বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা জোরদার করতে হবে

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার | প্রকাশের সময় : ৪ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০২ এএম

মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি, কিন্তু মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সবই হচ্ছে আবার কিছুই হচ্ছে না। সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এর প্রবণতা। চলছে ক্রসফায়ার। মানুষ ভাবছে ক্রসফায়ারে কমবে মাদকের কারবার। কিন্তু বাস্তবে তা লক্ষ করা যাচ্ছে না। এতে স্বাভাবিক সময়ের জন্য কিছুটা চুপ থাকছে নিচের দিকের ছোট ছোট মাদক ব্যবসায়ীরা। গড ফাদাররা থাকছে বহাল তবিয়তে। সময় সুযোগ বুঝে সবাই আবার আগের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। নেই স্থায়ী কোনো সমাধান। বিশেষ করে যুব সমাজ নিমজ্জিত হচ্ছে অন্ধকারে। ভেঙ্গে যাচ্ছে দেশের চালিকা শক্তি যুব সমাজের মেরুদন্ড, যার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ ব্যবস্থায় চরম বিশৃংখলা দেখা যাচ্ছে। কুফলের দিক জেনেও এক অদৃশ্য শক্তি বশ করছে এ সমাজকে। প্রতিনিয়তই সুস্থ জীবন থেকে সরে যাচ্ছে বহু তরুণ, কিশোর-কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। দেশে কী পরিমাণ মাদকাসক্ত মানুষ রয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অভিযোগ রয়েছে, যে সব কারাগারে মাদকাসক্তদের সাজা দিয়ে রাখা হয় সেখানেও মাদকের বিস্তার চরমে। মাদকের যে নামটি সবার মুখে মুখে, সেটা হলো ইয়াবা। এটা এত পরিচিত হয়েছে যে অন্যান্য পণ্যের মতোই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট পরিচিতি পাচ্ছে। মাদকের প্রভাব বাড়ার কারণে সমাজ এবং পরিবার দিন দিন হয়ে পড়ছে উদ্বিগ্ন। সুস্থ এবং সুশৃংখল সমাজ নির্মাণ করতে হলে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে যুব সমাজকে। এখন দেখা যাক মাদকটা আসলে কী ? যে সব প্রাকৃতিক বা রাসায়নিক দ্রব্য সেবন বা গ্রহণ করার ফলে মানুষের অনুভূতি অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে এবং মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে তাকেই মূলত আমরা মাদক বলি। হঠাৎ করে মানুষ এ নেশায় আসক্ত হয় না। ধীরে ধীরে মানুষ এসব মাদকের জালে আবদ্ধ হচ্ছে। মাদক এমন একটি নেশা যাতে একবার প্রবেশ করলে পরিত্যাগ করা খুবই কঠিন। মাদক কিভাবে মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে চলে তা সে নিজে জানে না, এমন কি সে নিজে বুঝতে পারে না এবং অপরকে বুঝতে দেয় না। সব কিছু জানার পরও কেন এ দিকে ধাবিত হচ্ছে তার সঠিক ধারণা কারো নেই। তাই এটা থেকে বের হতে হলে রাতারাতি কোনো পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্ভব নয়। মাদক ব্যবহার হঠাৎ করে বন্ধ করলে শরীরের উপর উক্ত মাদক প্রত্যাহারজনিত মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। মাদক গ্রহণের সাথে সাথে মানুষ সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। পরে শুরু হয় পারিবারিক বিচ্ছেদ। প্রাথমিক অবস্থায় বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে সাধারণত এ যাত্রা শুরু হয়ে থাকে, যার প্রাথমিক সূত্রপাত হতে পারে সিগারেটের মাধ্যমে। এক সময় এসব মাদক কেবলমাত্র যুবকরাই গ্রহণ করতে দেখা যেত। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় যুবতীরাও সমান তালে এগিয়ে চলছে। কিছু দিন পূর্বেও শহরে এসবের ব্যবসা থাকলে বর্তমানে গ্রামে গঞ্জে এর বিস্তৃতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হওয়ার কারনে মাদক অতি সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামে। পারিবারিক মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় চর্চার অভাবের কারণে মাদকের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অবহিত হতে পারছে না। এছাড়াও কমেছে মানুষের পারিবারিক বন্ধন এবং সামাজিক দায়িত্বহীনতা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক দেশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, প্যাথেডিন, বুপ্রেনরফিন, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মান্টেড ওয়াশ, বুপ্রেনরফিন (বনোজেসিক ইঞ্জেকশন), মরফিন, আইচ পিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টুলইন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ইয়াবা। নামটা শুনলে মনে হয় না এটা এক জাতীয় মাদকদ্রব্য। কারণ এটা স্বাভাবিক পণ্যর মতোই পাওয়া যাচ্ছে। দেশের যত্রতত্র মিলছে এ মরন নেশা।

এই মাদকের সাথে সমাজ ব্যবস্থায় যে পঁচন ধরছে তা থেকে প্রভাব পড়ছে সমাজের সকল জায়গায়। তিলে তিলে নষ্ট হচ্ছে ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র। মাদকে আসক্ত করার জন্য মাদকসেবীরা তরুণ-তরণীদের বিনা পয়সায় এসব নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করিয়ে আসক্ত করছে। পরবর্তীতে তারাই এসব নেশার অর্থ যোগান দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রবেশ করছে এসব নেশা জাতীয় দ্রব্য। আবার অনেক সময় মাদকাসক্তদের নিয়ে পারিবারিক বা সামাজিকভাবে লুকোচুরির কারণে একদিকে যেমন আসক্তদের চিকিৎসা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, তেমনি মাদকাসক্তি ঠেকাতেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও মিলছে না সুফল। বিভিন্ন বাহিনীর অভিযানে প্রায় সময়ই ধরা পড়ছে ছোট বড় অনেক চালান। সাথে ধরা পড়ছে মাদকসেবী ও ছোট ছোট চালানকারীরা। বড় কারবারিরা রয়ে যাচ্ছে চোখের অন্তরালে, আইনের বাইরে। কয়েক দিন পরেই আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসছে জেল থেকে এসব অপরাধী। আবারও পুরানো কর্মে লিপ্ত হচ্ছে। আবার অনেকেই আইন শৃংখলা বাহিনীর ঝামেলা এড়াতে বিদেশে অবস্থান নিয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়া মারফত জানা যায়, বিদেশ থেকেও তারা এসব ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মাদক দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস, অপব্যবহার ও চোরাচালান প্রতিরোধ এবং মাদকাসক্তের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। ওই আইনের অধীনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এবং এসব অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিনও এসব মামলার অগ্রগতি না হওয়ায় দেখা দিয়েছে মামলার জট। তবে বিগত ১৯ নভেম্বর তারিখে সংসদে সকল আদালতে বিচারকার্য করার লক্ষ্যে ‘ মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন)- বিল ২০২০ পাস হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতকে মামলা প্রাপ্তির তারিখ ৯০ কার্য দিবসের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। আর রায় দেওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। এখতিয়ারসম্পন্ন আদালত বলতে জেলা দায়রা জজ, মহানগর দায়রা জজ, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেকে বুঝাবে। এসকল আদালতে এখন মাদকের মামলার বিচার কার্য সম্পন্ন হবে। তাতে আশা করা যায়, মামলার জট কিছুটা কমবে এবং স্বল্প সময়েই রায় পাওয়া যাবে। কিন্তু দেখার বিষয়, এসব মামলায় পুলিশের ভূমিকা কি হয়। কারন পুলিশের তদন্ত সঠিক না হলে আইনের মাধ্যমে সঠিক বিচার পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় আইনের সুফল পাওয়া সত্যিকার অর্থে ভাগ্যের ব্যাপার। আর বিশেষ করে এটা যদি হয় দরিদ্র ও গ্রামের মানুষের বেলায় তাহলে তো ভোগান্তির শেষ নেই। কাগজেপত্রে কিংবা বক্তৃতায় যত সহজে বলা যায় আইনের সুফল তত সহজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টিতো রয়েছেই। ২০১৮ সালের আইনে নেশার বড়ি ইয়াবার উৎপাদন, পরিবহন, বিপণনের জন্য সর্বোচ্চ মৃত্যু দন্ডের বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু এ দুবছরে কতটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে মাদক? মাদক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় একটা ভূমিকা রয়েছে পুলিশ বাহিনীর। সম্প্রতি এ বাহিনীতেও মাদকের ব্যাপারে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক পুলিশ সদস্যের চাকরি হারাতে হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো উদ্যোগ। মাদক নিয়ে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা তৈরিতে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যেটুকু সচেতনতার কথা বলা হচ্ছে তাও বাস্তবে নেই। মূল কথা হচ্ছে, সচেতনতা তৈরির যে প্লাটফর্ম প্রয়োজন সেখানে আমরা যেতে পারছি না। এবং যে সচেতনতার কথা বলা হচ্ছে তাও আবার শহরকেন্দ্রিক। তাই গ্রামেগঞ্জে এর প্রভাব দিন দিন দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রামেগঞ্জের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায় অভিভাবকদেরই এ সম্পর্কে ধারণা নেই। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় এতটা চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে যে, যেখানে নির্বাসিত হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণের শিক্ষা। অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২৮ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদক বিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটি কী করছে, এর খবর কে নিচ্ছে? কাগজেপত্রে যেসব কমটি রয়েছে এসব কমিটিকে কাজে লাগাতে হবে। কারণ বর্তমানে শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে বয়সের কারণে। এবং এসব বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বশেষ কথা হলো, এ অবস্থা থেকে ফিরে সুন্দর একটি রাষ্ট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন মাদকদ্রব্যের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধের মাধ্যমে সহজলভ্যতা রোধ করা, মাদকের শারীরিক কুফল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, মাদক ব্যবসায়ের সাথে জড়িতদের আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা, বেকারদের কর্মসংস্থান, প্রতিটি ধর্মের মূল্যবোধ সম্পর্কে অবহিত ও এর বিধি নিষেধ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি এর কুফল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় শক্তিশালী করা এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
লেখক: প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন