শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলার বিকল্প নেই

প্রকাশের সময় : ২৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ
একটি দেশ কতটা উন্নত তার পরিচয় পাওয়া যায় দেশটির রাজধানীর চিত্র দেখে। রাজধানীকে বলা হয় দেশের মুখ। মানুষের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন বা ভাব দেখে যেমন তার রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, মান-অভিমান, হাসি-আনন্দ বোঝা যায়, তেমনি একটি দেশের রাজধানীর চেহারা দেখেও দেশটির সার্বিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশ, তা ধনী হোক আর দরিদ্র হোক, রাজধানীকে পরিপাটি রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করে না। আর যাই হোক, রাজধানীকে সুন্দর করে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে হবে। তা না হলে সভ্যতা ও মানসম্মান বজায় রাখা সম্ভব নয়। কারণ হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে নামিদামি ব্যক্তিবর্গ ও পর্যটকরা রাজধানীতেই আসেন। রাজধানীর চেহারা দেখে তারা দেশটির উন্নতি, অগ্রগতি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন। তাদের মনে ইতিবাচক ধারণা জন্মালে বিশ্বে দেশের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি পায়। এ জন্যই প্রত্যেক দেশ রাজধানীকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। অন্যদিকে রাজধানীকে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির ‘হাব’ বলা হয়। দেশের উন্নতি ও সভ্যতার প্রত্যেকটি সূচকের সুষম উপস্থাপন রাজধানীর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। বলা যায়, প্রত্যেকটি সূচকের নমুনা রাজধানীতে সন্নিবেশিত হয়। আমরা যদি পার্শ্ববর্তী ভারতের কথা ধরি, তাহলে দেখা যাবে, রাজধানীসহ বড় বড় শহর বেশ পরিপাটি করে গড়ে তোলা হয়েছে। ঝকঝকে ও চকচকে উপস্থাপন করে স্লোগান দিচ্ছে ‘সাইনিং ইন্ডিয়া’। অথচ দেশটির জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগ এখনো খোলা আকাশের নিচে মলমূত্র ত্যাগ করে। যথাযথ স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নেই। শুধু রাজধানী ও কিছু শহরকে আধুনিক করে বিশ্বকে দেখাচ্ছে, তারা বিরাট উন্নতি সাধন করছে। এটা  দেশের সমৃদ্ধি বিশ্বে উঁচু করে দেখানোর একটা কৌশল।
দুই.
ঢাকাকে নিয়ে আমাদের স্বপ্ন ও গর্বের শেষ নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত ও অসভ্য নগরী হিসেবে দুর্নাম হলেও ঢাকা আমাদের প্রাণের শহর। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিকসহ সবকিছুরই প্রাণকেন্দ্র। যত সমস্যাই থাকুক ঢাকা ছেড়ে কেউ যেতে চায় না। সারা দেশের মানুষ ঢাকার দিকেই তাকিয়ে থাকে। কোনো রকমে ঢাকায় একবার থাকার মতো ব্যবস্থা করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে। এই প্রবণতার কারণে প্রতিদিন ঢাকামুখী মানুষের ঢল নামছে। হু হু করে বাড়ছে এর জনসংখ্যা। এখন ঢাকায় বসবাস করে সরকারি হিসেবেই প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। বেসরকারি হিসেবে আরও বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের দিকে এ জনসংখ্যা দাঁড়াবে আড়াই কোটি। হবেই বা না কেন? প্রতিদিন যদি সারা দেশ থেকে আড়াই-তিন হাজার মানুষ প্রবেশ করে, তবে ঢাকার জনসংখ্যা তিন-চার কোটিও হতে পারে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকা নগরীর প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় তিন হাজার লোক বসবাস করে। বিশ্বে এমন ঘনবসতিপূর্ণ শহর আর একটিও নেই। জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত শহর এটি। গাদাগাদি করে বসবাস করছে মানুষ। এই বিপুলসংখ্যক নগরবাসীর সুযোগ-সুবিধার মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ডও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। একটি আদর্শ রাজধানীর সুযোগ-সুবিধা কেমন, এ অভিজ্ঞতা ঢাকার মানুষের নেই বললেই চলে। সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত সিটি করপোরেশনসহ যেসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো পরিচালনার ট্যাক্স নগরবাসী দিলেও তার বিপরীতে যে ন্যূনতম সেবা পাওয়ার কথা, তা প্রতিষ্ঠানগুলো দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। নগরবাসীর বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার দায়িত্ব যে ওয়াসার, প্রতিষ্ঠানটি তা নিশ্চিত করতে পারেনি। তার সরবরাহকৃত পানি ময়লা-আবর্জনাপূর্ণ, ঘোলা ও দুর্গন্ধযুক্ত। এ পানি পান করা দূরে থাক ঠিকমতো রান্নাবান্না, কাপড়-চোপড় ধোয়া ও গোসল করা মুশকিল। ঢাকা শহরের কতভাগ মানুষ ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি পান করে, তার পরিসংখ্যান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। পরিসংখ্যান করলে দেখা যেত, শতকরা ২ ভাগ মানুষও এ পানি পান করে কিনা সন্দেহ। এই দূষিত পানিই ওয়াসা বেশ চড়া দামে নগরবাসীর কাছে বিক্রি করছে। অথচ আমাদের মতো অনেক দেশেই সরকারিভাবে যে পানি সরবরাহ করা হয়, তা নিঃসংশয়ে মানুষ পান করে। উন্নত বিশ্বের নাগরিকরা তো সরাসরি ট্যাপের পানি পান করে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, মিষ্টি পানির অফুরন্ত ভা-ারের দেশ হওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ওয়াসার কাজ শুধু বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করাই নয়, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও ঠিক রাখা। ঢাকার ড্রেনেজ সিস্টেমের কী করুণ দশা তা বোধকরি নতুন করে বলার কিছু নেই। সামান্য বৃষ্টিতেই বেশির ভাগ সড়কে হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি জমে যায়। রাজধানীর যে চিরায়ত যানজট, এ জট তীব্র আকার ধারণ করে বৃষ্টির সময়। রাস্তায় জমে থাকা পানি দিয়ে মানুষ চলাচল দূরে থাক যানবাহনও চলতে পারে না। বাধ্য হয়ে চলতে গিয়ে খানাখন্দ ও ওয়াসার খোলা ম্যানহোলে পড়ে অনেককে হতাহতও হতে হয়। আমরা দেখেছি, ওয়াসার ম্যানহোলে পড়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি শিশুর করুণ মৃত্যু হয়েছে। আবার জমে থাকা পানিতে বিদ্যুতের ছেঁড়া তারে জড়িয়ে মৃত্যুবরণের ঘটনাও ঘটেছে। এসবের কোনো দায়দায়িত্ব ওয়াসা কর্তৃপক্ষ নেয়নি। এমনকি ন্যূনতম দুঃখও প্রকাশ করেনি। এ ধরনের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতা কি সভ্যতার মধ্যে পড়ে? যানজটের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ শহর। বলা হয়, যানজটই ঢাকাকে অচল ও স্থবির একটি শহরে পরিণত করেছে। শুধু যানজটে আটকা পড়ে ঢাকা শহরে প্রতিদিন মানুষের লাখ লাখ শ্রম ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এই শ্রম ঘণ্টার মূল্যমান গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা। কারো কারো মতে আরও বেশি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে যদি শুধু যানজটের কারণে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকসান হয়, তবে উন্নয়নের চাকাটি সচল থাকবে কীভাবে? যদি এ অর্থ ক্ষতি না হতো, তাহলে দেশের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতÑ এ চিন্তাটি কেউ করছে বলে মনে হয় না। সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। যানজটে যে শুধু আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, মানুষের কাজকর্মও স্থবির করে দিচ্ছে। যে কাজ এক ঘণ্টায় শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, সে কাজ করতে চার-পাঁচ ঘণ্টা, এমনকি দিনও চলে যায়। এতে কর্মজীবী একজন মানুষের যে মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, এর দায় কেউই নেয় না। গুরুতর রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে যথাসময়ে হাসপাতালে পৌঁছানো তো এক প্রকার অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের একমুহূর্ত বিলম্ব করার সুযোগ নেই, সেখানে যানজটে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এ দৃশ্য কোনো দেশের রাজধানীতে দেখা যায় কিনা, জানা নেই। তবে এটা জানি, আমাদের রাজধানীতে এ চিত্র নিত্যদিনের এবং অ্যাম্বুলেন্সে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও অহরহ ঘটছে। এসব খবর খুব কমই নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছায়। অথচ যে রোগী মৃত্যুবরণ করে সে যদি একটি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়, তাহলে সে পরিবারটির কী দুর্দশা হয়, তা আমরা কখনই বা খোঁজ রাখি! বলা হয়, যানজটের অন্যতম কারণ ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটের স্বল্পতা। একটি আদর্শ নগরীতে সড়ক পথের জন্য শতকরা ২৫ ভাগ জায়গা থাকতে হয়। ঢাকায় আছে মাত্র ৮ ভাগ। এই সড়ক দিয়েই প্রতিদিন লাখ লাখ যানবাহন যাতায়াত করে। এই সড়কেরও একটি বিরাট অংশ বেদখল হয়ে আছে। পরিস্থিতি যদি এই হয়, তবে যানজট থেকে কোনো দিনই মুক্তি মিলবে না। বড় বড় ফ্লাইওভারও খুব একটা কার্যকর হবে না। নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, ৮ ভাগ সড়কও যদি যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যবহার করা যেত, তাহলে যানজট অনেক সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হতো। প্রশ্ন হচ্ছে, এ কাজটি করবে কে? এ দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হলেও তারা কি তা করতে পারছে? উল্টো এমন চিত্র দেখা যায়, সড়ক দখলমুক্ত করার পরিবর্তে সিটি করপোরেশন ফুটপাথে দোকানপাট বসা এবং মূল রাস্তায় গাড়ি পার্কিংয়ের অনুমতি দিচ্ছে। এমনকি সিটি করপোরেশন এ বিষয়টিও আমলে নিচ্ছে না। যানজটের অন্যতম কারণ যে রিকশা, সেই রিকশা চলাচলে সে যে লাইসেন্স দিয়েছে, তার চেয়েও বহুগুণ বেশি রাস্তায় চলাচল করছে। তার অনুমোদিত ৮০ হাজারের জায়গায় চলাচল করছে কয়েক লাখ। এই ধীরগতির যানটি মূল সড়কে যেমন খুশি তেমনভাবে চলছে। বিশ্বের কোনো দেশে এমন দৃশ্য দেখা যায় না। ফলে ঢাকা নগরী বিশ্বে রিকশার রাজধানী হিসেবেও পরিচিত। ডিজিটাল যুগে এসে যদি রাজধানীকে রিকশার রাজধানীর পরিচিতি নিয়ে থাকতে হয়, তবে এর চেয়ে পরিতাপের আর কিছু হতে পারে না। রাজধানীতে নাগরিকদের জন্য আরও যে মারাত্মক দুটি ঘাতক রয়েছে তা হচ্ছেÑ শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ। এ ব্যাপারে সরকার তো বটেই কেউই সচেতন নয়। অথচ ঢাকা দূষণের নগরী হিসেবেও বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে। এই দুই দূষণে নগরবাসী নীরবে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাইপারটেনশন, হৃদরোগ, ক্যান্সার, অ্যাজমা ও বধিরতাসহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। দেখা যাচ্ছে, ঢাকায় যারা বসবাস করছে, তারা যেন অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা একটি জেলখানায় বসবাস করছে। যেখানে সভ্য নগরী ও তার নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা খুবই অপ্রতুল এবং কষ্টসাধ্য।
তিন.
কয়েক দশক আগেও ঢাকা শহরের এমন দুরবস্থা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক সভায় ঢাকা শহর নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। তার স্মৃতিচারণে ঢাকা কেমন ছিল, তারও কিছু সুন্দর চিত্র উঠে আসে। তিনি বলেন, আমরা যখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে আসি, তখন আশপাশে ধানক্ষেত দেখা যেত। কেউ আসলে বলত ঢাকা থেকে এসেছি বা ঢাকা যাচ্ছি। সে সময় ধানমন্ডিকে ঢাকা বলে গণ্য করা হতো না। বসুন্ধরার এলাকাটি ছিল একটি বিল। আজকের পান্থপথটি ছিল একটি খাল। সেখানে শাপলা ফুটত, নৌকা চলত। খালটি ধানমন্ডি লেক হয়ে নদী পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছিল। মতিঝিলের ঝিলে নৌকায় চড়েছি। আজকের যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তা ছিল রাজধানীর বাইরে। জাতীয় তিন নেতার কবরের সামনে ছিল ঢাকার প্রবেশদ্বার ‘ঢাকা গেট’। সেই ঢাকা গেটের স্তম্ভ এখনো আছে। মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতাল তো গ্রামেই গড়ে তোলা হয়েছিল। এখন তা বোঝার উপায় নেই। তিনি বলেন, এখন ঢাকা প্রায় টাঙ্গাইল পর্যন্ত চলে গেছে। অচিরেই ময়মনসিংহ পর্যন্ত চলে যাবে। এভাবেই একটি শহর গড়ে ওঠে। বলাবাহুল্য, যারা ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা তারা ঢাকার এ চিত্র সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন। সময়ের সাথে সাথে এবং নাগরিক প্রয়োজনে নগরের পরিধি বৃদ্ধি পাবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এ পরিধি বৃদ্ধি ঘটতে হবে মূল নগরকে ঠিক রেখে সুষম পরিকল্পনা এবং নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। ঢাকার পরিধি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, মূল শহরের কাঠামো ভেঙে যে যেভাবে পেরেছে, সেভাবে এর সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। এক সময় ঢাকা শহরে প্রায় ৪৬টি খাল ছিল। এসব খালের অধিকাংশই এখন নেই। অবৈধ দখলের কারণে হারিয়ে গেছে। অথচ এই খালগুলোর কারণেই ঢাকা একসময় ‘জলেভাসা পদ্ম’ নামে পরিচিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, রাজধানীর সব খাল দখল হয়ে যাওয়ায় নগরবাসীকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। শহরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পান্থপথের খালটিকে মাঝে রেখে তার দুইদিকে রাস্তা করলে দেখতে যেমন দৃষ্টিনন্দন হতো, তেমনি জলাবদ্ধতা দূর করে পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতো। এটিকে বক্স কালভার্ট করে শেষ করে দেয়া হলো। সেগুনবাগিচা ও শান্তিনগরের খাল দুটিকেও একই অবস্থা করা হয়েছে। রাজধানীর বায়ু দূষণ এবং নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য পার্ক অত্যন্ত জরুরি। এগুলোকে বলা হয় রাজধানীর ফুসফুস। ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটি পার্ক থাকলেও অযতœ ও অবহেলায় এগুলো বেহাল হয়ে রয়েছে। ইট-পাথরের ভবন থেকে বের হয়ে পার্কে গিয়ে যে বুকভরে নিঃশ্বাস নেবে, তার উপায় নেই। সিটি করপোরেশনের উত্তরের মেয়র ঘোষণা দিয়েছেন আগামী দুই বছরের মধ্যে ঢাকাকে গ্রিন সিটিতে পরিণত করবেন। দেখার বিষয়, তিনি এ কাজে কতটুকু সফল হন। রাজধানীর চির দুঃখ হয়ে রয়েছে, সেবাদান প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার নামে রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি। তাদের এই সেবা বৃদ্ধিকরণ কর্মকা-ে নগরবাসীর দুর্ভোগ স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। একটা সময় আমেরিকায় স্বর্ণ অনুসন্ধানের জন্য মানুষ শাবল-খুন্তি নিয়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করত। তাদের মতোই ঢাকার সেবাদান প্রতিষ্ঠানগুলো সেবার লক্ষ্যে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করলেও সেবার পরিবর্তে নগরবাসী কেবল দুঃখই পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো যেন রাস্তা খোঁড়ার পরিবর্তে সরকারি কোষাগার খুঁড়ে অর্থ বের করে নিচ্ছে।
চার.
পৃথিবীর খুব কম দেশেই রাজধানীতে একই সাথে প্রশাসনিক, আবাসিক, বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও শিল্পকারখানা থাকে। রাজধানীকে তারা যতটা সম্ভব আবাসিক এলাকা থেকে আলাদা করে রাখে। আবাসিক এলাকা থাকবে রাজধানীর মূল কেন্দ্র থেকে বাইরে। এক সময় ঢাকায় এই আদর্শ পরিবেশ ছিল। ধানমন্ডির কথা যদি ধরি তবে দেখা যায়, পঞ্চাশের দশকে আবাসিক এলাকা হিসেবে ধানমন্ডিকে মূল শহরের বাইরে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়। সেখানে তিন বিঘা করে একেকটি প্লট এবং এতে পঞ্চাশ জনের বসবাসের উপযোগী করে পরিকল্পনা করা হয়। পুরো ধানমন্ডির মানুষের সংখ্যা হিসেবে করে সেখানে স্কুল, খেলার মাঠ, পার্ক, লেক, মার্কেট ও প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। অর্থাৎ ঢাকার অদূরে একটি গার্ডেন সিটি হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। গুলশান, বনানী পরবর্তীতে উত্তরাও একই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে তোলা হয়। অর্থাৎ মূল শহর থেকে দূরে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলাই এর মূল পরিকল্পনা ছিল। কোনকালে এসব এলাকা ঢাকার বাইরে ছিল এখন তা বিশ্বাসই করা যায় না। নগরীর সম্প্রসারণ এত দ্রুতই হয়েছে যে এসব এলাকা প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এ সম্প্রসারণ সুষমভাবে হয়নি। প্রভাবশালীরা যে যেভাবে পেরেছে নিজেদের মতো করে রাজধানীকে সম্প্রসারিত করেছে এবং করে চলেছে। এসব নিয়ন্ত্রণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলে যে একটি কর্তৃপক্ষ আছে, তার কার্যক্রম কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। যদি বাস্তব ক্ষেত্রে তার জোরালো ভূমিকা থাকত, তাহলে রাজধানীর অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হতো। বোঝা যাচ্ছে, রাজধানীর এই অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ দায়িত্বরত কোনো কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা ঠেকাতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ঠেকাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বলেছেন, নাগরিক সেবা বাড়াতে ঢাকাকে ভেঙে আরও ছোট করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ পরিকল্পনা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। রাজধানী বাড়তে বাড়তে আরেকটি শহরের সাথে মিশে যাবে, এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। একটি দেশের রাজধানীর নির্দিষ্ট আয়তন থাকা দরকার। এই আয়তনকে কেন্দ্র করে অন্যান্য এলাকা পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলাই আদর্শ রাজধানীর বৈশিষ্ট্য। এতে রাজধানী যেমন ভারমুক্ত হয়, তেমনি অনিন্দ্যরূপে গড়ে তোলাও সম্ভব। সবচেয়ে বড় বিষয়, ঢাকাকে বাসযোগ্য ও আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। প্রশাসনিক কোনো ছোটোখাটো কাজ করতে দেশের আনাচে-কানাচে থেকে মানুষকে রাজধানীতে ছুটে আসতে হবে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি উপলব্ধি করে বলেছেন, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। সবার কাছে সেবা পৌঁছে দিতে হবে। এ জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একান্তভাবে প্রয়োজন। রাজধানীর সেবা ও পরিকল্পনার কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রধানমন্ত্রীর এ কথা যত শীঘ্র বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়ে রাজধানীকে চাপমুক্ত করতে হবে। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার রাজধানী থেকে সরিয়ে কেরানীগঞ্জে নেয়া হয়েছে। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে নেয়া হচ্ছে। তেজগাঁও শিল্প এলাকা ও আবাসিক এলাকাকে আলাদাভাবে আধুনিক করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়কেও সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে রাজধানী যেমন ভারমুক্ত হবে, তেমনি সুন্দরভাবে গুছিয়ে তোলা সম্ভব হবে। বিশ্বের অসভ্য ও বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে যে বদনাম হয়েছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে রাজধানী সংশ্লিষ্ট প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
ফজলুল হক ২৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:৪৭ পিএম says : 0
পরিকল্পনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত।
Total Reply(0)
Salim ২৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:৪৮ পিএম says : 0
100% sottik kotha bolesen
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন