শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ধরে রাখতে হবে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

একটি শিশুর বেড়ে ওঠা, সুশিক্ষা লাভ, সভ্য এবং মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন হওয়ার প্রাথমিক শিক্ষালয় তার পরিবার। এ শিক্ষার শিক্ষক তার মা-বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য। তারপর স্কুলের শিক্ষক, সমাজের সৎসঙ্গ শিশুটিকে সভ্য মানুষে পরিণত হতে ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশে একটি শিশুর প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত জীবনের ভাল-মন্দ শিক্ষার বিষয়টি হাজার বছর ধরেই চলে আসছে। কোনো শিশু বা কিশোর খারাপ কথা বললে বা কাজ করলে প্রথম বাধাটি আসে তার পরিবার এবং সমাজের অভিভাবক শ্রেণী থেকে। তাদের শাসন-বারণ শিশুটিকে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পন্ন সুপথে চলতে সহায়তা করে। এটাই আমাদের পরিবার ও সমাজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। সময়ের সাথে সাথে জীবনযাপনের ধরণ বদলালেও শিশুর বেড়ে ওঠার মৌলিক এই প্রক্রিয়ার যেন ব্যত্যয় ঘটছে। পারিবারিক ও সামজিক শাসন-বারণের বিষয়টি শিথিল হয়ে পড়ছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আমাদের সমাজে এখন এমনসব অঘটনা ঘটছে যা কল্পনাও করা যায় না। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা দুর্বিনীত হয়ে উঠছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার বেশিরভাগের সাথেই তরুণ শ্রেণী জড়িত। তরুণরা যদি অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে দেশের ভবিষ্যত বলে কিছু থাকে না। কারণ, আজকের তরুণই দেশের আগামীর ভবিষ্যত। দেশের নেতৃত্ব তারাই দেবে। এই তরুণ যখন বিপথগামী হয় এবং অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে দেশের অগ্রগামিতা থমকে যেতে বাধ্য। এই যে মাস্টারমাইন্ডের ‘ও’ লেভেলের ছাত্রীটিকে তার বন্ধু ধর্ষণ ও হত্যা করল কিংবা মাদারিপুরের কালকিনিতে এক তরুণীকে তার বন্ধু হত্যা করে লাশ গুম করে সেপটিক ট্যাংকের নিচে পুতে ঢালাই করে দেয়, এসব ঘটনা থেকে তরুণদের মন-মানসিকতা কতটা নিষ্ঠুর ও নির্দয়ের দিকে ধাবিত, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। অনেকে বলতে পারেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে তাদের কথার বিপরীতে বলা যায়, যখন কালেভদ্রে এমন একটি-দুটি ঘটনা ঘটে তখন বিচ্ছিন্ন বলা যেতে পারে। যখন এ ধরনের নৃশংস ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটে তাকে বিচ্ছিন্ন বলা যায় না। এসব ঘটনা প্রমাণ করে আমাদের পরিবার ও সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যে চরম অবক্ষয় চলছে, তার বিহিঃপ্রকাশ। যেসব তরুণ এমন পাশবিক ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ছে, বলতে হয়, তাদের পরিবারিক নৈতিক শিক্ষায় ঘাটতি রয়ে গেছে। তাদের অভিভাবকরা সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারেনি।

গত কয়েক বছর ধরে দেশে যে কিশোর গ্যাং কালচার তৈরি হয়েছে এবং এর সাথে যেসব কিশোর জড়িত, তার ব্যাখ্যা দেয়া কঠিন কিছু নয়। এসব কিশোর তাদের পরিবার থেকে কোনো ধরনের শাসন-বারণ এবং নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা পায়নি বা পাচ্ছে না। অভিভাবকরা তাদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। যদি তা না হতো, তবে পরিবারকে উপেক্ষা করে তারা গ্যাং তৈরি করে খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তির মতো গুরুতর অপরাধে জড়াত না। পারিবারের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নীতি-নৈতিকতার সুশিক্ষা দিতে পারেননি। এ থেকে বোঝা যায়, সন্তানকে মানুষ করার ক্ষেত্রে আমাদের পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব তীব্র হয়ে উঠছে। এর অন্যতম কারণ হতে পারে, সংসারের আয়-উপার্জন করতে গিয়ে বাবা-মায়েরা সন্তানের দিকে সঠিকভাবে খেয়াল করতে পারছেন না। তার সন্তানদের অরক্ষিত রেখেই উপার্জনের পেছনে ছুটছেন। এটা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণীর অভিভাবকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এসব অভিভাবক কম-বেশি আয়-উপার্জন করছেন ঠিকই, তবে সন্তানের প্রতি খেয়াল না রাখায় তারা যে বিপথগামী হয়ে পড়ছে, তা বুঝতে পারছেন না। যখন সন্তান গুরুতর অপরাধ করে ফেলে তখন বুঝতে পারলেও আর কিছু করার থাকে না। মাথায় হাত দিয়ে আফসোস ও আহাজারি করা ছাড়া উপায় থাকে না। তাহলে এই আয়-উপার্জনের অর্থ কি? অবশ্য পরিবার ও সমাজে এখন এক অসম অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এমন একটা প্রবণতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, নীতি-নৈতিকতাকে দূরে ঠেলে যে যেভাবে পারো অর্থ উপার্জন করো। এই অর্থ উপার্জন করতে গিয়েই যত দ্ব›দ্ব-সংঘাত এবং সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলশ্রæতিতে অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে।

করোনাকালে এসে তরুণদের মধ্যে খুন, ধর্ষণ, মাদকাসক্তির প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর অন্যতম কারণ হতে পারে, প্রযুক্তির অত্যধিক ব্যবহার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় কিশোর ও তরুণরা মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার নির্ভর হয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপের মাধ্যমে নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছে। এতে কিশোর-কিশোরীরা প্রভাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে অপরাধমূলক ঘটনায় উৎসাহী হয়ে তারাও তাতে জড়িয়ে পড়ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা বা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত থাকলে তরুণ-তরুণীদের অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠা অনেকটাই কমে যেত। তখন তারা ক্লাসে যাওয়া আসাসহ পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। অন্যদিকে মনোযোগ দেয়ার খুব একটা সুযোগ থাকত না। এখন পড়ালেখার চাপ না থাকায়, তাদের মধ্যে এক ধরনের আলস্য ও মানসিক অবসাদের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মনও বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। এই বিক্ষিপ্ত মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে অরাধমূলক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। করোনায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক টানাপড়েন ঘুচাতে গিয়ে অর্থের সংস্থানে বাবা-মায়েরাও নিরন্তর ছুটে চলেছেন। এতে সন্তানের প্রতি যথাযথ দৃষ্টি দিতে পারছেন না। অনেকে সন্তানের সময় কাটাতে বা বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে মোবাইল বা ল্যাপটপ হাতে তুলে দিচ্ছেন। তাদের ধারণা, এতে সন্তানের সময় কাটবে এবং কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। তবে সন্তান এসব ব্যবহার করে কি শিখছে বা দেখছে, তা খেয়াল করছে না। এটাই করোনাকালে কিশোর ও তরুণ শ্রেণীর অনেককে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে এবং অপরাধ প্রবণ করে তুলছে। এ বিষয়টির দিকে যদি অভিভাবকরা নজর না দেন, তবে সন্তানদের বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

আমাদের দেশে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যে কথা বলা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে রাজনীতির প্রভাব উপেক্ষা করা যায় না। বহু বছর ধরেই আমাদের রাজনীতিতে বিভাজন ও হিংসা-বিদ্বেষ চলে আসছে। এই বিভাজন এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সরকারি দল যেমন বিরোধী দলকে সহ্য করতে পারে না, তেমনি বিরোধী দলও সরকারি দলকে সহ্য করতে পারে না। ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলকে দমন করে তার উন্নয়নের নীতি অবলম্বন করে চলেছে। সরকারের এই উন্নয়নের রাজনীতিতে দুর্নীতি ও সন্ত্রাস ঘটলেও নিস্ক্রিয় বিরোধী দলের পক্ষে কিছু করার থাকছে না। কেবল বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েই দায় সারছে। ফলে রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া প্রভাবে দুস্কৃতি শ্রেণীও প্রভাবিত হয়ে অপরাধমূলক ঘটনা ঘটাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, যে কোনো অপরাধমূলক ঘটনার সাথে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মহলের কোনো না কোনো যোগসূত্র রয়েছে। বলা বাহুল্য, রাজনৈতিক এই বিভাজন সমাজকেও বিভক্ত করে দিয়েছে। সমাজে তরুণ শ্রেণী অপরাধমূলক ঘটনায় জড়িয়ে পড়লেও বিভাজিত অভিভাবক শ্রেণী বিবাদে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় তাতে বাধ সাধছে না। ফলে অপরাধী নির্বিঘেœ অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, মাদক সব অপরাধের মূল উৎস। দেখা যাচ্ছে, দেশ এখন মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে। কিশোর, তরুণ থেকে শুরু করে প্রায় সব শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মাদকের অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে তরুণ শ্রেণী ভয়ংকর সব অপরাধে জড়াচ্ছে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বনের কথা বললেও তা এখন কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। মাদকের বিস্তার রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। বানের পানির মতো সীমান্ত দিয়ে মাদক আসছে। মাদক বহনকারি ও চুনোপুটি টাইপের কিছু মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়লেও এর গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে মাদকের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের যুব সমাজকে রক্ষা করতে হলে সবার আগে এই মাদকের বিস্তার রোধ করতে হবে। তা নাহলে, দেশে যেসব ভয়াবহ অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে, তা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

পরিবার ও সমাজে এখন নীতি-নৈতিকতা ও মুল্যবোধের আকাল দেখা দিয়েছে এবং তা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের তরুণ সমাজের বিপথগামী হওয়া থেকে ঠেকানো যাবে না। তাদের রক্ষা করতে হলে প্রথমেই পরিবার ও সমাজের অভিভাবকদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। সন্তান বাসা থেকে বের হয়ে কোথায় যায়, কখন ফিরে, কার সাথে মিশছে-এ ব্যাপারে অভিভাবকদের কঠোর নজরদারি করতে হবে। তাদের জবাবদিহির আওতায় রাখতে হবে। অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে সন্তানদের অরক্ষিত রাখা যাবে না। বিপথগামী সন্তানের অভিভাবকদের কী অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট তা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের সন্তানকে আগলে রাখতে হবে। তাদের সঠিক পরিচর্যা করতে হবে। পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও রীতি-নীতির আওতায় রেখে তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন