শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জনশক্তি রফতানি ও বিনিয়োগের বাধা দূর করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৪ এএম

দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম চালিকা শক্তি বৈদেশিক কর্মসংস্থানে দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা কাটছেই না। এখন করোনাকালীন বিশ্ববাস্তবতায় সারাবিশ্বেই অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সঙ্কুচিত ও সীমিত হয়ে পড়লেও আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রধান বাজারগুলোতে প্রায় এক দশক ধরেই স্থবিরতা ও অচলাবস্থা বিরাজ করছে। সউদী আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত আমাদের জনশক্তি রফতানির প্রধান বাজার। এ দু’ দেশে এখনো অন্তত ত্রিশলাখ বাংলাদেশি কাজ করছে। বাহ্যত সরকারি নীতিমালা ও আকামা জটিলতার কারণে সউদী আরবে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন জনশক্তি রফতানি সম্ভব না হলেও সেখানে বিদ্যমান জনশক্তির মাধ্যমে সীমিত আকারে বছরে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ধারা অব্যাহত ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে তাও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উপর ভিত্তি করে রেমিটেন্স প্রবাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে বড় ধরনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সউদী ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায়ও দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ সীমিত রয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে এ ক্ষেত্রে বাস্তব অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। মালয়েশিয়া এবং জিসিসিভুক্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির দৃশ্যমান কোনো কারণ নেই।

করোনাকালীন স্থবিরতা কাটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এখন নতুন উদ্যমে উন্নয়ন কর্মকান্ড শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাস নেগেটিভ সার্টিফিকেটের বাধ্যবাধকতার শর্তে বিদেশি শ্রমিকরা পুনরায় কাজে যোগ দিচ্ছে এবং নতুন জনশক্তি নিয়োগের প্রক্রিয়াও অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর অন্যতম অংশীদার এবং জনশক্তির ট্রাডিশনাল সোর্স হিসেবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বাজার খুলে যাওয়ার কথা থাকলেও আদতে তা হয়নি। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার তথ্য দেয়া হয়েছে। করোনাকালীন বিশেষ বাস্তবতায় সেন্ডিং কান্ট্রিগুলো থেকে ভিজিট ভিসায় সংযুক্ত আরব আমিরাত গিয়ে ওয়ার্ক পারমিট গ্রহণের সুযোগ দেয়া হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বাংলাদেশি শ্রমিকরা এই সুযোগ পাচ্ছে না বলে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে। সরকারি নীতিমালা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ভিজিট ভিসায় দুবাই-আবুধাবি যেতে একেকজন যাত্রীকে বিমানবন্দরে ৪০-৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে বলে জানা যায়। করোনাকালীন বাস্তবতায় বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতের প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে দরিদ্র শ্রমিকদের এ ধরনের অনৈতিক-অযৌক্তিক ব্যয় বহন করতে বাধ্য করার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখতে হবে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানে অতিরিক্ত ব্যয়ভার বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বাড়তি চাপসহ শারীরিক ও মনস্তাত্তিক সংকট সৃষ্টি করছে। মালয়েশিয়া জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচকে অন্যতম আপত্তিকর প্রতিবন্ধক হিসেবে গণ্য করেছে সে দেশের সরকার।

মুসলিম উম্মাহর অন্যতম সদস্য হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেও সউদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ার মতো দেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের আধিপত্য অব্যাহত থাকার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশের শ্রমিকরা নির্ঝঞ্জাটভাবে নিয়োগ পেলেও বাংলাদেশি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা ও অস্বভাবিক কালক্ষেপণের আশ্রয় গ্রহণ করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ ভারতকে বিশ্বের শীর্ষ রেমিটেন্স আয়ের দেশে পরিণত করেছে। এ সুযোগ অব্যাহত রাখতে ভারতীয় মন্ত্রী ও কূটনীতিকরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সব সময় সক্রিয় তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে তারা খুবই সফল। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং বিদেশ মিশনগুলো এ ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সম্প্রতি সউদী আরব ভারতে বড় ধরনের বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। একইভাবে পাকিস্তানের সাথে কিছু টানাপোড়েন দেখা দেয়ার পরও তারা সম্পর্কোন্নয়নে দৃঢ় সঙ্কল্পের কথা প্রকাশ করেছে। বিশেষত তুরস্ক ও ইরানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কন্নোয়নের প্রেক্ষাপটে সউদী-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতি দেখা দিলেও অবশেষে তারা তা কাটিয়ে উঠতে সম্মত হয়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। আগামী জানুয়ারি মাসে সউদী পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফায়সাল বিন ফারহান আল সৌদের বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সউদী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফরকে কাজে লাগাতে পারলে জনশক্তি রফতানিসহ সউদী বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা উন্মুক্ত হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলোকে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক হোমওয়ার্কসহ যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। কোনো আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা যেন মধ্যপ্রাচ্যের জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সুসর্ম্পককে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সউদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মালয়েশিয়ায় দক্ষ জনশক্তি রফতানির সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি ও সম্ভাবনা সৃষ্টির বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন