গ্রীসের ক্ষুদ্র দ্বীপ ক্যাস্তেলোরিজোর পানিতে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান করা নিয়ে জুলাইয়ের পর থেকে একাধিকবার তুরস্কের সিসমিক-জরিপ জাহাজ এবং নৌবাহিনীর জাহাজগুলি গ্রীক কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাইড্রোকার্বন নয়, বাস্তবে, ক্যাস্তেলোরিজোর ওপর এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করাই তুরস্কের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ঘটে যাওয়া কিছুই ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার মিলিত অঞ্চলের বৃহত্তর ভূ-রাজনীতি থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। এ অঞ্চলটি সর্বদাই পরাক্রমশীল রাজনীতির সূতিকাগার হিসেবে কাজ করেছে। তবে ওয়াশিংটনের ব্যর্থ ইরাক যুদ্ধ, যা বিশ্বজুড়ে আমেরিকাকে পররাষ্ট্র নীতির অগ্রাধিকার পুনর্গঠনে প্ররোচিত করেছিল, সেটির কারণে এ অঞ্চলটিতে শক্তির ভারসাম্যে দুর্বলতা তৈরি করেছে। বর্তমানে আমেরিকা ক্রমেই মধ্যপ্রাচ্যে সিদ্ধান্তমূলক হস্তক্ষেপ করার আগ্রহ হারাচ্ছে।
তুরস্কের এ পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটকে পুঁজি করে সংশোধিত ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য ঠিক করেছে। অনেকের বিশ্বাস, একই সাথে পশ্চিমাপন্থী গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক উদারকরণ এবং ইসলামী মূল্যবোধের দিকে অগ্রসরমান দেশটি আরব বিশ্বের জন্য আদর্শ বলে বিবেচিত হতে পারে। আঙ্কারা আঞ্চলিক ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পশ্চিমাদের সাথে তার বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক ও সুরক্ষা সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে চলেছে। ২০১৫ সাল থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান পূর্ব ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ায় তুর্কি হস্তক্ষেপকে যৌক্তিক প্রমাণ বরার জন্য অটোম্যান ইতিহাসের স্তুতি গেয়ে আসছেন।
তবে নব্য-অটোমানবাদের স্মৃতিকাতরতা এরদোগান এবং তার জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) অধীনে আঙ্কারার বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পদক্ষেপের ব্যাখ্যা নয়। তুরস্ক এখন বড় শক্তিগুলোর সাথে সমান শর্তে সমঝোতা করতে সক্ষম একটি মহান শক্তি হয়ে উঠতে বদ্ধপরিকর। সেই লক্ষ্যে দেশটি তার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এবং সামরিক শক্তিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। পাশাপাশি, বিনোদন, ধর্ম এবং বাণিজ্যসহ প্রতিটা ক্ষেত্রে তার বিশ্বব্যাপী কোমল শক্তিকে বাড়িয়ে তুলেছে। সব মিলিয়ে এরদোগানের উদ্দেশ্য নিছক প্রতিরক্ষা এবং টিকে থাকার চেয়ে অনেক বেশি বিষয়কে ধারণ করে। তার আসল লক্ষ্য তুরস্কের পক্ষে ভূ-রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটানো।
এ অর্থে, তুরস্ক এখন সংশোধনবাদী রাষ্ট্র। দেশটি সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করেছে এবং সিরিয়া ও ইরাকের মতো বিদেশী অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। তুরস্ক সাইপ্রাস এবং গ্রিসের দিকে স্থলসীমানা এবং সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, সিরিয়া এবং উত্তর সাইপ্রাসের ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে জড়িত, সোমালিয়া ও কাতারের মতো বিদেশে তার ঘাঁটি গেড়েছে, এবং লিবিয়া, উত্তর সিরিয়া ও নাগর্নো-কারাবাখে নির্ভরশীল নেতৃত্বকে সহয়তা করছে।
এরদোগানের সংশোধনবাদী বিশ্বদর্শন ইঙ্গিত দেয় যে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় সঙ্কট মূলত প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ে নয়। বরং তা দশক পুরানো সার্বভৌমত ও আধিপত্যের। বিষয়গুলি একই সাথে পুরানো এবং নতুন ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষার সাথে জড়িত। বিশেষজ্ঞদের এমন ধারণা করার কারণ, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ তল্লাশিতে এখনও পর্যন্ত লিবিয়া এবং গ্রিসে কোনও হাইড্রোকার্বন পাওয়া যায়নি এবং সাইপ্রাসে তুরস্কের প্রচেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্য, সাহেল এবং পশ্চিম আফ্রিকায় আরও প্রভাব অর্জনের জন্য ভূ-মধ্য সাগরকে একটি উসিলা হিসাবে দেখেছে। রাজনৈতিক অর্জন তুরস্কের সম্প্রসারণবাদকে উৎসাহিত করেছে, তবে এটি দেশটির পূর্ব পরিচয়, ইতিহাস এবং আদর্শে উদ্দীপ্ত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন