রেবা রহমান, যশোর থেকে
ভবদহ স্লুইস গেট যশোরের জন্য একটি বড় অভিশাপ। সেই ’৮৫ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছর যশোরের মনিরামপুর, অভয়নগর ও কেশবপুর উপজেলার বিরাট এলাকা ডুবিয়ে দেয়। শুধু যশোর নয়, আশপাশের সাতক্ষীরার তালা, ডুমুরিয়ার অংশও হয় ক্ষতিগ্রস্ত। ভবদহ পানি নিষ্কাশন কমিটির উপদেষ্টা বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ইকবাল কবীর জাহিদ ইনকিলাবকে জানান, প্রায় বছরই সরকারের কোটি কোটি টাকা পানি নিষ্কাশনের নামে অপচয় হচ্ছে, একইসাথে শত শত কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে জনগণের। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত প্রকল্প এর জন্য দায়ী। তাছাড়া দুর্নীতি তো হয়ই। প্রকল্পের পর প্রকল্প নিয়ে কোনো কাজ হয় না, পানিবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হয় না। এবারের বর্ষা মৌসমে পানিবদ্ধতা মারাত্মক রূপ নিয়েছে গত দুই সপ্তাহ ধরে। পানিবন্দিদের খাবার কষ্ট এখন মারাত্মক। এলাকার অনেক সড়কপথ বন্ধ হয়ে গেছে। পানিবন্দিরা ডিঙ্গি নৌকায় যাতায়াত করছেন। কেশবপুর সদরেও পানি ঢুকে পড়েছে। কেশবপুর মাছ বাজার ও ধানহাট তলিয়ে গেছে। এছাড়া পাজিয়া, পাথরঘাটা, মনোহরনগর, শ্যামনগর ও বাগদা, মনিরামপুরের নেহালপুর, কুলটিয়া, হরিদাসকাঠি, মনোহরপুর, ঢাকুরিয়া, অভয়নগরের সুন্দলী, পায়রা, চলিশিয়া, কেশবপুরের পাঁজিয়া, গৌরিঘোনাসহ বিরাট এলাকার প্রায় ২শ’ গ্রামে পানি ঢুকেছে। সাপের ছোবলে মারা গেছে ৮ জন। মনিরামপুর উপজেলার খর্দ্দগাংড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র রাকিব (১৫) পানিতে ডুবে মারা গেছে। যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের বিভিন্ন স্থানে হাঁটু পানি উঠেছে। ভবদহ সমস্যার সমাধানের নামে যুগ যুগ ধরে সমস্যা জিইয়ে রেখে শুধু সরকারি অর্থ লুটপাট হয়েছেÑ এ অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্ত ভবদহ এলাকার সাধারণ মানুষের। ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের অভিযোগও একই। ভবদহ স্লুইস গেটের কারণে নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি নিষ্কাশন হতে পারে না। ভবদহ সংশ্লিষ্ট নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হওয়ায় বহুদিন জোয়ার-ভাটাও হয় না। মাঝে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভবদহ সমস্যার সমাধান হয়। পরবর্তীতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। যার কারণে আবারো সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। যা এখনই বাস্তবায়ন করা না হলে শুধু ভবদহ এলাকা নয়, ভরা বর্ষা মৌসুমে যশোর শহর পর্যন্ত তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন ভবদহ আন্দোলনের উপদেষ্টা ইকবাল কবীর জাহিদ। সংশ্লিষ্টরা জানান, বুড়িভদ্রা, হরিহর ও আপারভদ্রা নদীর পানি বিপদসীমার ৪ ফুট উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিতে মাধ্যমিক স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মিলে ৩টি উপজেলার প্রায় ৫০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পানিতে দেড় হাজার ল্যাট্রিন আড়াইশ’টি অগভীর ও শতাধিক গভীর নলকূপ তলিয়ে গেছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সবুজ বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে ১৯৬০ সালের দিকে যশোরের সদর, মনিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী ভবদহ নামক স্থানে শ্রীনদীর উপর নির্মাণ করা হয় একটি বড় স্লুইস গেট। একপর্যায়ে যশোর ও খুলনার প্রায় ২শ’ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৮ লক্ষাধিক মানুষের মরণফাঁদে পরিণত হয় ভবদহ স্লুইস গেট। গেটটিতে মোট কপাট ৩৬টি। গেটসংলগ্ন শ্রীনদী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী এই ৩টি নদী রয়েছে। ওই স্লুইস গেট দিয়ে বিল কেদারিয়া, বিল বকর ও বিল আড়পাড়াসহ যশোর ও খুলনা এলাকার মোট ২৭টি বিলের পানি নিষ্কাশন হতো। প্রতিটি বর্ষা মৌসুমে বিল তীরবর্তী আশপাশের শত শত গ্রামে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হতে থাকে। পরবর্তীতে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ভবদহ স্লুইস গেট চিহ্নিত হয় যশোর ও খুলনার বিরাট এলাকার দুঃখ ও অভিশাপ হিসেবে। পানিবন্দিদের কথা, ত্রাণ সাহায্য একেবারেই কম। খাবার পানির সংকট তীব্র। রান্না করার জায়গা নেই। ইতোমধ্যে যশোর-৫ এর এমপি স্বপন ভট্রাচায়, কেশবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান আমির হোসেন, কেশবপুর পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম মোড়ল, রেডক্রিসেন্টের সেক্রেটারি জাহিদ হাসান টুকুন ও মাদানীনগর মাদ্রাসার পক্ষ থেকে ত্রাণ সাহায্য দেয়া হয়েছে। শুক্রবার যশোর থেকে ট্রাকভর্তি ত্রাণ নিয়ে কপোতাক্ষ লায়ন ক্লাব যশোর ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫-এ১, বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে মনিরামপুরে পানিবন্দি দুইশত পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। ত্রাণ বিতরণ শেষে কপোতাক্ষ লায়ন ক্লাবের উপদেষ্টা ও যশোর সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি, কল্যাণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাম-উদ-দৌলা জানান. পানিবন্দি মানুষেরা ঘরবাড়ি ছেড়ে গরু-ছাগল নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে রাস্তার উপরে। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ক্লাবটির উদ্যোগে প্রথমত মনিরামপুর পাঁচাকড়ি ইউনিয়নের নতুন বাজারে একশ’ পরিবারের সদস্যদের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দেয়া হয়। পরবর্তীতে কুলটিয়া ইউনিয়নের কুলটিয়া বাজারে পৌঁছালে জড় হয়ে যায় সেখানখার পানিবন্দি মানুষের দল। তারা এসে ক্লাবের সদস্যদের নিকট তাদের স্যানিটেশন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। ত্রাণসামগ্রী বিতরণের সময় উপস্থিত ছিলেন ক্লাবের রিজিয়ন চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা, ক্লাব সভাপতি শেখ আশরাফুর রহমান, ক্লাব সদস্য মোহাম্মদ ইসাহক, আখতার ইকবাল টিয়া।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন