে জায়েজ করতে এ ধরনের অভিযোগ ও জুজু দেখাচ্ছে। ইরাকের হাতে ডব্লিউএমডি (ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন) থাকার মিথ্যা গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে ইরাক আক্রমণ ও দখলের মধ্য দিয়ে ইরাকের কোটি কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু করার পর প্রমাণিত হয়েছে যে, মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্টটি ছিল ভুয়া। আফগানিস্তান ও ইরাকে ন্যাটো বাহিনীর ১২ বছরের যুদ্ধে হাজার হাজার পশ্চিমা সেনা নিহত হলেও সেখানে তারা সামরিক বা রাজনৈতিক বিজয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কথিত আইএসবিরোধী সামরিক তৎপরতাও নানাভাবে ব্যর্থ ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষত সিরিয়ায় রাশিয়ান সামরিক হস্তক্ষেপের অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আইএসের প্রভাব দ্রুত কমে আসার বাস্তবতায় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনিদের সামরিক তৎপরতা ও সুপিরিয়রিটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই সিরিয়ায় ছত্রিসেনা নামানোর ঝুঁকি নিচ্ছে না মার্কিনিরা। এখন নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য তারা সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন স্বয়ংসম্পূর্ণ ও শক্তিশালী বায়োনিক বা রোবটিক সেনা নামানোর পরিকল্পনা করছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আকাশে মনুষ্যবিহীন ড্রোন উড়িয়ে বেশ সাফল্য পেয়েছে মার্কিনিরা এবার নিজেদের মার্সেনারি বাহিনীর পাশাপাশি রোবটিক সোলজার নামিয়ে নতুনভাবে ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
আইএস নামের মুখোশধারী জঙ্গিরা কলেমাখচিত কালো পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে আল্লাহু আকবার বলে নিরস্ত্র যুবক, শিশুদের গলায় ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে। এমন ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে মূলত ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ও ভীতি ছড়ানো হচ্ছে। আমরা আইএস সৃষ্টি এবং আবুবকর আল বাগদাদির ইতিহাস জানি, কিন্তু যারা প্রকাশ্য দিবালোকে গলায় ছুরি চালিয়ে মানুষ হত্যা করছে তারা কারা? তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লক্ষ্য নেই। যারা প্যারিসে, লন্ডনে ও আমেরিকায় নাশকতা বা আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে প্রাণ দিচ্ছে তাদের অনেকেরই প্রকৃত পরিচয় কেউ জানতে পারছে না। মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা স্টিভেন স্টিলির তথ্য অনুসারে এসব যদি ফল্স ফ্লাগ অপারেশন হয়, তাহলে এসব হামলা বা গানশটের ঘটনায় নিহত সন্দেহভাজনদের যে পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে তাও হয়তো মিথ্যার আবরণে মোড়া। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ফলে বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠা কোটি কোটি মানুষের একটি অংশকে ধর্মের নামে, রাষ্ট্রের নামে বিভ্রান্ত ও প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলা খুবই সহজ। ১৯১৬ সালের আরব রিভল্ট থেকে শুরু করে আজকের মধ্যপ্রাচ্যে সিআইএ, মোসাদসহ পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শত শত কোটি ডলার ব্যয় করে মুসলমান তরুণদেরকে প্রকারান্তরে ইসলাম ও মুসলিম ঐক্যের বিরুদ্ধে কাজে লাগাচ্ছে। পশ্চিমারা কৈয়ের তেলে কৈ ভেজে খাচ্ছে। প্রথমত. ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে পশ্চিমা সমাজে ইসলাম ও মুসলমানদের অগ্রযাত্রা রোখার চেষ্টা করছে, দ্বিতীয়ত. বিদ্রোহী এবং আইএসের অধিকৃত তেলক্ষেত্রগুলো থেকে কম দামে জ্বালানি তেল কিনে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যে ধস নামানো হয়েছে, তৃতীয়ত. উদ্বাস্তু ও পলায়নপর অভিবাসীদেরকে নানা ধরনের ম্যানিপুলেশন এবং কমমূল্যের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করছে। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে, এদের মধ্যে অনেক শিশু ও নারী আছে। গত বছর আল জাজিরায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইউরোপে লাখ লাখ অভিবাসন প্রত্যাশী মুসলমানদের অন্তত ১০ হাজার শিশুর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এসব মিসিং শিশুর গন্তব্য ও ভাগ্য সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারছে না। এসব শিশুর একটি অংশ যদি পশ্চিমা সামরিক ল্যাবরেটরিতে চলে যায় এবং আগামী দশকে একেকজন ভয়ঙ্কর মার্সেনারি বায়োনিক সোলজার হিসেবে বেরিয়ে আসে, তা কি অবিশ্বাস্য বিষয় হবে? স্বল্প সময়ের মাইন্ড অল্টারিং মোটিভেশন এবং শক্তিশালী নারকোটিক ড্রাগ ব্যবহার করেই যেখানে ভদ্র ঘরের শান্তশিষ্ট তরুণদের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কর্মকা-ে ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে একটি শিশুকে বিশেষ সামরিক গবেষণাগারে বছরের পর বছর ধরে মেন্টাল, হরমোনাল এবং প্রোস্থেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবে পরিণত করা অসম্ভব নয়। মধ্যপ্রাচ্যে একই সময়ে হাজার শিশু নিখোঁজ হওয়ার উদাহরণ এবারই প্রথম নয়। এর আগে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সময় মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে আগত ইহুদি অভিবাসীদের কাছ থেকে হাজার হাজার শিশুকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। এসব শিশুর অধিকাংশেরই পরবর্তীতে কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। ইসরাইলি সাংবাদিক জোনাথন কুক এই ঘটনাকে ইসরাইলের ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায় বলে অভিহিত করেছেন। এই গোপন ইতিহাস সম্পর্কে ইসরাইল সরকার সব সময়ই নীরবতা ও অস্বচ্ছতার আশ্রয় নিয়েছে। গত মাসে এ সম্পর্কে প্রথমবারের মতো কোনো ইসরাইলি মন্ত্রীর মন্তব্য শোনা গেছে। ইসরাইলি জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী জাসি হানেগবি সে সময় হাজার হাজার শিশুর নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করার পাশাপাশি বলেছেন সেসব শিশুর ভাগ্যে কী ঘটেছিল আমরা হয়তো কখনো তা জানতে পারব না। মরক্কো, তিউনিসিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দেখতে আরবদের মতো শিশুরাই জায়নবাদী ইসরাইল সরকারের হাতে ক্লান্ডেস্টাইন এডোপশনের শিকার হয়েছিল। মরুভূমির গভীরের বাঙ্কারে গড়ে তোলা ইসরাইলের গোপন পারমাণবিক প্রকল্পের মতো সেসব শিশুরাও কি জেনেটিক অথবা বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা সাইবর্গ ওয়ারিয়র হিসেবে গবেষণাগারে চলে গেছে? নানা রকম সন্দেহ থাকলেও এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করা আপাতত সম্ভব নয়।
bari_zamal@yahoo.com

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন