শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা আদৌ বন্ধ হবে কি?

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

বাংলাদেশ ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র। এটা দুই দেশের নেতারাই বলে থাকেন। অথচ এই দুই দেশের মধ্যেই লেগে আছে সীমান্ত হত্যা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, এই সীমান্ত হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী কে? কোন্ দেশ?

এই হত্যাকান্ডের জন্য মূলত দায়ী ভারত। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর হাতেই বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ দিতে বাধ্য হচ্ছে। অবশ্য ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর হাতে নিরীহ-নিরস্ত্র বাংলাদেশি জনগণের বিপন্ন ও নিহত হবার পর প্রতিবারই দুই বন্ধু দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক হয়। প্রতিবারই ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়, এরপর আর এ ধরনের কোন দুঃখজনক ঘটনা ঘটবে না। এমনও বলা হয়, এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা পরবর্তীকালে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে।

কিন্তু তারপরও ভারতীয় পক্ষ থেকে ওয়াদা রাখা হয়নি। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী জনগণ ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর সদস্যদের হাতে চরম নিগৃহীত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে ভারতের সীমান্ত বাহিনীর আগ্রাসী কর্মকান্ডের কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়নি।

এই নীরবতার জন্য যুক্তি দেয়া হয়েছে যে, একাত্তরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্ব বঙ্গবাসীর নিরাপত্তার জন্য ভারতীয় বাহিনীর যে ত্যাগ তার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বাংলাদেশ ভারতের সীমান্ত বাহিনীর বাড়াবাড়িকে বড় করে দেখতে চায় না। অথচ প্রকৃত অবস্থা কী ছিল? প্রকৃত অবস্থা তো এই ছিল যে, একটা শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রকে (পাকিস্তান) ভেঙ্গে দুটি দুর্বল রাষ্ট্র করাই ছিল ভারতের মূল লক্ষ্য। তার প্রমাণ পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতীয় বাহিনীর কিছু অংশ বাংলাদেশের ভূখন্ডে রেখে দেয়ার ঘটনা থেকে।

বহু উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারতের নেতৃবৃন্দ দুই দেশকে বন্ধু দেশ বলে উল্লেখ করেছেন এবং সাধারণত প্রকাশ্যে এর বিপরীত কোনো কথা বলেননি। কিন্তু ভারত যে কোনদিন বাংলাদেশকে একটি মুসলিম প্রধান দেশ হিসাবে দেখতে চায়নি তার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। এর প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপরই ১৯৭২ সালে লাহোর আয়োজিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর যোগদানে ভারতের অসন্তুষ্ট হওয়া থেকে।

একটি স্বাধীন মুসলিম দেশ হিসাবে বাংলাদেশও ওই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়। কিন্তু ভারত এ সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদানের তীব্র বিরোধিতার করে। বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত ভারতের এ ভূমিকায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। ফলে তিনি তার অন্যতম মুরব্বী মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পরামর্শ কামনা করেন। মওলানা তার উদ্দেশ্যে সোজাসুজি কিছু না বলে একটু ঘুরিয়ে বলেন, তুমি যদি একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের নেতা হয়ে থাকো তবে তোমার মনে যা চায় তা করো। আর যদি তুমি ভারতের অজ্ঞাবহ নেতা হয়ে থাকো তাহলে ভারত যা চায় তাই করো। মওলানা ভাসানীর এ জবাব শুনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার প্রকৃত জবাব পেয়ে যান। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি সম্মেলনে যোগ দেবেন। যে দিন তিনি মুসলিম সম্মেলনে যোগ দিতে লাহোরে যান, সেদিন নয়াদিল্লীতে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়, যদিও তখন ভারতের অনেক শহরে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ করার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রচার চালানো হচ্ছিল।

পাঠক মহল এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরে থাকবেন, একটি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে দেখতে ভারত কতটা অপছন্দ করে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের জনগণের নিগ্রহ ও হত্যাকান্ডের শিকার হওয়াকে কি অস্বাভাবিক মনে হয়? এই প্রেক্ষাপটে গত সোমবার দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রধান সংবাদ-প্রতিবেদনের বিষয় বিশেষ গুরুত্ব সহকারে উল্লেখের দাবি রাখে। এই প্রতিবেদনের প্রধান শিরোনাম ছিল: ‘সীমান্ত হত্যা চলছেই’। উপ-শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ ভারতের বন্ধুত্ব শুধু কাগজে কলমে’। প্রতিবেদনে যা বলা হয়, তাঁর উল্লেখ করে আজকের লেখার ইতি টানছি। প্রতিবেদনে বলা হয়: বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী ভারতের মধ্যেকার বন্ধুত্বের সম্পর্কে চলছে এখন বসন্তকাল। প্রায় এক যুগ ধরে দাবি করা হচ্ছে, দুই দেশের নাগরিক সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় চলছে। কেউ কেউ দাবি করে আসছেন, দুই দেশের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক, রাখি বন্ধনের সম্পর্ক। বন্ধুত্বপূর্ণ নতুন উচ্চতার সম্পর্কের মধ্যে আমাদের সীমান্তকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সীমান্তে রূপ দিয়েছে ভারত। সোনালি সম্পর্কের পরও বন্ধ হচ্ছে না সীমান্ত হত্যা। একদিকে কাঁটাতারের বেড়া অন্যদিকে হত্যাকান্ড। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রূহুল আমীন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সীমান্ত হত্যার পেছনেও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সন্দেহ রয়েছে। ভারত ছোট দেশকে সবসময় ছোট করেই রাখতে চায়। তাই সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক শুধু কাগজে-কলমে। তাই ভারতের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার। এই সীমান্তের তিন শতাংশে কাঁটাতারের বেড়া। সোনালি বন্ধুত্বকে কাঁটাতারে বিভক্ত করলেও দুই দেশের সীমান্তের এক ইঞ্চিও বাংলাদেশের মানুষদের জন্য নিরাপদ নয়। জমি থেকে ধরে নিয়ে, মাছ ধরা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশিদের বিএসএফ হত্যা করছে। অতঃপর তারা এটাকে চোরাচালান হিসাবে চালিয়ে দিচ্ছে। সীমান্তে একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ। গত এক দশকে ৩ শ’র বেশি বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ। গত ১৭ ডিসেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভার্চ্যুয়াল সংলাপের পর সংবাদ সম্মেলনে করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেছেন: বিএসএফ-এর সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককে কলঙ্কিত করছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তের অবস্থা কার্যত ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরাইলী সীমান্তের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্কে উন্নতি ঘটছে। অথচ তার প্রতিফলন দেখা যায়নি দুই দেশের সীমান্তে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হলেও বাস্তবে পরিবর্তন ঘটেনি। বরং মাঝে কিছুটা কমার পর হত্যাকান্ডের সংখ্যা আবার বেড়ে চলেছে। দুই দেশের সম্পর্ক শুধু কাগজে-কলমে বলে জানিয়েছেন অনেকে। আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্বশীলরা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ভারত সীমান্ত হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা ভঙ্গ করেছে। গত বছর জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, ২০০৯ সালে সীমান্তে নিহত হয়েছিল ৬৬ জন। এরপর ২০১০ সালে ৫৫, ২০১১ সালে ২৪, ২০১২ সালে ২৪, ২০১৩ সালে ১৮, ২০১৪ সালে ২৪, ২০১৫ সালে ৩৮, ২০১৬ সালে ২৫, ২০১৭ সালে ১৭ ও ২০১৮ সালে ৩ জন নিহত হয়েছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে ৪ দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক সীমান্তে হত্যাকান্ডের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন হত্যাকান্ডের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটছে রাত সাড়ে ১০টা থেকে ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যে। এ জন্য বিজিবি-বিএসএফ সীমান্তে যৌথ টহল দেবে।

এরপরও সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা কমছে না। চলতি বছর অন্তত ৪৫ জন বাংলাদেশি বিএসএফ’র হাতে নিহত হয়েছে। ক’দিন আগে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে গৌহাটিতে যে সম্মেলন হয়েছে সেখানেও বিএসএফ প্রধান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অথচ সম্মেলন চলাকালেও দু’ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। প্রশ্ন হলো আদৌ কি সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
আবদুল্লাহ আল মাসুম ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ১:৫৯ এএম says : 0
সরকার পরিবর্তনের পর সব কিছুর হিসেব নেওয়া হবে ইনশাআল্লহ
Total Reply(0)
Rakib Mahmud Mina ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:০০ এএম says : 0
মনে হচ্ছে না।
Total Reply(0)
Abu Hanif ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:০৩ এএম says : 0
এটা বাংলাদেশ সরকার এর দুর্বলতার ফলে হচ্ছে এমন হত্যা, চোরা কারবারি হলেও না মেরে এর একটা ফলপ্রসূ সুরাহা করা যায় যেমন আহত করে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব ।
Total Reply(0)
Johirul Islam Joy ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:০৫ এএম says : 0
ইন্ডিয়ানরা বেইমান কখনো কথা রাখেনি এদেরকে বিশ্বাস করা যায় না
Total Reply(0)
Sheikh Solaiman ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:০৫ এএম says : 0
সীমান্ত হত্যা এক মাসে বন্ধ হয়ে যাবে, তুর্কির সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে তোলো।
Total Reply(0)
Shafiur Rahman ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ৬:১১ পিএম says : 0
It is impossible.There will be more and more killing
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন