নানিয়ারচরের রসে টইটুম্বুর কমলার সুনাম এখন জগত জোড়া। বাজারে আনতেই থাকছে না কমলা। মূহুর্তেই ঝুড়ি ফাঁকা করে কিনে নিয়ে যাচ্ছে ক্রেতারা। রাঙামাটি জেলার দুর্গম উপজেলা বলে পরিচিত নানিয়ারচরের এসব কমলা খেতে যেমন মিষ্টি, দেখতেও চোখ জুড়ানো আকৃতির। নানিয়ারচরের কমলা ছাড়া বাজারে এত বড় সাইজের কমলা আর নেই। ঢাউস আকৃতির রসে ভরা এসব কমলা প্রতিদিন কুরিয়ারের মাধ্যমে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যাচ্ছে; এমন কি দেশের বাইরেও যাচ্ছে বলে জানালেন একাধিক ক্রেতা। তবে যারা পাঠাচ্ছেন তারা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নয়, উপহার হিসেবে পাঠাচ্ছেন এসব কমলা। বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় এই কমলার বাণিজ্যিক পসার এখনও তেমন একটা জমেনি বলে অভিযোগ করলেন চাষিরা নিজেরাই।
এদিকে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় বেশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে এসব কমলা। দাম পেয়ে চাষিরা খুশী। দিন দিন কমলা চাষে আগ্রহী চাষির সংখ্যা বাড়ছে। নানিয়ারচর বাজারে কমলা বিক্রি করতে আসা চাষিদের সাথে কথা বলে জানা গেলো। তাদের বেশির ভাগ চাষিই সখের বসে কয়েকটা করে গাছ লাগিয়েছেন। এখন এর বাজার মূল্য দেখে বাগান বড় করার পরিকল্পনা করছেন তারা।
এই কমলার কয়েকটি বিশেষত্ব আছে যার কারণে চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে, এমন মত প্রকাশ করলেন এসএ পরিবহনের মাধ্যমে ঢাকায় কমলা পাঠাতে আসা রাঙামাটির স্থানীয় এনজিও কর্মী নুরুল ইসলাম। তিনি বললেন, প্রথমত এর স্বাদটা আমদানি হয়ে আসা কমলার চেয়ে অনেক ভিন্ন প্রকৃতির মিষ্টির সাথে কিছুটা টকভাব থাকায় খেতে বেশ মজাদার। আমদানি করা যে কোনো কমলার চেয়ে এই কমলা আকারে বড় এবং সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি এই কমলাকে জনপ্রিয় করেছে তা হলো সবার মাঝেই বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে বাজারে আসা আমদানি নির্ভর কমলাগুলো প্রচুর পরিমাণে প্রিজারভেটিভ বা ফরমালিন আছে বলে সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু তাদেরই স্থির বিশ্বাস যে রাঙামাটির কমলায় কোনো ফরমালিন নেই। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত অনুরোধ আসছে রাঙামাটির কমলার জন্য। আর রাঙামাটির ঐতিহ্যবাহী সাজেকের কমলাকে ছাপিয়ে এখন বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করেছে নানিয়ারচরের কমলা। এই ডামাডোলে সাজেক বা কাউখালির কমলাও এখন নানিয়ারচরের কমলা বলে চালিয়ে দিচ্ছে বিক্রেতারা। তবে আগে সাজেকের কমলা বলে বাজারে বিক্রি হওয়া কমলা ছিল সবুজ; এখন সব কমলাই হলুদ।
রাঙামাটি শহরের বনরূপা বাজার বা নিউ মার্কেট সংলগ্ন গলিতে এই কমলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি ডজন সাড়ে তিন শ’ থেকে চার শ’ টাকায়। তবে নানিয়ার চরে আকার ভেদে ১৫০ থেকে দ’শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝে মাঝে আড়াই টাকাও বিক্রি হয় বলে জানালেন চাষিরা।
কমলা চাষ করে আশার আলোর খুঁজে পেয়েছেন নানিয়ারচরের চাষি চিত্তরঞ্জন চাকমা (৩৫)। বাজারেই কথা হলো হলো তার সাথে। তার ভাষায় অন্যান্য ফসল চাষের তুলনায় পাহাড়ে কমলা চাষ অধিক লাভজনক বলে মনে করেন তনি।
প্রায়ই নানিয়ারচর উপজেলা সদরের বাজারে কমলা বিক্রি করতে দেখা যায় সাবেক্ষং ইউনিয়নের হরিণাছড়া এলাকার নাগরচান কার্বারীর ছেলে চিত্তরঞ্জনকে। কমলা চাষের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে জানান, ২ বিঘা জমিতে কমলা চাষ করে এবছর প্রায় ১লক্ষ ৮০ হাজার টাকার কমলা বিক্রি করেছেন। গাছে এখনও বিক্রি করার মত হাজারের বেশি ফল রয়েছে।
তিনি আরো জানান, ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৩’শ চারা দিয়ে বাগান শুরু করেন তিনি। কিছু চারা মারা গেলেও এখন প্রায় ২০০-২৫০ টি গাছ রয়েছে। এসব কমলা গাছে তিনি নিজে সারা বছর সার, ওষুধ, কীটনাশক স্প্রে করে বিভিন্নভাবে পরিচর্যা করছি। উপজেলা কৃষি বিভাগ একটু সহযোগীতা করলে আরো উপকৃত হবেন বলে জানান এই কৃষক।
নানিয়ারচরে কমলা চাষে সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ ইমতিয়াজ বলেন, পাহাড়ে অন্যান্য চাষের তুলনায় কমলা চাষ বেশ লাভজনক। তিনি জানালেন, এই উপজেলার প্রায় ১২০ হেক্টর জমিতে কমলা চাষ হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা আরো বেশ ক’জন কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান ও চারা বিতরণ করেছি। প্রায় ৫০জন কৃষক এখন পর্যন্ত ভালো মানের কমলা উৎপাদন করেছে এবং ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান হয়েছে। আমরা আশাকরছি নানিয়ারচর আনারসের পাশাপাশি কমলা, মাল্টা ও লেবু জাতীয় ফলে বেশ সুনাম অর্জন করবে।
কৃষি বিভাগের এমন বক্তব্য সাধুবাদ জানিয়েছে স্থানীয় চাষিরা। তাদের মতে কৃষি বিভাগ উদ্যোগী হলে চাষি সংখ্যা বাড়বে। আর ফলন যে হারে আসছে এই ধারা অব্যাহত থাকলে রাঙামাটির কমলা এক সময় রাজধানীর বাজার দখল করে নেবে। হবে রপ্তানীও।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন